ক্ষণআয়ুর কবিতা

মৃদুল মাহবুব

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৩, ২০১৮

এক.
আমরা সাধারণত বাংলাদেশে ‘জল’ বলি না, তবু আমাদের কবিতায় ‘পানি’ শব্দের ব্যবহার কম। এইটা দোষের কিছু না। ‘জল’ শব্দটি যেহেতু বাংলার, ফলে যে কেউ তা নানা দৈনন্দিন ব্যবহারিক কাজে ব্যবহার করতেই পারে সিটি কর্পোরেশনকে টাকা-পয়সা না দিয়েই। যে কেউ জল ত্যাগ করে পানি ব্যবহার করতে পারে। অবজারভেজনটা অন্য জায়গায়। অনেক শব্দ আছে যা ঐতিহাসিক বা পৌনঃপুণিকভাবে কাব্যসুন্দর। জলতরঙ্গের সৌন্দর্য পানির ঢেউ থেকে বেশি। কালো যমুনার জল পদ্মার পানির মতো এত আবহমান না। কিন্তু গঙ্গা! বহু ব্যবহারে, গঙ্গা বা যমুনা, অগণন কবির অসংখ্য কবিতায় ব্যবহার হতে হতে তা শিল্পসুন্দর হয়ে ওঠে। যুগের পর যুগ কিছু কবিতায় ব্যবহৃত হতে হতে আপনিই শিল্প-সুন্দর-শব্দ হয়ে ওঠে। শব্দের শিল্প সৌন্দর্য এভাবেই গড়ে ওঠে। এখন এই শিল্প-সুন্দর-শব্দের ইটে গড়া কবিতার ইমারৎ গড়-পড়তা ভালো দেখতে একটা কবিতার লুক দিবে লেখায়। এ সমস্ত ব্যবহার করে আনায়াসেই কবিতার মতো কবিতা লিখে ফেলা যায় বহু বহু। কবিতার মতো দেখতে কবিতা ফিউশন তৈরি করা সহজ একটা ব্যাপার। যতদিন যাবে শিল্পিত শব্দের সংখ্যা বাড়বে ও কবিতার মতো লেখনির সম্ভাবনা ও সহজলভ্যতা বাড়বে। এই শিল্প-সুন্দর শব্দের কম্বিনেশন, পারম্যুটেশনে তৈরিকৃত মাঝারি মাপের কিছু লেখাপত্র সমাজে বিরাজ করে সর্বদা। এই মাঝারি কবিতার মতো দেখতে লেখনির চাহিদা পাঠকের তরফ থেকে আছে। চাহিদা, উপযোগ ছাড়া কিছুতো আর তৈরি হয় না দেশ, কাল, পাত্রে। এই সব মাঝারি মানের লেখালেখিরও একটা গন্তব্য আছে। শিল্পিত-শব্দ-সৌন্দর্য দিয়ে কবিতার নিয়তে কিছু একটা সহজেই লিখে ফেলা যায়। সুন্দর সুন্দর শব্দ দিয়ে না-কবিতার উদাহরণ অনেক আছে। মহৎ কবিতা কাব্যসুন্দর শব্দের অধিক কিছু।

দুই.
