খুনি কাজলরেখার লোমহর্ষক কাহিনি

মিজানুর রহমান

প্রকাশিত : মে ২৮, ২০১৮

মেয়েটির নাম সাথী। বয়স আট-নয় বছর। অতি দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। বাবা-মা ঠিকমতো তিনবেলা খাবার দিতে পারে না। মেয়েটি একটু ভালো থাকবে এই আশায় তার অভিভাবক ঢাকাশহরে কাজলরেখার বাসায় মাসিক দু’হাজার টাকা বেতনে গৃহপরিচারিকার কাজে দেয়।

কিন্তু সাথির ঢাকায় আসাটা হয়ে যায় হিতে বিপরীত। একটু পান থেকে চুন খসলেই তার ওপর চলত অমানুষিক নির্যাতন। তীব্র নির্যাতনে মাঝেমাঝে সে বেহুঁশ হয়ে পড়ত। সর্বশেষ ২৩.৫.২০১৮ তারিখ রাতে খেতে বসে ভাতে চুল পায় কাজলরেখা। সাথীকে চুলের মুঠি ধরে সজোরে ধাক্কা মারে দেয়ালের সাথে।

অসহায় সাথীর মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। আবার আরেক ধাক্কা। সাথী ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে। গৃহকর্ত্রী কাজল মনে করল, সাথী ভান ধরছে। এরপর ছুরি ও স্টিলের স্কেল দিয়ে তার সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। একটি চোখ উপড়ে ফেলে। একপর্যায়ে সাথী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

বড় একটি হাড়িতে সাথীর লাশ ভরে রাখে কাজলরেখা। ঘরের রক্তাক্ত মেঝে ও দেয়াল সারারাত ধরে নিজে পরিষ্কার করে। ভোর হয়। এবার লাশ গুম করার পালা। বাজারে গিয়ে একটি ট্রলিবেগ ও রং কিনে আনে। সাথীর ঘাড় মটকিয়ে ও হাত-পা ভেঙে অনেক কষ্টে ট্রলিবেগে ভরে।

এরপর নিরুপায় হয়ে কাজলরেখা বিষয়টি তার নেশাগ্রস্ত মামা শফিকুলের সাথে শেয়ার করে। দুজনে প্লান করে লাশটি শফিকুল রিকশায় করে আব্দুল্লাহপুর শ্যামলী বাস কাউন্টারে যাত্রীবেশে রেখে আসবে। শফিকুল রিকশায় উঠে ট্রলিবেগ নিয়ে রওয়ানা হয় কিন্তু পথিমধ্যে পড়ে যায় দাক্ষিণখান থানা পুলিশের চেকপোস্ট।

চেকপোস্টে কর্তব্যরত এসআই মেহেদী হাসানের সন্দেহ হয় ট্রলিবেগ দেখে। রিকশা থামাতে বলার সাথে সাথে শফিকুল দৌড় দেয়, সাথে পুলিশও। আটক হয় শফিকুল। বেরিয়ে আসে খুনি কাজলরেখার লোমহর্ষক কাহিনি। এবার কাজলরেখাকে ধরার পালা। মামা শফিকুলকে নিয়ে যাওয়া হয় কাজলের বাসায়, কিন্তু দরজা তালাবন্ধ।

পরে আটক করা হয় কাজলের মাকে। তবে তারা কেউ কাজলের অবস্থান ও খুন সম্পর্কে তথ্য দেয় না। এর মধ্যে পাওয়া যায় কাজলের মোবাইল নম্বর ও ছবি। প্রযুক্তির সহায়তায় তার অবস্থান শনাক্ত হয় টংগীতে। সাথে সাথে আমি, ওসি দক্ষিণখান তপন চন্দ্র সাহা ও ইন্সপেক্টর অপারেশন নুর মোহাম্মদসহ একটি টিম রওয়ানা হই টংগীর উদ্দেশে।

আমরা যাওয়ার আগেই সে আবার চলে যায় গাজীপুর চৌরাস্তা হয়ে মাওনা। আমরাও পিছু নিলাম। কিন্তু কাজল বড়ই চালাক। সে আবার মাওনা হতে চলে আসে রাজেন্দ্রপুর। রাজেন্দ্রপুর নেমে ওঠে কিশোরগঞ্জের বাসে। এরমধ্যে ইফতারের সময় হয়ে গেল, টেরই পেলাম না। ইফতার সেরে নিয়ে আবার রওয়ানা হলাম কিশোরগঞ্জের দিকে।

জানি না সে কোন বাসে উঠেছে। এর মধ্যে তথ্য পেলাম, সে কিশোরগঞ্জের ঘাইটাল বাসস্ট্যান্ডে নামবে। আমরাও অপেক্ষা করতে থাকি। হঠাৎ দেখি, একটি বাস হতে বোরকা পরিহিত এক ভদ্রমহিলা নেমে ফ্লেক্সি লোডের দোকানে গিয়ে ফোনে কথা বলছেন। আমরা কাছে গিয়ে `কাজল রেখা` বলে ডাকতেই সে চমকে ওঠে এবং বলে ওঠে, স্যার আমি কিন্তু সাথিকে মারিনি।

অবশেষে আটক খুনি কাজলরেখা। সে ভাবতেই পারেনি, এত দ্রত গ্রেফতার হবে। মাত্র দশ ঘণ্টায়। অবাক হয়ে সে জিজ্ঞেস করে, সার আপনারা কেমনে বুঝতে পারলেন আমি কিশোরগঞ্জে আসছি? টংগী পার হওয়ার পর আমি পরানে পানি পাইছিলাম যে এইবার আর ধরে কে? আমি তো আমার মোবাইলও বন্ধ করে দিয়েছিলাম!

রাত তখন ১২টা। কাজলরেখাকে আটকের পর অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব করলাম। পরে ভোর ৪টায় আমরা ঢাকায় পৌঁছাই। সাথীর দরিদ্র পিতার বুকফাটা আর্তনাদ এখনো কানে বাজে। আনন্দের বিষয়, আজকে খুনি কাজলরেখা ও তার মা আদালতে তাদের দোষ স্বীকার করে ঘটনার লোমহর্ষক জবানবন্দি দিয়েছে। সাথী হত্যার বিচার নিশ্চিত করতে আমরা আমাদের সামর্থ্যের সবটুকু উজাড় করে কাজ করেছি।

সাথী তুমি শান্তিতে ঘুমাও, ফেরেশতা হয়ে থেকো।

লেখক: সহকারী কমিশনার দক্ষিণখান থানা জোন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