গোপন সত্যি

পর্ব ২

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০২, ২০১৮

চিন্তা করে দেখেন, তখন আমি সবেমাত্র কলেজে ঢুকেছি। বাড়িভর্তি এত লোকজন থাকতে তিনি কীনা শেষমেশ আমাকেই দিলেন এটা। ওই বয়সে পানের বাটা উপহার পেয়ে সে কী আনন্দ আমার!
আমি চিন্তা করছি, এ রকম ভান করলাম। চোখ কপালে তুলে বললাম, স্ট্রেঞ্জ!
ভদ্রলোক রসিকতা ধরতে পারলেন না। হাসি হাসি মুখ করে বললেন, সময় পেলেই জিনিসটা খুলে বসতাম। কলেজ থেকে ফেরার পথে পান কিনে এনে বাটা ভরে সাজিয়ে রাখতাম। নিজেকে তখন বেশ বয়স্ক মনে হতে লাগল। বাড়িতে কেউ পান খেতে চাইলে বাটা হাতে নিয়ে হাজির হয়ে যেতাম।
থামলেন তিনি। অতি যত্ন নিয়ে নানা রকম মশলাপাতি দিয়ে পান বানাতে লাগলেন। মাথাটা সামান্য একটু কাত করে গলা উচিয়ে বক্তৃতা দেয়ার মতো করে বললেন, সিগারেটের চেয়ে পানজর্দা ভাইজান উন্নত পর্যায়ের নেশা। রাজকীয় নেশা বলতে পারেন। আপনি হয়তো জেনে থাকবেন, আগেরকার দিনের রাজরাজড়ারা মৃগনাভি, কস্তুরি দিয়ে সাজা পান খেতে খুবই ভালোবাসতেন। ভুর ভুর করে মিষ্টি একটা সুগন্ধ বেরোতো চারদিকে। অন্দরে বেগমরা রুপোর থালায় সুন্দর করে পান সেজে রাখতেন। দরবার থেকে ক্লান্ত হয়ে জমিদার ফিরে এসে সেই পান মুখে দিয়ে আয়েশ করতেন। পান সাজাও একটা আর্ট। সবাই পারে না এর আর্টিস্ট হতে। হিস্ট্রির জায়গা থেকে পানের মর্যাদা বোঝার সাধ্যি আপনার-আমার নেই। অনেকেরই নেই। বোঝেও না তারা। অবশ্য তাদের বোঝার কথাও না। এ দেশের অধিকাংশ মানুষের মাথায় গোবর পোরা। সহজ কথাটা সহজে তারা বুঝতে চায় না।
পানটা মুখে পুরে বেশ তৃপ্তির একটা নিশ্বাস ছাড়লেন ভদ্রলোক। নিচু গলায় বললেন, ভাইজান কি আমার গল্পটা শুনবেন? শুনলে হয়তো বুঝবেন আপনি, শুনবেন? আপনি বুঝদার লোক, আমি বুঝতে পারছি।
আচ্ছা, তার আগে বলেন তো, আপনি আমার খোঁজ পেলেন কার কাছ থেকে?
আমি আসাতে কি আপনি বিরক্ত হচ্ছেন?
সে রকম কিছু না, এমনি জানতে চাচ্ছি।
ভদ্রলোক আপনমনেই যেন বললেন, তা আপনার কথাই শুধু বলব কেন, আজকাল সবাই আমাকে দেখে বিরক্ত হয়। নিজের লোকজনই এখন আমাকে এড়িয়ে চলে।
মায়া হলো লোকটার দিকে চেয়ে। বললাম, আমি ভাই বিরক্ত হচ্ছি না, বরং ভালোই লাগছে আপনার সঙ্গে কথা বলতে।
তাকে খুশি করতে চেষ্টা করি। কিন্তু মনে হলো, তিনি পাত্তাই দিলেন না আমার কথা। উৎসুক চোখে তাকালেন আমার দিকে। আচ্ছা ভাইজান, আমাকে দেখে বিরক্ত হওয়ার কি আছে? আমাকে দেখে কি সে রকম লোক বলে মনে হয়?
জি না, তা কেন হবে?
