কিশোর বিদ্রোহ: আপনি-আমি কী করতে পারি

অরূপ রাহী

প্রকাশিত : আগস্ট ০৩, ২০১৮

এক.
বিকেলে দিকে লিখছিলামঃ, নবীন-কিশোরদের পাশে দাঁড়ান। রাস্তায় থাকলে তাদের পানি-খাদ্য-স্যালাইন কিনে দেন। সাহস দেন, উৎসাহ দেন, সাবাশি দেন। এটুকু অন্তত করেন। যেখানে যার পক্ষে সম্ভব। প্লিজ! এই দেশের জন্যে আমার আপনার অনেকের চেয়ে ওরা অনেক বড় কিছু বেশি কিছু করতেছে! প্লিজ, ওদের সমর্থন করে নিজেকে সম্মানিত করেন।

আসলে আমরা যারা বড়-প্রবীণ, আমাদের ভূমিকা আসলে কী হওয়া দরকার— এ নিয়া আমি যেমন ভাবতে বাধ্য হইছি, কেউ কেউ আমার সাথে তাদেরও এই ভাবনা আসার কথা শেয়ার করছেন। নবীন কিশোররা একটা বিক্ষোভকে বিদ্রোহে রূপান্তর করে ফেলছে। এই সংগ্রামের ব্যাকরণ আগাম অভিজ্ঞতায় না থাকায় আমরা অনেকেই একটু বেকুফ-হতচকিত হয়া গেছি— কী হইতেছে, আমরা কি করবো এতে, আমাদের ভূমিকা কী হবে, কীভাবে সমর্থন জানাবো বা অংশ নেব ইত্যাদি। আমি নিজেও এসব ভাবতেছি, ভাবতে ভাবতেই ফেসবুকে, অন্য সামাজিক পরিসরে আলাপ-আলোচনা, বুঝ বিনিময় করা, তথ্য দেয়া নেয়া করা— এসব করতেছি।

দুই.
এই বিদ্রোহ, যেকোনো আগের বিদ্রোহের মতোই স্বতন্ত্র। নতুন, ভাষা, ভঙ্গি, অংশগ্রহণকারী, জায়গা, পদ্ধতি, লক্ষ্য— সবদিক থিকা। কারণ বিদ্রোহ ঘটে নতুন নতুন পদ্ধতিগত জুলুমের নিগড় ভাঙার মৌহূর্তিক ঘটনা হিসেবে। তাই আগের `নিয়মে` এটা চলতেছে না, আগের `নিয়মে` একে দমনও করা যাইতেছে না। বিদ্রোহ-বিপ্লব মাত্রেই সৃষ্টিশীলতার, মুক্তি উৎসব। এই বিদ্রোহে তার অসাধারণ প্রকাশ হইতেছে।

দিন যাবে আর এটার রং-রূপ-মেজাজ পাল্টাবে। হয়তো একরূপের সমাপ্তি হবে, অন্য কোনো বিদ্রোহের জমিন হিসেবে নিজেকে ইতিহাসে যুক্ত করে নেবে। নবীন কিশোররা এত বড় ঘটনা ঘটাইতেছে— আমি কীভাবে এখানে ভূমিকা রাখবো? প্রথমত, এ বিদ্রোহের যারা বিদ্রোহী, কাজটা তারা আমাদের পরামর্শেও শুরু করে নাই, আমাদের দিক-নির্দেশনার অপেক্ষাও করে নাই, একে সংগঠিত করা, সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করা, সৃজনশীলতার সাথে তাকে আগায়ে নেয়া, গভীরতা দেয়া— মিছিল, পোস্টার, রাস্তালিখন, গাড়ির লাইসেন্স চেক করা, ড্রাইভিং লাইসেন্স, উল্টাচলার কারণে মন্ত্রীর ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গাড়ি ঘুরায়ে দেয়া, প্ল্যাকার্ড, শান্তিপূর্ণ অবস্থান, নাগরিকদের প্রতি গভীর যত্ন, সহবিদ্রোহীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমতা— সবদিক থেকেই, বিদ্রোহ পরিচালনার যাবতীয় প্রয়োজনীয় জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেচনা তাদের আছে।