মহৎ কবিদের কিছু বাজওয়ার্ড থাকে। কিছু শব্দের কয়েনে তাদের মুখচ্ছবি দেখা যায়। এই বাজওয়ার্ড বা কয়েনেজগুলো অন্যত্র অপরের কবিতায় ব্যবহৃত হলে ক্লিশে লাগে। যেমন জীবনানন্দের বা উৎপলের বহু শব্দ আপনি ব্যবহার করতে পারবেন না। এই শব্দগুলোর মধ্যে ব্লাক ডার্ক ফোর্স আছে। অপর কবিদের কবিতায় এই কয়েনেজগুলো ব্যবহৃত হলে তা মমির অভিশাপের মত ধ্বংস করে দিবে সেই কবিতার কাব্যশক্তি। পিরামিডের পাথরে অভিশাপ থাকে। সচেতন লেখক এই  ম্যাজিকগুলোকে সচেতনভাবে এড়িয়ে চলে। সেইটাই নতুন শিল্প গড়ার থামস রুল। এ কারণে কয়েনেগুলোর ব্যবহার কম অপর কবিদের কবিতায়। মহৎ কবির নিজস্ব বারকোড সাটা বাজওয়ার্ডগুলো বহুদিন চলমান কবিতায় ব্যবহৃত না হতে হতে কোনও এক জেনারেশনে গিয়ে শিল্পিত-শব্দ-সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলতে পারে। জীবনানন্দের বেতফল অন্য কবির কবিতায় কেউই দেখতে চাইবে না। ফলে প্রতিষ্ঠিত কয়েনেজ শব্দগুলোর এক রকম মৃত্যুই ঘটে মহৎ কবিদের হাতে। এই শব্দগুলো পরবর্তী প্রজন্মের কেউ আর হাত দিতে সাহস পায় না। এইটাই হলো পয়েটিক ডিকশনের ফাঁদ। অব্যবহৃত হতে হতে একদিন এই শব্দগুলো অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে সময়ের প্রেক্ষিতে। যতদিন না সেই মহৎ কবির শিল্প ধ্বংস হচ্ছে ততদিন এই শব্দেরা বন্দি। মহৎ কবির ব্যবহৃত শব্দমালা, ইমেজ, ক্ষেত্র বিশেষে বলার ভঙ্গিকেও খুব স্থূলভাবে কয়েনেজই। সূক্ষ্মভাবে এগুলোর ভিন্ন ভিন্ন নাম দেয়া যেতে পারে। তবে সে রাস্তায় আপাতত যাচ্ছি না। এই কয়েনেজ বা বাজওর্য়াড বিষয়ে বলার আগে অন্য বিষয়ে একটু হাঁটা দরকার।

তিন.
আমরা যখন পড়ি তখন সেই লেখার ইন্টারপিটেশন আসলে তিন ভাবে হয়। হয় আপনি বিষয়টা দেখবেন, না হয় শুনতে পাবেন অথবা আপনি অনুভব করবেন। মনে হতেই পারে, হাওয়াটা ত্বকের উপর দিয়ে ভেসে গেল এইমাত্র। পাঠকের জীবনের অভিজ্ঞতা, তার গড়ে ওঠা রুচি ঠিক করে দেয় তিনি কীভাবে লেখাটা পড়ে আত্মস্থ করবেন। কানে, চোখে, না মগজে তিনি লেখাটা উপলব্ধি করবেন তা একটা নিয়নি নির্ভর বিষয়। নিয়তি নির্ভর কেননা লেখা ইন্টারপিটেশন করার পদ্ধতি পাঠক নির্বাচন করতে পারে না। এখানে পাঠকের নিজের তেমন কিছু করার নেই। লেখাটাকে ইমেজ হিসাবে দেখবে, না কী শব্দের মত লেখাটা তার কানে বাজবে, না কী তিনি অনুভব করবেন এ সবই তার ছোটবেলার স্মৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মানুষের কোর মেমরি গড়ে ওঠে নানা রকম