গুরু

মুহম্মদ আব্দুল কাইয়ূম

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৮

১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের স্টাফ কোয়ার্টারের বাসায় ওঠার পর আমার প্রথম পুরুষ গুরুকে পেয়েছিলাম। তিনি কল্লোল ভাইয়া। তার বাবা প্রফেসার মজিবর রহমান ভুঁইয়া আনন্দ মোহন কলেজের ইকোনমিক্স ডিপার্টমেন্টের হেড। সেই স্টাফ কোয়ার্টারের ছয়টা ফ্ল্যাটে মোট ২৬ জন শিশু-কিশোর-কিশোরী-তরুণীর বিশাল এক বাহিনী। কল্লোল ভাইয়া এই বাহিনীর নেতা। আমি তার এক নম্বর সাগরেদ। শুধু আমরা দুইজনে মিলে প্রচুর অকাজ কুকাজ করেছি। কোনও কিছু মাথায় আসলেই হলো, তা ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে না রেখে কাজে লেগে যেতাম।

প্রথমেই আমার ব্যক্তিগত একটা সমস্যার সমাধান করে দিলেন। অনেকদিন ধরেই আমাকে একটা বাইসাইকেল কিনে দেয়ার কথা, কিন্তু বড় বাইসাইকেল চালাতে না শিখলে নাকি কিনে দেয়া হবে না। আমি ছোট সাইকেল চালাতে শিখেছিলাম আগেই। কল্লোল ভাইয়া পনের দিনের মধ্যে উনার বাইসাইকেলটা দিয়ে আমাকে সীটে বসে বড় সাইকেল চালানো শিখিয়ে দিলেন। তারপর আমরা দুইজনে দুটি সাইকেলে চেপে, খুব ভোরবেলা, অন্ধকার থাকতে থাকতে, ফজরের আজানের পরপরই সারা শহর ঘুরতে বের হতাম। সেটা ছিল, শরীর স্বাস্থ্য ঠিক করার জন্যে। শরীর স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে অন্য কোনো কামকাজই করা যাবে না।

স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য প্রায়ই মুড়ি, চানাচুর, ছোলা, বাদাম খাওয়ার আয়োজন করা হতো। সেটাও মূলত আমরা দুজনে মিলে গোপনে, বিল্ডিংয়ের ছাদে। এরকম একটা সময় আমরা খেয়াল করলাম, বাড়ির পিছনদিকে জামান চাচার (প্রফেসার মনিরুজ্জামান, ইতিহাস বিভাগ) বাগানে এক কাদি কলা প্রায় পেকে যায় যায় অবস্থা! দেরি না করে আমরা ডিসিশন নিয়ে নিলাম। রাত পার হওয়ার আগেই কাজ সারতে হবে। অপারেশন মিডনাইট বানানা কাটিং শুরু হলো রাত আড়াইটায়। কল্লোল ভাইয়া রাত ঠিক আড়াইটায় আমি যে ঘরে থাকতাম, তার দরজায় তিনটা টোকা দিলেন। আমি জেগেই ছিলাম। তিনি একটা চটের বস্তা এনেছেন সাথে। আর আমি আমাদের খড় কাটার কাঁচি বা যাকে কেউ কেউ বলেন কৈদা, সেটা নিয়ে বের হলাম। কলাগাছটি ছিল পুকুরের পাড়ে। বেশি উঁচু না। কিন্তু কাটার পর, কাঁদিটা যেন পুকুরে পড়ে না যায়, সেটাই মেইন চ্যালেঞ্জ। যাই হোক, ঝপাৎ করে একটা হাল্কা শব্দ হলেও, নো ক্যাজুএলটি। মিশন সাক্সেসফুল।

