অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম

অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম

খিদে ও তৃষ্ণা

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৭, ২০১৭

আম্মু আম্মু, আমি এখন কি খাব?
আড়াই বছরের দুটো পায়ে গুটিগুটি দৌড়ে এলো ছায়াবীথি। খেলছিল, ধুলো, লতাপাতা আর ঘাসফুল দিয়ে।
রিপা কাঁদছে।
ছায়াবীথি থমকালো। এরপর ঝাপ দিল মায়ের বুকে। তুলতুলে আঙুলে থুতনি ধরে বলল, আম্মু আম্মু, কাঁদে না।
রিপার ভেতর অন্ধকার। আলোর কোনও ইশারাও সে আর খুঁজে পাচ্ছে না কোথাও। তবে কি অনিশ্চয়তাই মানুষের নিয়তি? রিপা তা জানে না। কেবল বুঝতে পারে, এই সংসারের কোথাও আর কোনও নিশ্চয়তা নেই।
ছায়াবীথির খিদে পেয়েছে। ঘরে খাবার কিছু নেই। ছায়াবীথি এখন কাঁদছে না। আম্মু কাঁদছে। আর সে বলছে, কাঁদে না... কাঁদে না। ছায়াবীথি আম্মুর থুতনি ধরে মুখের কাছে মুখ এনে বলছে, কাঁদে না... কাঁদে না...
এই কথা শুনে রিপা আরও জোরে কেঁদে ওঠে।
ছায়াবীথি তার ফুলের মতো ¯িœগ্ধ আঙুল দিয়ে রিপার এক দুধ ধরে বলল, দুদ খাও আম্মু, কাঁদে না।
আধফোটা এই বোল রিপা খাতুনের ভেতর ভেঙেচুরে দ্যায়। ছায়াবীথি ভাবছে, তার মতো আম্মুরও বুঝি খিদে পেয়েছে। আম্মুকে তাই সে দুধ খেতে পরামর্শ দিচ্ছে।
খিদে! খিদে! খিদে!
চারদিক হাহাকার হয়ে ওঠে।
দুদ খাও, কাঁদে না... বলতে বলতে ছায়াবীথি আম্মুর গলা ধরে চুমু দিল গালে। রিপাও দুহাতে ছায়াবীথির মুখ ধরল। এরপর বুকের ভেতর নিয়ে দুধ বের করে দিল ওর মুখে। দুধ আর তেমন পায় না। তবু চাটে, সান্ত¦না।
সন্ধের ছাইরঙ ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিক। বাড়ির পাশে ঝোপঝাড়ের ওদিকে পাখিদের ছুটোছুটি, আর ডাকাডাকি। মাথার ওপর তারাগুলো জ্বলে উঠেছে। ঘরের বাতি জ্বালতে উঠল রিপা চৌকাঠ ছেড়ে। কান্না শুরু করল ছায়াবীথি। দুদ্দে... দুদ্দে...
বাতি জ্বেলে ঘর ঝাঁট দিতে থাকে রিপা। ছায়াবীথি পায়ে পায়ে ঘুরছে আর কাঁদছে। ধমকাল রিপা, চোপ! এখন না, তনিমাদের বাসায় যাব। তখন আমারে খাস। চাটতে চাটতে জানডা বের করে দিস। এখন একটু রক্ষে দে।
ছায়াবীথি কাঁদে, দুদ্দে... দুদ্দে...
রিপা বকবক করে।
ঝাঁট দেয়া শেষ হলে দরজায় ছিটকিনি তুলে রিপা কোলে তুলে নেয় ছায়াবীথিকে। উঠোন পেরিয়ে তনিমাদের উঠোনে আসে। টিউবঅয়েলে আমি হাত-পা ধুচ্ছিলাম। এগিয়ে এলাম, আয় তো মা, দেখি আজ চাঁদ উঠল কীনা। হাত ঝাড়া দিয়ে আমি কোলে তুলে নিতে গেলাম আমার জননীকে, কিন্তু সে এলো না। মাথা গুঁজল আম্মুর কাঁধে।
রিপা বলল, ছাড়ো তো, তনিমাকে পড়াব।
ঘরে ঢুকল রিপা। পেছনে আমি। পাশাপাশি দুই ভাইয়ের সংসার। ভাইয়ের মেয়েকে প্রাইভেট পড়ায় রিপা। বইখাতা ছড়িয়ে মেঝেতে তনিমাকে নিয়ে রিপা বসল। টিভি ছেড়ে আমি খাটে এসে বসলাম। কলকাতার বাংলা সিনেমা দেখাচ্ছে। মারামারির দৃশ্য। চলছে তো চলছেই। মাইর আর শেষ হয় না।
ছায়াবীথির দু’হাত নিয়ে খেলতে খেলতে জিগেশ করলাম, ভাবি কই হে বধূ?
বাপের বাড়ি গেছে। ওই যে, ওনার বোনেরা আইছে। পোলাও-মাংস রান্না করে নিয়ে গেল।
টেবিলের দিকে চেয়ে দেখলাম, এক গামলা পোলাও প্লাস্টিকের জালি দিয়ে ঢাকা। চামচ রাখায় জালি বেশ খানিকটে ফাঁক হয়ে আছে। বললাম, গামলায় তো টিকটিকি ঢুকবে। তেলাপোকাও ঢুকতে পারে। ওইভাবে রাখছে কে?
রিপা বলল, যার তা সে-ই রাখছে। আমি আবার ঠিক করতি গেলি...