অভিজ্ঞতা দিয়ে। সেই কোর মেমরি তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন ছোটবেলায় যাদের আনন্দের স্মৃতি বেশি তারা বড়বেলায় সুখি মানুষ হবার সম্ভাবনা বেশি লাভ করে। কিছুটা এমন বিষয়টা। সেই জন্য আমাদের পাঠকরা তাদের ছোটবেলায় কী পড়েছেন কবিতার নামে তা একটু দেখে নেয়া দরবার। শিশুপাঠ্যের অধিকাংশ কবিতাই (ছড়া কবিতা প্রবেশদ্বার) প্রথমত নীতি শিক্ষায় কঠোর, গল্পে মজারু এবং শেষতক বর্ণ গন্ধে রঙিন এবং অন্তমিলের দোলায় দুলদুল। এই হলো আমাদের পাঠকের কোর মেমরি। একবার চোখ বন্ধ করুন আমার পাঠক। আপনার ছেলেবেলাটা দেখে নিন, স্মৃতির মধ্যে হানা দিন, আপনকে জানুন। তারপর আসুন আপনার বড়বেলায়। যে কোনও দেখা পড়ার সময় আপনি লেখাটাকে আসলে কীভাবে আত্মস্থ করেন ভেবে দেখুন। আপনি যা পড়েন তা কি আপনি দেখতে পান? না কি শব্দগুলো কানের কাছে কথা বলে? আমার হিসাবে আমদের যে শিশুশিক্ষা সিলেবাস সেই হিসাবে আপনার অধিকাংশ লেখা দেখতে পারার কথা। লেখার শব্দগুলো আপনার সামনে তার প্রকৃত রূপ নিয়ে জেগে ওঠে। ‘বটগাছ’ বললে আপনার স্মৃতিতে থাকা উজ্জ্বল বটগাছটি মগজের মাটি ভেদ করে দাঁড়িয়ে যায় চোখের সামনে। আমাদের অধিকাংশ পাঠকের ইমেজ সিস্টেম খুব সচল শিশুশিক্ষার প্রকরণের কারণে। লেখার ভেতর একটা গল্প ও নীতি শিক্ষামূলক ব্যাপর থাকলে আমাদের ভালো লাগে। কবিতা বলতে ছড়ার মত অন্তমিল থাকা চাই। বোদ্ধাদের কথা অবশ্য আলাদা এবং তাদের আলাদাই রাখলাম। ব্যক্তিগত পঠন পাঠন ও সচেতনতা দিয়ে তারা বদলে নিয়েছে তাদের অবচেতন। তবে অধিকাংশ যারা ঘরে প্রবেশ না করে শুধু ঘরের দরজা দেখেছে তাদের কাছে দরজা মানেই ঘর। অন্তমিল, ছন্দ মানেই কবিতার পূর্বশর্ত।

প্রাথমিক কবিতার জ্ঞানটা জানা জরুরি এই সময়ের কবিতার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন তা বোঝার জন্য। অধিকাংশ শিশুশিক্ষার সিলেবাস যেহেতু মোটামুটি এক সেহেতু আমাদের জনরুচিও সো ফার একই কবিতা বিষয়ে। কবিতা নামক যে হাতি তা আমারা সবাই মিলে একই রকম দেখি। সেই কারণে কবিতায় ইমেজ থাকলে আমরা সহজে দেখি ও আমাদের ভালো লাগে। যে কবিতায় গল্প থাকে, এবং সেই গল্পের আলোকে একটা পজেটিভ নৈতিক সমাপ্তি থাকে সেই কবিতা আমাদের পাঠক ভালোবাসে। এইটাই এই জাতির কবিতার স্পিরিট। এই কারণে জীবনানন্দের ইমেজ যত পাঠক সহজেই নিতে পারে, বুঝতে পারে, দেখতে পারে, তার অনুভূতির সূক্ষ্ম জায়গা ছোঁয়ার সক্ষমতা কতজন পাঠকের আছে। আব্দুল মান্নান সৈয়দের মতো মননশীল