খাবনামা

অমিতাভ পাল

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৩, ২০১৮

কোনও বস্তুকে চেনার একমাত্র উপায় বস্তুটির সংজ্ঞা জানা। সংজ্ঞার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে বস্তুটির বৈশিষ্ট্য, চরিত্র এবং যাবতীয় গুণাগুণ। ধরা যাক জলের কথা। এই বস্তুটির সংজ্ঞার মধ্যেই লুকিয়ে আছে এর সব খবর। ভিন্ন চরিত্রের দুই অণু হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনের প্রেমের ফসল এই জল। ভিন্ন তাপমাত্রায় এর চেহারা ভিন্ন হয়ে যায়। এখন এই সংজ্ঞা জানার পরে পৃথিবীর যতো গোপনীয়তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকুক না কেন, জলকে খুঁজে পাওয়া মোটেই কঠিন হবে না কারো জন্য। সংজ্ঞার মাহাত্ম এই। অর্থাৎ সংজ্ঞা মহৎ। অথবা মহোত্তমও বলা যায়। কেননা সেইতো সবকিছু নির্দেশ করে। বুঝিয়ে দেয় সকল মন্ত্রের সমস্ত নিগূঢ় অর্থ।

কবিতাও আসলে সংজ্ঞাই। সেও চায় তার লিপ্ততার বিষয় বা অনুভব কিংবা খননকে বুঝিয়ে দিতে। কিংবা অস্পষ্ট বা রহস্যময়তাকে স্পষ্ট করে তুলতে। দৃশ্যের ভিতরে সে গুঁজে দেয় টীকা, স্বপ্নের ভিতরে খাবনামা। আর এরজন্যই সংজ্ঞা আর কবিতা পরস্পরের হাত ধরে হাঁটে।

পৃথিবীর সব বইকেই আমার সংজ্ঞা কিংবা কবিতার বই বলে মনে হয়। এরা দল বেঁধে আমাদের সব জটিলতা, ধোঁয়াশা আর অপ্রবেশ্যতাকে স্পষ্ট করতে কোমর কষে মাঠে নেমেছে। তাই স্টিফেন হকিংয়ের `এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম` আর জীবনানন্দের `মহাপৃথিবী`কে একই গাত্রভুক্ত ভাবতে আমাকে খুব কষ্ট করতে হয় না। সংজ্ঞা কিংবা কবিতাই এই গোত্রভুক্তিকে সংজ্ঞায়িত করে, কবিতা বানায়। এবং এই সংজ্ঞা কিংবা কবিতা এক বিপদজনক মানদণ্ডেরও জন্ম দেয়। বইকে বই হিসাবে চিনতে পারাই এই মানদণ্ডের বৈশিষ্ট। অর্থাৎ কম্পিঊটার কম্পোজ, অফসেট মেশিন এবং বাঁধাইকরের দোকান পেরিয়ে এলেই কোনোকিছু বই হয়ে ওঠে না। বরং সে সংজ্ঞার জন্ম দিতে পারলো কিনা, সেটাই শেষপর্যন্ত প্রধান বিবেচ্য। আজ যদি কোনো কারণে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয় মানুষকে, তাহলে মহাশূন্যযানে ওঠার সময় সঙ্গে সে কিন্তু বইই নেবে। এখন ভাবুন, বই আসলে কী!

বই আসলে তাই, যার প্রত্যেক পৃষ্ঠায় স্পষ্টতার মুখোশহীন চেহারা আঁকা থাকে। আর রহস্য যেটুকু, সেটা আসলে প্রচলিতের বাইরে গিয়ে কোনও বিষয়কে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াসমাত্র। তাতে আমরা যারা প্রচলিতের বাইরে পা ফেলতে পারি না, তারাই সমস্যায় পড়ি। কিন্তু যদি ভাবনার গুমঘরের স্কাইলাইটসহ জানালাগুলিকে খুলে দেই, যদি বাতাসের ঝাড়ু দিয়ে সরিয়ে ফেলি জমে থাকা সব জঞ্জাল, তবে নিশ্চিত রহস্যও স্পষ্ট হয়ে যাবে। তবে তাতে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা হবে সেটা হলো, কৃত্রিম শান্তির জোঁকের মুখে পড়বে লবণের ঝাপটা। আমরা নড়বড়ে হয়ে পড়বো। আর ব্যাংক লোন নিয়ে ফ্ল্যাট কেনার ধান্ধায় ব্যস্ত কারুর জন্য এই নড়বড়ে ভাবতো মহা বিপদের। ফ্ল্যাট কিনে ফেলা আর কিনতে চাওয়া লোকগুলিকে দেখলে আমার হাসন রাজার সেই গানটা মনে পড়ে, `কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার`। কিন্তু পুঁজি আমাকে এই গান গাইতে দিলে তো! (এইখানে গোপনে একটা কথা বলি, লালনের চেয়ে হাসনকে আমার বেশি ভালো লাগে)।

