কেন

আশিকুজ্জামান টুলু

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৬, ২০১৮

রিনাদের বাসার পেছনের দিকে বেশ ক’ঘর ভাড়াটিয়ার বসবাস। পাশাপাশি টিনের চালওয়ালা ঘরগুলোর রান্নাঘর আর গোসলখানা কমন। রুম রুম করে ভাড়া দেয়া। নিম্নবিত্তদের বাস ওখানে। ঘরগুলির শেষে একটা দুই ঘরওয়ালা বাড়ি আছে যেটাতে বাড়িওয়ালা নিজেই থাকে। রিনারা থাকে দোতলায়, ওদের পিছের বারান্দা থেকে দেখা যায় ঐ ঘরগুলো। কিছু কিছু ঘরের ভেতরের চৌকি পর্যন্ত দেখা যায়। মাঝে মাঝে সুখস্মৃতি অথবা কদাচিত খুনসুটির সাক্ষী হয়ে যায় রিনা, হতে না চাইলেও। সন্ধ্যা হয়ে গেলে পিছনের বারান্দার সাথে লাগানো ঘরটার আলোটা নিভিয়ে দিয়ে বারান্দায় লম্বা সময় কাটানো রিনার অনেকদিনের অভ্যাস। চুপচাপ বসে মানুষের জীবন দেখতে ওর কেমন যেন ভালো লাগে। সন্ধ্যা হলে লাইট জ্বলে ওঠে ওসব ঘরে। কেউ সাদাকালো ১৭ ইঞ্চি টেলিভিশনটা ছেড়ে সামনে বসে। কেউবা মেঝেতে বসে চাল বাছে, কেউবা ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটার মাথায় তেল দিয়ে দেয়। কোনো ঘরে হয়তো অনেকরাত অবধি স্বামী স্ত্রীর আজীবন না মেলা অংকের দর কষাকষি চলে, কেউ হয়তোবা সারাদিন খেটে এসে মেঝেয় বসে রাতের খাওয়াটা সারে। রিনার এই প্রতিদিনের কড়চাটা দেখতে খুব ভালো লাগে। যতক্ষণ থাকে বারান্দায়, হারিয়ে যায় প্রতিটা জীবনের সাথে। ইচ্ছা করে ঘরগুলোতে গিয়ে ওদের সাথে মিশে যেতে। ওর বারান্দাটা অন্ধকার থাকায় ওকে কেউ দেখতে পায় না।

রিনাদের দরজায় নক। রিনা দরজা খুলে দেয়। একটা মেয়ে এসেছে। মেয়েটা বলে, আমি আপনাদের পিছনের ঐ ঘরগুলির একটায় থাকি। আমার নাম আরতি। রিনা বলে, আচ্ছা।
একটা ফোন করা যাবে?
একটু দাঁড়ান। বলে, রিনা ভিতরে চলে যায় এবং মাকে বলে বিষয়টা। মা রাজি হয়ে ভেতরে আসতে দেন মেয়েটাকে। রিনা ফোনের কাছে নিয়ে যায় মেয়েটাকে। তখন ঢাকায় টিএন্ডটির ল্যান্ড ফোন ছিল, সেল ফোন ছিল না। মেয়েটা ফোনের ক্রাডল তুলে নিয়ে নাম্বার ঘুরায়, ইতিমধ্যে মা চলে আসেন ঐ ঘরে এবং বসেন পাশের সোফায়।

আরতি: স্লামুআলাইকুম।
মা: ওয়া লাই কুম আস সালাম। দাঁড়িয়ে থেকো না, বসে ফোন করো।
মেয়েটা পাশের চেয়ারে বসে। ফোন করে এবং কথা বলে মিনিট তিনেক, কেটে দেয়। ওর কথোপকথন শুনে মা এবং রিনা চমকে যায়। তিন মিনিট মোটামুটি ম্যাক্সিমাম ইংলিসে কথা বললো মেয়েটা। এত ফ্লুয়েন্ট ইংলিশ বলা মেয়ে! কী আশ্চর্য! মোটেই মিলাতে পারে না ওর ঐ ঘরগুলিতে থাকার বিষয়টা। ঐ ঘরগুলিতে সাধারণত গারমেন্টস কর্মী, দোকানদার, আইসক্রিমওয়ালাদের বসবাস। ওখানে কী করে এই মেয়ে...