অতঃপর একদিন আমরা আবিষ্কার করলাম, বিল্ডিংয়ের ছাদে আমাদের ঝালমুড়ি খাওয়ার জায়গাটাতে কিছু গোলাপ ফুলের টব রেখে গেছে কারা যেন! বিষয়টা রাজ্য হারানো রাজা এবং মন্ত্রীদের অবস্থার মতো অত্যন্ত আপত্তিকর আর অপমানজনক। তাই আমরা আটটা গোলাপ গাছের সবগুলিকে উপড়ে শিকড়গুলি আকাশের দিকে মেলে দিয়ে ফুলসহ ডালপালার অনেকটা অংশ সেই টবগুলিতেই পুঁতে দিলাম। পরদিন দেখি, সব টব উধাও! পরে জানা গেল, সেই টবগুলি নাকি ছিল জামান চাচাদের।

আরো কিছুকাল পরে দেখি, জামান চাচাদের বাসার দরজায় সাদা কাগজে হাতে লিখে আঠা দিয়ে আটকানো একটা নোটিশ:

১। জুতা খুলে ঘরে ঢুকবেন।
২। দরজায় আস্তে নক করবেন।
৩। ছাত্রছাত্রীরা রাত ১০টার পর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত দেখা করতে আসবে না।

নোটিশটা আমাদের কারও উদ্দেশ্যে কিনা, পরিষ্কার বোঝা না গেলেও আমরা অত্যন্ত অপমানিত বোধ করলাম। কল্লোল ভাইয়া সেদিনই তার এক বন্ধুকে দিয়ে নতুন নোটিশ লিখিয়ে এনে আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি রাত দশটায় আঁঠা দিয়ে, আগের নোটিশের উপরে নতুন নোটিশটা লাগিয়ে দিলাম:

১। জুতা পরে ঘরে ঢুকবেন। ঘর ময়লা।
২। দরজায় জোরে জোরে নক করবেন। আমরা কানে কম শুনি।
৩। যে কেউ দেখা করতে চাইলে রাত দশটাটা থেকে সকাল নয়টার মধ্যে আসবে। আমরা সারাদিন ঘুমাই।

পরদিন সকাল দশটায় জামান চাচি আমাকে ডেকে পাঠালেন। বুদ্ধিমান আর ঠাণ্ডা মাথার শান্ত ছেলে হিসেবে আমার বেশ নামডাক ছিল। চাচি আমাকে তাদের দরজায় লটকানো নতুন নোটিশটা দেখিয়ে, এই কাজটা কে করতে পারে, সেবিষয়ে আমার ধারণা, অনুমানশক্তি এবং কাকে সন্দেহ হয় এবিষয়ে আমাকে আলোকপাত করতে বললেন। আমার হাতে তিনি নীচতলা নিবাসী রুবেল নামের এক বালকের বইয়ের মলাটে কাঁচা হাতে লেখা, বইয়ের নাম, স্কুলের নাম, ছাত্রের নাম, শ্রেণি, রোল নং, ইত্যাদি উল্লেখ করা একটি বই তুলে দিলেন। ঘটনাক্রমে, রুবেল, অর্থ্যাৎ, যার টেক্সট বই ধার করে জামান চাচার কন্যা নিয়ে গিয়েছিল, আমার সাথে তার কিছু ব্যক্তিগত রেষারেষি বা ব্যক্তিত্বের সংঘাত ছিল। আমি চাচিকে বলে, এক দৌড়ে বাসা থেকে আমার ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা নিয়ে আসলাম। তারপর অভিজ্ঞ হ্যান্ড রাইটিং এক্সপার্টের মতো, কিছু কিছু অক্ষর আর প্যাঁচ দেখিয়ে মন্তব্য করলাম, ৭০% মিলে যাচ্ছে।