কয়জনই বা আছে অবশেষ। জীবনানন্দ পাঠক নন্দিত ইমেজ এবং গল্পের কারণে। শিল্পের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার কারণে যেহেতু দেহের অন্যান্য প্রত্যঙ্গের চেয়ে চোখের ক্ষমতা আমাদের বেশি সেই কারণে জীবনানন্দ ব্যাপক জনপ্রিয় হয় এ সমাজে। কারণ তার কবিতা দেখা যায়, গল্পটা শোনা যায়। বনলতা সেন, সমারূঢ়, আট বছর আগের একদিন, কমলালেবু ইত্যাদির মধ্যে গল্পের একটা চরিত্র পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ কবিতায় বাংলা ভাষার ঈশপ, নীতি শিক্ষায় ভরা। বাংলা কবিতায় উজ্জ্বল কবি মাত্রই কোনও না কোনোভাবে এ সমস্তের ঘোরাটোপে আক্রান্ত। কবি লালন ভাবুক, দিক নির্দেশক। নীতি শিক্ষা, গল্প, দৃশ্য সৃষ্টির প্রবণতা এই সব বাংলা কবিতার  নেতিবাচক  কোন বিষয় না। এইটাই আামদের কবিতার ইতিহাস, আবহমানতা, ট্রেন্ড। তবে বিষয়গুলো চিহ্নিত করা জরুরি। কবি হিসাবে আপনি কী লিখতে চান। আবহমান বাংলা কবিতা লিখতে চাইলে শিক্ষা, ছবি আর গল্পের মধ্যে থাকুন। বড় কবির কাতারে আপনার স্থান হবে। আর যদি ভাবেন নতুন কিছু লিখতে চান তবে আপনাকে ভাবতে হবে আরও কিছু, এর বাইরে।

আমি সবার জন্য কমন শিক্ষা ব্যবস্থার বিপক্ষে। সবাই, সব শিশু একই বই পড়বে কেন? তারা নতুন চিন্তা ছবি কীভাবে দেখবে? নানা শিক্ষা ব্যবস্থার মানুষের জন্য সমান অধিকার ও সুযোগ তৈরি করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। সেই রাষ্ট্রের কর্তব্য রাষ্ট্রকে না বুঝিয়ে একরকম শিক্ষা ব্যবস্থা একটা অবান্তর ব্যবস্থা যে কোনও দেশের জন্য। ইংরেজি মিডিয়াম, মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা বহাল থাক। সমাজে চিন্তা ও চিন্তা ইন্টারপিটিশন করার বৈচিত্র্য জরুরি। লক্ষ্য করে দেখবেন মাদ্রাসা ফেরত কবিদের লেখা ও জেনারেল লাইনে পড়া লেখকদের লেখার মধ্যে বিস্তর তফাত। কারণ কী? শিশুশিক্ষা ছাড়া আবার কী!

চার.
কয়েনেজ বা বাজওর্য়াড একটা সামগ্রিক বিষয়। কয়েনেজ গুধু মাত্র বিশেষ কিছু শব্দ দিয়ে গড়ে ওঠে না। কয়েনেজ একাধিক শব্দের মিলনে গড়ে ওঠা শব্দগুচ্ছ বা কোনও ইমেজ, হতে পারে ক্ষেত্র বিশেষে এমনকি বাক্য। যে সমস্ত ইঙ্গিত লেখকের লেখাকে আলাদা করে ফেলে অপরের লেখা থেকে তাই কয়েনেজ, বাজওয়ার্ড। জীবনানন্দের ক্ষেত্রে যেমন উটের গ্রীবা বা বেতফল হলো বাজওয়ার্ড। একইভাবে উৎপলের জন্য বিশেষ ইমজে বা শব্দ কয়েনেজ না হয়ে তার লেখার সিনট্যাক্সইহয়ে ওঠে কয়েনেজ। কবির সিগনেচার বললে হয়তো