মেয়েটা মা’র দিকে তাকিয়ে বলে, আমরা আপনাদের পিছনের ঐ ঘরগুলিতে থাকি। আমার নাম আরতি গোমেজ। আমার বাবা রবার্ট গোমেজ, মারা গিয়েছেন কিছুদিন আগে। আমি এবং আমার মা এখানে থাকি।
মা: তুমি কি করো?
আরতি: আমি একটা প্রাইভেট কোম্পানির রিসেপ্সনিস্ট।
মা: কতদুর পড়াশোনা করেছো?
আরতি: বিএ পাসকোর্স করেছি আবুজর গিফারি কলেজ থেকে।
মা: তুমিতো ইংরেজিতে খুবই ভালো।
আরতি: আমরা বাসায় বেশিরভাগ সময় ইংরেজিতে কথা বলি। আগে আমরা থাকতাম দিলু রোডে, বাবা মারা যাওয়ার পর চলে এসেছি এখানে।

মা বুঝতে পারলেন যে, ওরা অ্যাংলো যাদের বাংলা চলিত ভাষায় ফিরিঙ্গী বলা হয়। দিলু রোডে বেশ কয়েকঘর ফিরিঙ্গী থাকতো আশির দশকে। পরবর্তীতে ওরা কোথায় যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল যখন ঢাকা শহরে অ্যাপার্টমেন্টের বাজার বসলো এবং দিলু রোড ভরে গেল প্রায় শতাধিক প্রাণবিহীন অ্যাপার্টমেন্টে অথচ এই দিলু রোড একসময় একটা ছায়াঘেরা স্বপ্নালু নিবিড় বসতি ছিল। যেখানে সবাই সবাইকে চিনতো।

মেয়েটার সাথে আরও অনেক কথা হয়। মা’র খুব ভালো লাগে মেয়েটাকে। খুব ভদ্র এবং সুন্দর করে কথা বলে। দারিদ্রের কষাঘাতে হয়তো চেহারাটা একটু পুড়ে গিয়েছে, চুলগুলো হয়ে গিয়েছে লালচে দীর্ঘদিন পর্যাপ্ত তেলপানির অভাবে, তবুও ভদ্রতায় একটুও মলিনতা আসে নাই। চলতে থাকে আলাপচারিতা।

আরতি মাঝে মাঝেই আসে রিনাদের বাড়ি, লম্বা সময় কাটায় মা ও রিনার সাথে। কত কথা হয়, হাসি হয় কান্না হয়। কখন যেন আরতি রিনার মা ও বাবার খুব কাছের মানুষ হয়ে যায়। রিনাও ওকে খুব পছন্দ করে। আরতি একদিন মা’কে প্রস্তাব করে, খালাম্মা রিনাকে হলিক্রসে দিয়ে দেন গ্রেড নাইনে উঠলে।
মা: আমরাতো সেই কবে থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি কিন্তু কিছুতেই মেয়েটা ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারে না। কী করবো, মগবাজার স্কুল ছাড়া আমাদের আর কোনো গতি নাই।
আরতি: খালাম্মা, ওখানকার কয়েকজন সিস্টার আমার খুব কাছের মানুষ। আমি ওদের সাথে কথা বলে দেখতে পারি।
কথাটা শোনামাত্র রিনার মায়ের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, বলেন, দেখো না মা, কিছু করতে পারো কিনা।
আরতি: ঠিক আছে, আমি আগে কথা বলে নেই, কাল আপনাকে জানাবো ওনারা কি বলেন।

চলে যায় আরতি। রিনার মায়ের চোখে স্বপ্নটা খুব জেঁকে বসে, মেয়ে হলিক্রসে পড়বে। সেদিন ঠিকমতো ঘুম হয় না। কত চেষ্টা করেছে এই হলিক্রস নিয়ে, কিছুতেই কিছু হয় নাই। রাত পার হয়ে দিন আসে, দিন পার হয়ে আবার সন্ধ্যা হয়। নক দরজায়। দৌড়ে গিয়ে রিনার মা দরজা খুলে দেন এবং বলেন, আসো মা, ভিতরে আসো।
আরতি: খালাম্মা খালু কেমন আছেন?
রিনার বাবা: ভালো আছি, তুমি?
আরতি: ভালো আছি।
মা: তোমার কথা হলো সিস্টারদের সাথে?
আরতি: হয়েছে কথা, একজনকে নিয়ে আমি আসবো সামনের রবিবার আপনাদের বাসায়। তবে একটা বিষয় করতে হবে, রিনাকে আগের স্কুল থেকে টিসি নেয়াতে হবে প্রথমে।
মা: তা কেমন করে হয়? আগে ও অ্যাডমিশন পাক, তারপরতো টিসি নিবোই।
আরতি: না না খালাম্মা, আগে টিসি না নিলে উনি ভর্তি করাতে পারবে না আর তাছাড়া ওর কোনো ভর্তি পরীক্ষা লাগবে না।
রিনার বাবা: আগে টিসি নেয়ার পর যদি অ্যাডমিশন না পায় তখন এক বিপদ হবে।
আরতি: না না খালু কোনো বিপদ হবে না। অ্যাডমিশনতো একেবারেই কনফার্ম। আগে আপনি টিসিটা নিয়ে নেন আর তাছাড়া আমিতো সিস্টারকে আপনাদের বাসাতেই নিয়ে আসছি। সুতরাং কোনো অসুবিধা হবে না।