চাচি তখন ঘোষণা করলেন, যদি তার একহাতে চন্দ্র আর একহাতে সূর্য দিয়েও বলা হয় এটা রুবেলের হাতের লেখা নয়, তবু তিনি তা বিশ্বাস করবেন না। তিনি ২০০% নিশ্চিত। তারপরও, তিনি কল্লোল ভাইয়াকেও ডেকে পাঠালেন, আরেকটু কনফার্মেশনের জন্যে। কল্লোল ভাইয়া গভীর উদ্বেগের সাথে সেখানে এসে, চিন্তিত মুখে, গভীর মনোযোগের সাথে ম্যগনিফাইং গ্লাস দিয়ে নানান এঙ্গেল থেকে সেই নতুন নোটিশের হাতের লেখা আর বইয়ের মলাটের লেখাটুকু পুংখানুপুংখভাবে নিরীক্ষা করে তার ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে দিলেন। এটা রুবেল ছাড়া অন্য কারো কাজ হওয়ার প্রশ্নই আসে না! মাঝখান থেকে, কাজটা যে আমাদের দুজনেরই করা, তা অনেকটা জেনেশুনেও রুবেল সেদিন চাচির কাছ থেকে প্রচুর ঝাড়ি খাওয়ার পর আমাদের সাথে প্রায় এক সপ্তাহ কোনপ্রকার বাক্যালাপ এবং ভাব বিনিময় এড়িয়ে চলল।

সপ্তম দিনের দিন রুবেল আমাকে এক শর্তে ক্ষমা করে দেয়ার প্রস্তাব দিল। তাকে একটা কাজে সহযোগিতা করতে হবে। কাজটা কি? অপারেশন মিডনাইট ব্যানানা টু করতে হবে। কারণ ইতিমধ্যে সে আমি এবং কল্লোল ভাইয়ার যৌথ উদ্যোগে ব্যানানা ওয়ানের কাহিনি তাকে আমরাই বলেছিলাম। কিছু কলাও খাইয়েছিলাম। তবে, দুইয়ের বেশি লোক হলে ঝামেলা হতে পারে মনে করে, সেবার আর কল্লোল ভাইয়াকে এর মধ্যে জড়ালাম না। সেবার অপারেশন করলাম রাত দেড়টায়। কারণ আমার অভিজ্ঞতামতে, মানুষের ঘুম সবচেয়ে গভীর থাকে ওই সময়টায়। আর অপারেশনের রাতে ঘুমিয়ে পড়া যাবে না। যত আগে সম্ভব, কাজ শেষ করে, একবারে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়াই উত্তম। যথাসময়ে, একই পদ্ধতিতে জামান চাচার কলাগাছের প্রায় পাক ধরি ধরি করছে, এমন দ্বিতীয় কলার কাঁদিটিও উধাও হয়ে যেতে দেখা গেল। এটা আবিষ্কার করে, পনের দিনের ব্যবধানে দুই দুটি কলার কাদি চুরি যাওয়ার ক্ষোভে পরদিন জামান চাচা তার অপুষ্ট কলার একটি কাঁদি, এবং সদ্য মোচা বা থৌড় বের বের হওয়া তিনটি কলাগাছও কেটে ফেলে, যেটা যে অবস্থায় আছে, সেভাবেই, অন্তত তরকারি হিসাবে সদ্ব্যাবহারের ব্যবস্থা করলেন।

জামান চাচাচাচি দুজনই কিন্তু আমাকে আর কল্লোল ভাইয়াকে খুবই পছন্দ করতেন। আর দুষ্টামিগুলির ব্যাপারে অন্য কাউকে সন্দেহ করতেন। জামান চাচাচাচির উপর আমরা সর্বশেষ পরীক্ষা নিরীক্ষা চালালাম এক শীতের ভোরে, ততদিনে তারা আবার বেশকিছু গোলাপের টব কিনে এনে বারান্দার সানশেডে সারি করে রেখে দিয়েছিলেন। আমাদের আসলে খারাপ কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। শুধু দেখতে চেয়েছিলাম, অতিরিক্ত পরিমানে লবণ দেয়া হলে গাছগুলির চেহারা ছবি কিংবা ফুল ফোটানোর হারে কোনও তারতম্য ঘটে কিনা। আমরা পাঁচকেজি অপরিশোধিত লবণ কিনে এনে একরাতে সানশেডের ওপরে রাখা দশটি গোলাপ গাছের গোড়ায় প্রায় সমানভাগে বণ্টন করে দিলাম। তারপর কিছু পরিমাণে পানি দিয়ে লবণগুলিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলাম। সপ্তাহখানেকের মধ্যে দেখি গাছগুলি পত্রশূন্য, ন্যাড়া হয়ে কেমন যেন নেতিয়ে পড়ছে। একসময় ফুল, কলি সব ঝরে পড়ে প্রত্যকটা গাছের করূন মৃত্যু ঘটলো।