আরও সহজ হয় বুঝতে। কবির সিগনেচার হিরকখণ্ডের মতো চির উজ্জ্বল অন্ধকারেও দেখা যায়। যারা কবিতায় এই সিগনেচার তৈরি করতে পারে তারাই মাত্র মহৎ কবি। অপরের সিগনেচার নকল খুব সহজেই ধরা যায়। ফলে মহৎ কবিরা তাদের কবিতা, শব্দ, ভাষা ভঙ্গি পুনঃউৎপাদনের সব রাস্তাই বন্ধ করে দেন। পরবর্তী প্রজন্ম তার তৈরিকৃত ডিকশনটাকে এড়িয়ে যায়। ফলে মহৎ কবিরা অনুগামীহীন, নিঃসঙ্গ। কবিতার মধ্যে বড় কবিরা দুটো জিনিস ব্যবহার করেন। এক, তাদের সিগনেচান; দুই, শিল্পিত-শব্দ-সুন্দর শব্দ বা শব্দহিরক। সিগনেচার বদ্ধ কবির ডিকশন দ্বারা, শব্দহিরক উন্মুক্ত যৌথ চেতনার দ্বারা। একজনের সিগনেচার আরেকজন তার কবিতায় ব্যবহার করতে পারে না। তবে নানা কবির কবিতায় দীর্ঘ দিনের ব্যবহারে যে শব্দগুলো একটু বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সে সমস্ত শব্দ কবিতায় ব্যবহার করলে কবিতা অনেক বেশি শিল্প সুন্দর গয়ে ওঠে। তবে শিল্প সুন্দর লেখা মানেই কবিতা না। সিগনেচার কাব্যে যত বেশি ব্যবহার করা যায় ততই কবিতা দীর্ঘায়ু পাবে ও পায়। তবে কবিতার অমরত্ব নেই। কেননা সে সজীব প্রাণ। জয়ের কবিতায় বাজওয়ার্ড, কয়েনেজ বা সিগনেচার কম। কিন্তু চিরন্তন বহু শব্দাহিরক আছে তার কবিতায়। ফলে জয়ের যাত্রা বহু দূর। তার যে কোনও লেখাই কবিতা হয়ে ওঠে। তাকে বোঝার জন্য পাঠককে কসরৎ করতে হয় না। চাঁদ, হাওয়া, বৃষ্টি, ফুল এসব ছাড়া কবিতা লিখেছে কে? বিনয়ের চাঁদ অভিনব, জয়ের চাঁদ বিস্ময়কর। এইভাবে বহু ব্যবহৃত শব্দের অর্থ ও সৌন্দর্যের নতুন নতুন বিকাশ, উদ্ভাসন হয় বড় কবিদের লেখায়। শুধু শব্দ, পদ্ধতি, কৌশল দিয়ে কবিতায় আলাদা হওয়া যায় না। অবহমান শব্দহিরক দিয়ে যখন নতুন অপডেটেড জীবনের ভার্সনটা পাঠ করা যায় তখনই নতুন ভাষার জন্ম হয়, নতুর সিগনেচারের আভাস মেলে।

পাচঁ.
মহৎ কবির সৃষ্ট কয়েনেজের ফাঁদে আটকে যেতে দেখা যায় অনেক নবীশ কবিকে। লিখতে গেলে উৎপল, জীবনান্দের আবিষ্কৃত শব্দ বা তাদের লিখন ভঙ্গিমা, তাদের সময়, পাঠ্যাভাস অশরীর মতো লেখার মধ্যে ঢুকে পরে, তারপর লেখাটিকে ক্ষণআয়ু আর লেখককে শক্তিহীন জীবন দিয়ে চলে যায়। সোজা কথায় অপরের প্রভাব থেকে মুক্তির উপায় কি? আমরা কেন অপরকে দিয়ে প্রভাবিত হই এই প্রশ্নের উত্তরই এর সমাধান। এর প্রথম কারণ আমরা সবাই ভালো লিখতে চাই। চাওয়াটা যৌক্তিক। কবিতা বা শিল্প করতে এসে আপনার ভালো লিখতে বা আঁকার তাগিদ থাকা স্বাভাবিক। সমাজ আপনাকে শ্রেষ্ট হবার ইঙ্গিত