গোপন সত্যি

পর্ব ১

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০১, ২০১৮

ভদ্রলোককে আমার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না।
পছন্দ না হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই। বেশ আন্তরিক। এখনো বেফাঁস কিছু বলেননি। তার চোখ দুটোয় একরকম মায়া আছে। কেমন যেন টানে। ঘুরেফিরে তার চোখের দিকেই তাকাচ্ছি। ভদ্রলোক কি চোখে কাজল পরেন? কে জানে! তবে কাজলমাখা টানা টানা চোখের যে গল্প শুনতে পাওয়া যায়, তার চোখের দিকে চেয়ে সে কথাই বারবার আমার মনে হচ্ছে। কেমন প্রেমিক প্রেমিক চাউনি। উদাসভাবে চেয়ে আছেন। চারপাশটা যেন কেউ জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে তার ওপর।
এমন মানুষকে কিছুতেই অপছন্দ করা যায় না। পছন্দ না হোক, অপছন্দ করাটা নিশ্চয়ই শোভন দেখায় না। কিন্তু আমি তাকে অপছন্দ করতে আরম্ভ করেছি। কেন জানি না, প্রথম দেখাতেই ভদ্রলোকের খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো খুঁজে পেতে উৎসাহী হয়ে উঠেছি। কারো সম্পর্কে না জেনে আগাম কিছু ভেবে নেয়া নিশ্চয়ই গর্হিত কাজ। আমি সেই গর্হিত কাজ করছি।
কিছু না হোক, মানুষটার চোখ দুটো তো সুন্দর। এ রকম টানা টানা চোখ তো সচরাচর চোখে তেমন পড়ে না। ওই চোখের কারসাজি দেখিয়ে ভদ্রলোক যে কোনো সময় বাজি ধরে যে কোনো মেয়ে বের করে আনতে পারেন। চোখ শুধু কেন, পরনের কোট-টাই বা কম কিসে! খুব দামি একটা কোট তার গায়ে।

ভাই, চা খাবেন?
ভদ্রলোক কিছু বললেন না। আমার বইয়ের আলমারির দিকে তাকিয়ে আছেন অবাক চোখে। মুখখানা গম্ভীর। চোখমুখে দীর্ঘদিনের ক্লান্তির একটা ছাপ। কপালের দু’পাশের শিরা ফুটে উঠেছে।
আপনার তো দেখছি বিশাল সংগ্রহ। আপনি তো ভাই মস্ত মানুষ।
বুঝতে পারলাম না, বইয়ের সঙ্গে মস্ত মানুষ হওয়ার সম্পর্ক কি! এরকম বইয়ের সংগ্রহ অনেকেরই থাকতে পারে। বিচিত্র কিছু না। তারা সবাই কি মস্ত মানুষ? একবার ফরিদপুরের একটা গ্রামে গিয়েছিলাম। খুবই অনুন্নত গ্রাম। যে বাড়িতে রাত কাটালাম সে বাড়ির ছোট মেয়েটার আবার পড়ার ব্যাপক শখ। দেশি-বিদেশি দিয়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজারের মতো বই দেখলাম তার স্টকে। প্রথমটায় আমিই বেশ অবাক হয়েছিলাম। পরে জানলাম, এ বইয়ের বেশিরভাগই তার দাদার ছিল। তিনিও বইয়ের পোকা ছিলেন।
সুতরাং ধরে নেয়া ভালো, ভদ্রলোকের কথাবার্তায় চতুরালি একটা ভাব আছে। বয়সটা আন্দাজ করা শক্ত। তবে আমার ধারণা, বছর চল্লিশের মতো হবে। মুখে সম্ভবত সপ্তাহখানেকের না-কাটা দাঁড়ি। বেশ জংলি জংলি দেখাচ্ছে। মাথার চুল আর্মিদের মতো ছোট করে ছাঁটা। কিছু পাকা উঁকি দিচ্ছে ফাঁক-ফোকর দিয়ে। পোশাক-আশাকে খুবই ফিটফাট। রুচির একটা স্পষ্ট ছাপ প্রথম দেখাতে যে কেউ চট করে ধরে ফেলবে। এও ঠিক, একটা বিধ্বস্ত ভাব তাকে কী রকম যেন ¤্রয়িমাণ করে তুলেছে। মুখের দিকে একটু ভালো করে চেয়ে থাকলেই ব্যাপারটা চোখে পড়ে। বোশেখি ঝড়ের তাণ্ডবের পর গাছপালার যে রকম দশা হয়, ভদ্রলোককে দেখে মনে হচ্ছে, সে রকম বড় কোনো ঝড়ঝাপ্টা কাটিয়ে এসেছেন তিনি।