গাছগুলির সেই করুণ পরিণতি দেখে আমরা পরবর্তীতে আর জামান চাচার পিছনে আমাদের বুদ্ধিশুদ্ধির অপপ্রয়োগ না করে অন্যে ভালো কাজে মন দিলাম। এই ভালো কাজগুলি করার ক্ষেত্রে জামান চাচার সরাসরি মদদ থাকত। যেমন, যে রাতে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জয় করলো, ১৯৮৬ হবে সম্ভবত, তখন তার নেতৃত্বে আমরা আর্জেন্টিনা আর ম্যারাডোনার নামে জিন্দাবাদ দিতে দিতে এলাকার একটি মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম। মিছিল শেষে, মিছিলকারীদেরকে মিষ্টি খাওয়ার জন্য জামান চাচা তিনশো টাকা চাঁদা দিয়েছিলেন এবং বিল্ডিংয়ের ছাদে একটা সমবর্ধনা অনুষ্ঠান করে ম্যারাডোনার একটা ছবিতে মালা পরিয়ে কিছু খানাপিনাও করেছিলাম।

এরকম ছোট বড় বেশ কিছু অনুষ্ঠান আমরা মাঝেমধ্যেই করতাম। পহেলা বৈশাখ, শীতকালীন পিকনিক, শরৎকালীন নৌকাভ্রমণ, কোনও উপলক্ষ ছাড়াই ছাদ-পিকনিক ইত্যাদি করার কথা মাথায় আসামাত্র আমরা জামান চাচার কাছে চলে যেতাম। তিনি মোটামুটি একটা বাজেট করে কার কার কাছ থেকে কত টাকা চাঁদা তুলতে হবে সেই নির্দেশ বাসায় বাসায় পাঠিয়ে দিতেন। ছয়টি ফ্ল্যাটের সবাইকে বাধ্যতামূলক ভাবে সেই অনুষ্ঠানগুলিতে অংশ নিতে হতো। সেসব অনুষ্ঠানে জামান চাচি, তাদের তিনকন্যা, প্রণব চাচাচাচিসহ (অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং ছড়াকার প্রণব চৌধুরী) আরো অনেকেই নাচ-গান-আবৃত্তি ছাড়াও আরো অনেক কাণ্ডকারখানা হতো। সমস্যা হয়েছে, কল্লোল ভাইয়া বছর পাঁচেক আগে হঠাৎ করে মরে গেছেন। তাকে সসাথে নিয়ে জামান চাচার বাসায় জাওয়ার প্ল্যান ছিল। ঠিক করেছিলাম, আমরা সশরীরে হাজির হয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে আসব। তারপর যা হওয়ার হবে। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় জাওয়ার প্ল্যান করেছিলাম, সেদিন সকালে শুনি কল্লোল ভাইয়া, মানে আমার প্রথম পুরুষ গুরু উপর্যুপরি দুইবার হার্ট এটাক করে পটাশ করে মরে গেছেন।

এদিকে, জামান চাচা এখনো ভালোভাবেই বেঁচেবর্তে আছেন। গতকাল তাকে আমার ফ্রেন্ডলিস্টে যোগ করতে পেরেছি। সেই উপলক্ষে তাকে কিছু গোপন কথা বলার জন্যে এই লেখাটি লিখলাম। কারণ, আমার বয়স ৪৭ হয়ে গেলেও চাচা এখনো আমাকে সামনে পেলে কানমলা দেয়ার ভয় দেখাচ্ছেন। কারণ একটাই, আমি কেন তার বাসায় দেখা করতে যাচ্ছি না। অথবা কোনপ্রকার যোগাযোগ করছি না। আমাকে নাকি তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। কাজেই শুধু কানমলা না, আরো বেশি কিছু আশা করে সাহস করে সবকথা বলে দিলাম। এখন বিচারের ভার আপনাদের উপর।