দিবে। এখন সমকালীন সমাজে ভালোর স্ট্রান্ডার্ড কেমন? কোনও বিষয়গুলোকে সমাজ স্বীকৃত? কবিতা লিখতে এসেই আপনি সমাজের তৈরিকৃত কবিতার একটা মান পাবেন। কয়েনেজগুলো আর সিগনেচারগুলোই হলো কবিতা পরিমিতির স্কেল, ছাঁচ। সেই ছাঁচের ভিতরেই আমরা লিখে ফেলতে চাই নিজের কবিতা। কিন্তু আসলে নিজের নামে উৎপলের বা জয়ের বা বিনয়ের কবিতাটাই লিখতে থাকি আমরা। আমাদের জীবনের যে হিরো, আমরা যা হতে চাই প্রবল ভাবে তাই আমাদের ‘আমি’ হতে দেয় না। ভালো লিখতে চাওয়ার চাপ আমাদের পথভ্রষ্ট করে। নতুন কবিতা লেখার প্রথম শর্তই রিস্ক নেয়া, ট্রেডিশনাল ট্রেন্ডি কবিতা না লেখা। খারাপ কবিতা লেখার মত সাহস ক’জনের আছে! জীবনানন্দ তার সমকালের সবচেয়ে খারাপ কবিতাটাই লিখেছে সেই কালের বাংলা কবিতা স্টান্ডার্ডে। হিরো হত্যার মধ্য দিয়েই শুরু হয় নতুন কবিতার ভিলেনের যাত্রা। ভালো কবিতা প্রত্যাশা ত্যাগ করুণ, লিখে যান। না হলো নাই। এই সাহস না থাকলে নতুন কবিতা লিখতে আসার দরকার কী! জীবনানন্দতো ইউরোপীয় মান কবিতার স্টান্ডার্ডে কবিতা লিখেছেন বাংলায়। ইংরেজিতে তার এই সব কবিতা এভারেজ স্টান্ডার্ড। ইংরেজি কবিতার আবহমানতার আলোকে জীবনানন্দ টি.এস. এলিয়ট থেকে নিম্নমানের তো হবেনই। উৎপল র‌্যাঁবো থেকে ছোট কবি ইউরো মান মন্দিরের সাপেক্ষে। মানব ইন্দ্রিয় চেতনার দৃশ্যাবলি জীবনানন্দই প্রথম লিখেছেন বাংলা কবিতায়। বাংলায় ফরাসী কবিতার জন্মদাতা গুরু ও পিতা উৎপল। এটা কি  দোষের কিছু? না, এটা দোষের কিছু না। শিল্প মৌলিক কোনও বিষয় নয়। ফলে ইউরোপিয় কবিদের সরাসরি অনুকরণ না করে জীবনানন্দ ও উৎপল তাদের কাছ থেকে ইন্সপাইরেশন নিয়ে রচনা করেছেন বাংলা কবিতা। এই কাজের ফাস্ট হ্যান্ড কপিয়ার হলো তারা। কিন্তু জীবনবাবু ও উৎপল শিক্ষায় শিক্ষিতরা তাদের মতো লিখলে যা দাঁড়ায় তা হলো নকলের নকল। যোদ্ধা জাহাঙ্গীরের জাঙিয়া না পরার মতো ব্যাপার।

যার কাছে আপনি বারবার পরাজিত হন, সেই বিজয়ী মানুষটাই আপনি হতে চান। যে সর্বশক্তিশালী মানুষটাকে আপনি ঘৃণা করেন, দিন শেষে আপনি সেই লোকটাই হতে চান অবচেতনে। জৈবসত্য হলো মানুষ এমনই। তাই খুব সচেতন ভাবে আপনি যাকে এড়াতে চান, অবচেতনে সেই ঘোরগ্রস্থ আপনাকে লেখার টেবিলে সাহস যোগাবে। এর নামই ইন্সপাইরেশন। আপনি ঠিক সে না, তবে তার মতো ভালো লেখাটাই লিখতে চান, তার মতো হতে চান শিল্পে। এই অবচেতনকে এড়ানোর একমাত্র উপায় হলো সচেতন থাকা।
নতুন কবিতার শর্তই হলো সচেতন থাকা। আর নিজের সময়টাকে লেখা।