বুঝতে পারলাম রিপার কথা। ভাবির চরিত্র খবিস টাইপের। চোখের সামনে একটা ছবি দেখতে পেলাম। গতরাতে ঘ্যানঘ্যান করছে, আর কাঁদছে ছায়াবীথি। রিপা ওকে কোলে নিয়ে চাঁদ-টাদ দেখিয়ে ভোলানোর চেষ্টা করছে। আর এদিকের উঠোনে সিঁড়িতে বসে ভাবি মাংস দিয়ে ভাত খাচ্ছে।
ছায়াবীথি ঘ্যানঘ্যান করছে আর বলছে, আম্মু আম্মু আমি এখন কি খাব?
রিপা বলছে, দ্যাখ দ্যাখ বাবুনি, চাঁদের বুড়ি তোর জন্য লাল টুকটুকে একটা জামা পাঠিয়ে দেবে... চাঁদের বুড়ির বয়েস কত জানিস? এই পাঁচশো কুড়ি...
আম্মু আম্মু আমি এখন কী খাব?
স্থির হয়ে আমি বসে আছি তনিমাদের উঠোনে, আমগাছের নিচে। শুনতে পেলাম, ভাত খেতে খেতে ভাবি বলছে, অল্পতেও চোখ ভরে না, বেশি নিলিও খাইতে পারি না। খাবি নাকি রে ছায়াবীথি, আয়...
ছায়াবীথি ছটফট করে ওঠে। বলে, আম্মা ডাকে। আমি খাব।
তনিমার মাকে ছায়াবীথি আম্মা ডাকে। রিপা তাকালো আমার মুখের দিকে। আমি ঘাড় হেলালাম। রিপা নামিয়ে দিল ছায়াবীথিকে। গুটিগুটি পায়ে ছায়াবীথি উঠোন পেরিয়ে গেল।
রাতে শিরশির হাওয়া বইতে লাগল। আর গোলগাল চাঁদ উঠল বাঁশবাগানের মাথার ওপর। ছায়াবীথি খাটে ঘুমোচ্ছে। ঘরের ও বাইরের বাতি নেভানো। চাঁদের থই থই আলো উঠোনে। হাঁ করে খুলে রাখা দরজা। চৌকাঠের ওপর মাথা রেখে চিৎ হয়ে রিপা শুয়ে আছে। ওর বুকের ওপর শুয়ে আছি আমি। চাঁদের মতোই গোলগাল মুখ রিপা খাতুনের। ঘন আর পুরু কালো ভুরু। যেন ভুরু পল্লবে সে প্রেমিককে ডেকে নেবে, আর কোনো ইশারা তার দরকার হবে না।
পুরুষ্টু ঠোঁট রিপা খাতুনের। আর কী চকচকে মুখের ত্বক। মসৃণ। সে হাসছে। চাঁদের নরম ¯িœগ্ধ আলো এসে পড়েছে তার খোলা দেহের আধেক জুড়ে। আমি চেয়ে আছি। মুগ্ধতার আনন্দে ঝিরঝির কাঁপছে আমার দেহ। আর ঠিক তখনই চমকে উঠলাম। এই তো সেই মুখ। এই তো সে সুন্দর। যার জন্য হাসতে হাসতে খুন হয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু খুন হতে না পারার যন্ত্রণায় আমি কুঁকড়ে যেতে থাকি। গুটিয়ে যেতে থাকি নিজের ভেতর। বিস্মৃতির ভেতর থেকে উঠে আসতে থাকে স্মৃতি। যেন ধারালো এক একটি চাকু।
খুন হতে হতে এখন আর আমি খুন হই না। তবে খুন আমি হয়ে যেতে চাই। আমি জানি, এতদিনে জেনে ফেলেছি, খুন হয়ে যাওয়া, নয়তো খুনি হওয়া ছাড়া মানুষের আর কোনও ভবিতব্য নেই।
বুকের ভেতর থেকে আমি ডাক দিই, রিপা খাতুন?
বুকের ভেতর থেকে রিপা জবাব দ্যায়, উুঁ।
বাইরে চাঁদ। আর তুমি। আর রাত। আর নির্জনতা। আমাদের এই ঘর। জানো, এ রকম কোনো দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়েই আমি খুন হয়ে যেতে চেয়েছিলাম।
রিপা খাতুন খিলখিল হেসে ওঠে। এরপর দু’হাত বাড়িয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরে। বলে, বেশ তো। তবে খুন হয়ে যাও। এসো, আমি তোমাকে খুন করব। তুমি আমাকে খুন করতে পারবে না।
আমার দেহের ভেতর লুকনো চাকু আছে। সেটা দিয়ে তোমাকে খুন করব, এসো।
চেয়ে দেখি রিপা খাতুনের গোলগাল মুখ। হাসছে সে। কিন্তু আমি মুগ্ধ হচ্ছি না। আমাকে মুগ্ধ করছে উঠোনজুড়ে থই থই চাঁদের আলো। আমি বললাম, তোমার দেহ ছাড়া আর কিছুই নেই রিপা খাতুন। একটা দেহ... একটা খোলস...
একথা বলে আমি শুয়ে পড়লাম রিপা খাতুনের নগ্ন দেহের ওপর। ভরাট বুকের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম। আমার ভাবনার ভেতর বয়ে যায় শব্দের নদী...
আজ এইখানে শীতের মতো প্রেম
শরীর থেকে দিচ্ছে কে উত্তাপ?
হৃদয় তোমার নিজের কাছেই রাখো
শরীর শুধু বহন করে পাপ।