মা বেশ চিন্তায় পড়ে যান, অনেকক্ষণ চুপ করে থাকেন। রিনার বাবাও একটু সংকোচে পড়ে যান। আরও কিছুক্ষণ কথা বলে, একসময় আরতি চলে যায়। রিনার বাবা-মা গভীর একটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকেন। রাতে ঠিকমতো ওদের ঘুম হয় না। দিন দুয়েক পরে রিনার মা বাবা সিদ্ধান্তে উপনিত হন রিনার টিসি নেয়ার বিষয়ে এবং টিসি নিয়ে নেন। অপেক্ষা করতে থাকেন রবিবারের, ঐদিন সিস্টার আসছেন। টাকাপয়সাও যদি লাগে, দিতে ওনারা রাজি। হলিক্রসে ভর্তি করাটা খুব জরুরি।

দেখতে দেখতে রবিবার চলে আসে। মা মাছ মাংস সবজি রান্না করেন সিস্টারের জন্য। মনে মনে একটু দ্বিধায় থাকেন, যদি মাছ মাংস না খায় সিস্টার। উনি জানেন না যে সিস্টাররা কি খান, আর কি খান না। রিনার আব্বাও আজ ছুটি নিয়েছেন একারণে। রিনার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে গত দুইদিন আগে থেকে। ওরা সবাই অপেক্ষা করছেন সিস্টারের জন্য। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে যায়, কেউ আসে না। ওনারা অস্থির হয়ে ওঠেন, এত রান্না করার পর যদি সময়মতো মেহমান না আসে, তাহলে খুবই রাগ হয়। ইতিমধ্যে বিকাল গড়িয়ে রাত হয়ে যায়, আরতি বা সিস্টার কেউ আসে না। রাত ন’টার দিকে আর ধৈর্য ধরে না রাখতে পেরে রিনার মা ওর বাবাকে বলেন, যাও তো, একটু দেখোতো আরতিরা কেন আসছে না।
বাবা: কোথায় দেখবো?
মা: ঐতো, আমাদের বাসার পিছনের ঘরগুলোতেই থাকে আরতি, ওকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেই পেয়ে যাবে।
বাবা: কি ঠিকানা, কোন ঘরে থাকে, কিছুইতো জানি না, আন্দাজে কি যাবো ওখানে?
মা: আহা, একটু যেয়ে আশপাশের কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই তো আরতির ঘর কোনটা পেয়ে যাবে।
উফফফ! এই বলে রিনার বাবা উঠে রওনা দেন।

একটু ঘুরে পিছনের রাস্তায় যেতে হয়। পিছনের রাস্তাটায় কোন লাইটপোস্ট নাই বলে একেবারে অন্ধকার। দুদিন বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তাটায় প্যাঁচ প্যাঁচে কাদা হয়ে আছে। খুব সাবধানে পা টিপে টিপে হাঁটতে থাকেন। গিয়ে উনি পেয়ে যান আরতিদের বাসার দরজাটা। ভেতরে ঢুকতে একটু দ্বিধা হচ্ছিলো, এর মধ্যে একজন অধিবাসী বাইরে থেকে এসে ঢুকতে যান ঐ দরজা দিয়ে, ওনাকে দেখে জিজ্ঞাসা করেন, কাকে চান?
বাবা: আরতি নামে একটা মেয়ে এখানে থাকে, তাকে চাচ্ছি।
লোকটা: আরতি? কত নম্বর রুমে?
বাবা: আমি ঠিক জানি না কত নম্বরে।
লোকটা: আমার সাথে ভিতরে আসেন।
এই বলে লোকটা ওনাকে ভিতরে নিয়ে যায় এবং এক পাশে বাড়িওয়ালার বাসায় নিয়ে যায়। বাড়িওয়ালা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওনাকে জিজ্ঞাসা করে, কাকে চান?
বাবা: আরতি।
বাড়িওয়ালা: আরতিরাতো বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।
বাবা: বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে! কবে?
বাড়িওয়ালা: এইতো দিন চারেক আগে।
বাবা: দিন চারেক আগে! কোনো অ্যাড্রেস দিয়ে গেছে?
বাড়িওয়ালা: নাতো।

রিনার বাবা এক দৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকেন বাড়িওয়ালার দিকে। বাড়িওয়ালা একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায় ওনার শূন্য দৃষ্টি দেখে এবং জিজ্ঞাসা করে, কিছু হইছে?
বাবা সম্বিত ফিরে পান এবং বলেন: না না, ঠিক আছে। এই বলে চলে আসেন বাসায়। বাসার সবাই ওনার কথা শুনে একেবারে নীরব হয়ে যায়। রিনা সব শুনে চলে যায় নিজের ঘরে। রিনার মা-বাবার মুখে আর কোনো কথা থাকে না। টিসি নেয়া রিনার জীবনে কি হবে শুধু সেই ভাবনাটাই আসতে থাকে ওনাদের মনে এবং একটা যুতসই কারণ খুঁজতে থাকেন এভাবে আরতির হারিয়ে যাওয়ার।