আমাদের একদম ভাবা ঠিক না যে, ওরা ‘বাচ্চা’, ‘ওরা কি বুঝবে’ ইত্যাদি। সমাজের এই চেপে বসা সংস্কারকে ওরা এক লহমায় ভেঙে দিলো। আপনার আমার উচিত, নিজেদের বয়স-অভিজ্ঞতার অহংকার ত্যাগ করা। এসব অহংকার একেবারেই কাজের জিনিস না। কাজের হইলে এই বিদ্রোহের আগে আপনি-আমি অনেক বিদ্রোহের কারিগর হইতাম। তাদেরকে যথাযথ শ্রদ্ধা করাই সবচে জরুরি কাজ এই মুহূর্তর। হ্যাঁ, নবীন-কিশোর এবং ‘বাচ্চা’দের শ্রদ্ধা করতে শেখা আমাদের সমাজে বাকি।

বিদ্রোহের কেন্দ্রিকতা, দাবি-দাওয়ার ভুল-ঠিক নিয়ে অনেকের উদ্বেগ আছে। আছে এই বিদ্রোহের ‘পরিচালনা’ নিয়া উদ্বেগ। এমন বিদ্রোহের কেন্দ্রিকতা, যার প্রতীক হইলো ধরা যাক কেন্দ্রীয় কমিটি, নানা কমিটি ইত্যাদি, সেই অর্থে থাকে না বা থাকার কারণ নাই। যদি কমিটিই শুরু হইলো, তাইলে সেটা বিদ্রোহের আগে-পরের প্রক্রিয়া। বিদ্রোহের মুহূর্তে দুনিয়ায় অই কেন্দ্রিকতা ঘটনার চূড়ান্ত আকস্মিকতার কারণে নাই হয়া যায়। মানুষ তার সর্বোচ্চ সৃষ্টিশীলতা দিয়া ওইসময় ভাবে, কাজ করে, শরীর-মন মগ্ন থাকে। যদি এই নবীন-কিশোর আন্দোলন অনেক দিন চলে, নিজে একটা ধারাবাহিক, রুটিন এবং ক্ষমতা প্রক্রিয়ার সাথে নিয়মিত দেন-দরবারের প্রক্রিয়ায় ঢোকে, তখন কমিটির প্রসঙ্গ আসে, কেন্দ্রিকতার প্রসঙ্গ আসে। সেটা সময়ে আসবে, যদি আসার দরকার হয়।

সংগ্রামীদের নিরাপত্তা, জীবন ও মর্যাদার ঝুঁকি যেমন আছে, তেমনি, রাষ্ট্র চাইলেই, আজকে দুনিয়ায়, এত বড় নবীন জনগোষ্ঠীর এই অংশকে হেলায় অবলীলায় মেরে ফেলতে পারবে না। তাতে তার নিজেরই ভেঙে পড়ার বিশাল ঝুঁকি আছে। তাই এরই মধ্যে পুলিশকে বলা হইছে শক্তি প্রয়োগ না করতে। সামনে আবার সামান্য হইলেও নির্বাচনের সম্ভাবনা আছে। অনেক বিপদে শাসকেরা। কিন্তু বিদ্রোহ-বিক্ষোভের লড়াই নিজে অনেক নাজুক বটে। তার অনেক সতর্ক যত্নের দরকার হয়। সেই যতনও বিদ্রোহীরা নিষ্ঠার সঙ্গে নিতেছে।

তিন.
তাইলে এখন কিছুই কি করার নাই প্রবীণদের? আছে, আগে যেমন ছিল, তেমনি আছে। নবীন কিশোররা আমাকে আপনাকে নৈতিক টানাটানিতে ফেলছে— এটা আগে বোঝা দরকার আমাদের। আমাদের বোঝা দরকার, ওদেরকে পথ দেখানো, ওদের ভালো ভালো পরামর্শ দেয়ার কোনো দরকার নাই। ওরা ওদের জ্ঞান-বুদ্ধি-সংবেদনশীলতা-কৌশল-পরিকল্পনায় আমাদের ‘বড়দের’ চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে আগায়াই আছে, তা প্রমাণ করছে। ওরা যেটা করছে, আমাদের বড়দের সেটাই আমাদের জায়গা থিকা করা দরকার, ওদেরকে সালাম কইরা নিয়া কাজটা শুরু করা দরকার। ওরা এই দেশে ন্যায়, ইন্সাফ দেখতে চায়, বিচারহীনতার অবসান দেখতে চায়, ন্যায্য আইনের শাসন দেখতে চায়— এসবের রিহার্সাল ওরা রাস্তায় নাইমা কইরা দেখাইছে। আমরা শুধু ওদেরকে শ্রদ্ধা আর সম্মান কইরা ওদের সমর্থন জানাইতে পারি। ওদের পক্ষে সমাজে আলাপ জোরদার করতে পারি, নানা ভাষায় তা প্রকাশ করতে পারি। অভিভাবক হিসেবে ওদের নিরাপত্তার জন্যে রাষ্ট্রের ওপর চাপ তৈরি করতে পারি, সামাজিক সুরক্ষা ঘের তৈরি করতে পারি, কিন্তু ওদের তাত্ত্বিক এবং কৌশল্গত গুরু হবার কোনো তৎপরতা এই সংগ্রামের এই মুহূর্তের অভিমুখে বাধার সৃষ্টি করবে।