সংজ্ঞা অনেকটা ডিকশনারির মতো। জ্ঞানের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে সেও এগিয়ে যায় যথার্থতার আরেকটু কাছে, আরেক এডিশনে। তার কোষপ্রাচীর সচ্ছিদ্র, গ্রহণ বর্জনে ক্লান্তিহীন। অভিযোজনে সক্ষম এক জীবিত সত্ত্বা এই সংজ্ঞা। ফলে সে বংশবৃদ্ধি করে এবং প্রজন্মান্তরে জটিলতর হয়ে ওঠে সরলতার আপাত চেহারায়। যেকোনো সংজ্ঞাকে মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে দেখলেই এর সরল চামড়ার নিচের জটিল দৈহিক গঠন চোখে পড়বে।

সংজ্ঞা শব্দটার মধ্যে কেমন যেন একটা রিজিডিটি আছে। এরচেয়ে ইংরেজি ডেফিনিশন শব্দটা অনেক বেশি আন্তরিক ও কোমল। কিন্তু বাইরের চেহারা দেখে আমাদের নিজেদের শব্দটাকে ভুল বুঝলে ভুলই করা হবে। এই শব্দটা যেন পুরানো দিনের হেডমাস্টারদের মতো, বাইরে কঠোর আর ভিতরে ছাত্র অন্তপ্রাণ। আবার বরফে ঢাকা পাহাড়ও বলা যায়, এই পাহাড়ের নিম্নভাগে শক্ত বরফ এবং যতো ওপরে ওঠা যায়, নরম তুষারের স্তূপ। সাম্প্রতিকতাই এই নম্রতার জন্য দায়ী, নতুন বরফের পতনজনিত নম্রতা। সংজ্ঞাও তার সর্বসাম্প্রতিক চেহারায় সবচেয়ে নরম কেননা, সাম্প্রতিকতাতেই তো নতুন তথ্য যুক্ত হয়, সংজ্ঞার পরিধি বাড়ে। ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে এটাকে সংজ্ঞার ইলাস্টিসিটিও বলা যায়। নতুন কবিতারও কিন্তু এইরকম ইলাস্টিসিটি থাকে। তারপর অভিজ্ঞতার পলির চাপে সে শক্ত হয় পুরানো চরের মতো।

সংজ্ঞা মানুষের এগিয়ে যাওয়ার সহায়তায় ব্যস্ত একটা মানচিত্রের মতো। বহু অভিজ্ঞতা আর বহু ঊপলব্ধি জমে থাকে এর রেখায় রেখায়। আর যখনই দরকার হয়, তখনই সে খুলে দেয় তার রেখার জিপার এবং আমরা নিজেদের প্রয়োজন মতো সেখান থেকে ঊঠিয়ে নেই যা দরকার তাই। পাশাপাশি আমাদেরও সম্মুখ যাত্রায় পাওয়া অভিজ্ঞতার সার সে ঢুকিয়ে রাখে তার রেখার ব্যাগে।

শেষ পর্যন্ত সংজ্ঞাকে আমাদের জ্ঞানের ভল্ট বললেও অত্যুক্তি হয় না। যেন একটা মাইক্রোফিল্ম বা চিপ যাকে খুলে পড়ে আমরা জানতে পারি। কবিতাও কি তাই না? প্রত্যেকটা কবিতা তার সময়ের কাছ থেকে পাওয়া জিনিসপত্রের সংকলনই তো। পৃথিবীর পাকেচক্রে আমরা কতটুকু এলাম, কবিতার চেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যা আর কে করতে পারে?

এই একটা জায়গায় কবিতা আর সংজ্ঞা স্পষ্টতই জমজ।

 

লেখক: কবি