তাহলে চিন্তা করেন, পাবলিকের আজকাল বিরক্ত রোগে ধরেছে। এর চিকিৎসা দরকার, নাকি বলেন?
জি।
এরকম লোকের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কি রকম ব্যবস্থা থাকতে পাওে ঠিক বুঝতে পারছি না। থমথমে গলায় বললাম, আপনি কি শুধু গল্প বলার জন্যই এসছেন আমার কাছে?
জি। শুধু গল্পটা বলার জন্যই।
আমি মাথা ঝাঁকালাম, ও আচ্ছা। তবে তো মনে হচ্ছে খুবই মজার হবে গল্পটা।
হবে তো অবশ্যই। অতি বিচিত্র ধরণের গল্প এটা। পৃথিবীতে এরকম ঘটনা কখনো ঘটেছে কীনা জানি না। আমাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার সদরুল আলি আপনার ভগ্নিপতির বিশেষ পরিচিত। ভদ্রলোক তো কালীগঞ্জের এক হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। নামটা যেন কি...
নাম মনে করতে পারলেন না তিনি। আমি ধরিয়ে দিলাম, আরেফ বিল্লাহ।
ও হ্যাঁ, আরেফ বিল্লাহ। তো কথা প্রসঙ্গেই একদিন তার কাছে আপনার কথা শুনলাম।
দুলাভাই নামক প্রাণীটার ওপর এক ধরণের চাপা রাগ জন্ম নিল আমার। দুলাভাই জাতীয় লোকজন যন্ত্রণা দেয়ার জন্যই বুঝি জন্ম নেয় পৃথিবীতে। আমি বললাম, আচ্ছা ভাই, আপনার নামটা কিন্তু এখনো জানা হয়নি।
ছিঃ ছিঃ, কী বেআক্কেলের মতো কাজ। আমার নাম ভাইজান সৈয়দ আহমেদ বদরুল আলম।
বদরুল সাহেব, আপনাকে চা দিতে বলি। চা খাবেন তো নিশ্চয়ই?
তা ভাইজান দিলে আপত্তি নেই। আমি চা এমনিতে কম খাই যদিও। এখন এক কাপ খাওয়া যায়। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসলেন বদরুল আলম। আমি উঠে গিয়ে জানলার পরদা টেনে দিলাম। নভেম্বরের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। বাতাস ভেজা ভেজা। এ বছর শীতটা বেশ জাঁকিয়েই এসেছে। চারদিকে কনকনে হাওয়া দিচ্ছে। সারা দিনের ভেতর রোদের মুখ একবার কী দু’বার দেখতে পাওয়া যায়। গুমোট হয়ে থাকে সারা আকাশ। কুয়াশার পাতলা চাদর ঝুলে আছে বাইরে। জানলা দিয়ে হাওয়া ঢুকছে। কাঁপুনি লাগে শরীরে।
বদরুল আলম জুবুথুবু হয়ে বসে আছেন। নিজের ভেতর নিমগ্ন হয়ে আছেন যেন। কোনদিকে চেয় আছেন, বোঝা যাচ্ছে না। সম্ভবত কিছু একটা নিয়ে ভাবছেন। ভদ্রলোক কি কেবল একটা কোট গায়ে চড়িয়েই বেরিয়ে পড়েছেন? সঙ্গে গরম কাপড়-চোপড় তো তেমন কিছু দেখছি না। এরকম দিনে কেউ এভাবে কাপড় ছাড়া বের হয়? ভদ্রলোক কি শীতপ্রুফ ম্যান?
ভাই, আপনি বসেন, আমি চা নিয়ে আসছি।
আপনি কেন, বাড়িতে কাজের লোক নেই?
জি না।
আপনার স্ত্রী?
এ কথায় একটু চমকে গেলাম আমি। বললাম, সে একটু অসুস্থ। শুয়ে আছে।
তাহলে থাক চা-টা। আপনি বসেন।
অসুবিধে নেই। বলে, আমি সরে এলাম।

চলবে