ওরা শুধু ওদের নিজেদের রক্ষায় রাস্তায় নামে নাই। ওরা সমাজের ভিত্তিগত ন্যায়–যার সুবিধা সবাই পাবে— তা প্রতিষ্ঠার দাবি হাজির করতে নামছে, পদ্ধতিগত অন্যায় আর হত্যা-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মধ্যে দিয়া। মানে, ওরা আমাদের জন্যেও নামছে। আমাদের উচিত আমরা কেন আমাদের চাওয়াগুলাকে গণতান্ত্রিক বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়া এক জায়গায় আনতে পারতেছি না— তার সন্ধান করা। কেন আমরা সমাজের সাধারণ ভিত্তি ন্যায়ের জন্যে লড়াই সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারতেছি না, তার অনুসন্ধান করা। কীভাবে সেই লড়াই গড়ে তুলবো, তার জন্যে সামাজিক এবং গণতান্ত্রিক বোঝাপড়া গড়ে তোলা, রাষ্ট্রকে সেই গণতানত্রিক ন্যায়ের ভিত্তিতে চলতে বাধ্য করার কাজ করা।

চার.
নবীন কিশোরদের এই বিদ্রোহ হয়তো একদিন থেমে যাবে, আমার আপনার চাওয়া না-চাওয়ার বাইরেই তা ঘটবে। কিন্তু এই বিদ্রোহ শুরু থেকেই সফল। একারণে না যে, এই বিদ্রোহ নতুন রাষ্ট্র-সংবিধান বানাইছে। এই কারণে যে, এই বিদ্রোহ সমাজে ক্ষমতার অন্যায় বিন্যাস এবং অনুশীলনের চাকা অনেক মুহূর্তের জন্যে অনেক জায়গায় ঘুরায়ে দিছে। এর সাংস্কৃতিক প্রভাব সুগভীর। এই বিদ্রোহের তাপ-চাপ-অভিজ্ঞতা নেয়ার পরে আর বাংলাদেশ আগের বাংলাদেশ নাই। এ এক নতুন বাংলাদেশ। এরই মধ্যেই। এই বিদ্রোহকে আমাদের ইচ্ছামতো চালানোর কোনো চেষ্টাই সফল হবে না। কিন্তু একে এর নিজস্ব গতি-মাত্রায় চলার পাশে আমরা দাঁড়াইতেই পারি, নিজেদের লড়াইয়ের দায় এবং দায়িত্ব থেকেই। এই বিদ্রোহের কোনো প্রচলিত ইসতেহার নাই, কিন্তু সব বিদ্রোহেই কিছু সুচিমুখ চাওয়া থাকে, এটার তা আছে। সড়কে শুধু না, সমাজে ন্যায়-ইনসাফ, মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা। একই কাজ আমাদের, আগামীতে, সবাইকে যুক্ত কইরা, নতুন নতুন উপায়ে সংগ্রাম আগায়ে নেয়ার। যে নতুন বাংলাদেশের জন্ম এরা এরই মধ্যে দিছে, আমরা সেখানে দাঁড়ায়ে ভবিষ্যতের লড়াইয়ের জন্যে প্রস্তুতি নিতে পারি কেবল। কারণ প্রতিটা বিদ্রোহের পর শুধু সমাজ শক্তিশালী হয় না, অন্যায় রাষ্ট্রও নিজের টিকে থাকার নতুন কায়দা-কৌশলের মহড়া দিতে শুরু করে। বাঁচা মানে অন্যায় ক্ষমতার বিরুদ্ধে, ন্যায় এবং ইনসাফের লক্ষ্যে সৃষ্টিশীলতায়, আনন্দের বেদনায় বাঁচা। স্বার্থক বাঁচা।

লেখক: কবি ও সঙ্গীতশিল্পী