ভদ্রলোকের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলায়। শুধু একটা গল্প বলার জন্য তিনি এসেছেন আমার কাছে। ব্যাপারটা একটু অস্বস্তিতে ফেলে দিল আমাকে। এ জাতীয় ঝামেলায় নিজেকে খুব একটা জড়াই না। কিন্তু এ লোকটা আমার খোঁজ পেলেন কোত্থেকে, তা বুঝতে পারছি না।
ছুটির দিন। ভেবেছিলাম, মনিরাকে নিয়ে কোথাও বেরোবো। অনেক দিন মখলেসের ওখানে যাওয়া হয় না। সেদিন নিউ মার্কেটের সামনে দেখা। অনেক অনুযোগ করল তার ওখানে যায় না বলে। বউ নাকি কী এক অসুখে পড়েছে। প্রমোশন হয়েছে ওর। বেতন বেড়েছে। এসব হ্যানত্যান, সাতসতেরো। তা আজকে গেলে হতো। দীর্ঘদিনের পুরনো বন্ধু। অন্য রকম একটা আন্তরিকতা আছে। মেসে থেকেছি দীর্ঘকাল একসঙ্গে। কিন্তু একি উৎপাত! ভদ্রলোক আমাকে একটা গল্প বলতে চান। তার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, গল্পটা পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের পরের আশ্চর্য। অষ্টম আশ্চর্য।
ভদ্রলোক এবার কোটের ঝুল পকেট থেকে পুরনো আমলের রাজকীয় কায়দার একটা পানের বাটা বের করলেন। আমার দিকে সরু চোখে চেয়ে জিগেশ করলেন, জিনিসটা সুন্দর না?
আমার অপছন্দের মাত্রা বাড়তে লাগল। হুঙ্কার দিয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, ভাই, আপনি এখন যান। আপনার গল্পটা অন্য আরেকদিন শুনব। আজ আমার খুব জরুরি একটা কাজ আছে। আমার স্ত্রী অসুস্থ। তাকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। বিকেলে ৪টার পর থেকে ডাক্তারকে আবার পাওয়া যায় না। হাসপাতালে ডিউটি থাকে।
এসব কথা কারো মুখের ওপর বলা যায় না, বিশেষ করে বানানো কথা। এটা ভালো দেখায় না। ভদ্রলোক মনে আঘাত পাবেন। তাছাড়া মিথ্যে বলার অভ্যেস আমার কম। আব্বার আদেশে সাত বছর বয়স থেকে মিথ্যে বলা কমাতে আরম্ভ করেছি।

খুব ছোট্ট করে জবাব দিলাম, জি সুন্দর।
এ কথায় ভদ্রলোক উৎসাহ পেলেন। চোখমুখ উজ্জ্বল করে বললেন, অবশ্যই সুন্দর। জিনিসটা তো আর এ দেশের নয়। তবে কোন দেশের তাও সঠিক জানি না। আমার দাদি আম্মা এটা আমাকে দিয়েছিলেন।
আমি মাথা ঝাঁকালাম, ও আচ্ছা।

চলবে