অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরীন

অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরীন

গোলক

পাপিয়া জেরীন

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৬, ২০১৮

পুলি দিয়ে কাউচ টেনে তুলতে গিয়ে জানালার ফ্রেমটা একটু ব্যেঁকে গ্যালো। পুরানো পোড়া ঘর, রং দিয়ে দিয়ে আর কতো দিন? রন আকাশের দিকে তাকায়, হতাশ লাগে তার। টানা ছয় মাস এই দৃশ্য, মধ্য রাতেও গলির মাথায় এ সূর্যটা। রন আগাস্তের অন্ধকার ভালো লাগে। তার পূর্বপুরুষেরা চারকোন বাক্সের ভেতর বিছানা বালিশ পেতে ঘুমোতো, এমন একটা বাক্স তার লাগবে। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে রুফটপে যে ছোট্ট একটা রুম সেটাতে আগে শুটকী স্টক করা হতো। এখনও বের্জেনের অনেক বাড়িতেই এমন রুম আছে। রনের অবশ্য সেই রুমটা এখন আর কাজে আসে না। এইখানে শোবার জন্য বাক্সটা রাখলে কেমন হয়—  অনেকটা পেন্ডোরা`স বক্সের মতো।

আজকে গ্রামের বাড়ির কথা মনে পড়ছে খুব, সবুজ সেই ছাদগুলো। পায়ে হাঁটা পথের চিহ্নটুকা ছাড়া সব সবুজ। ঘরের ছাদগুলোতেও ঘাস, চিমনিতো জড়ো হওয়া আধমরা আধাসেদ্ধ ঘাস। চোখে লেগে আছে। বাড়ির লনে বেলা আর তার বাছুর। মিসেস মন্টানা বাকেট নিয়ে বসা, ডান হাতে নরম মাখন নিয়ে বেলার বাট ঘষে মরা চামড়া তুলছে। প্রতিদিনকার দৃশ্য। দুধ দোয়ানোর মাঝখানে রন গিয়ে ওলানে মুখ দিতো, মিসেস মন্টানা হিশ্ হিশ্ করে বলতেন— বেটা, এখন তো তুমি মেয়েদের কাছে গিয়েই এই স্বাদটা...। আশপাশ তাকায়ে মন্টানা রনের জিপার টেনে ধরতো। রন অনেকবার নিষেধ করেছে, প্যান্টে মাখনের দাগ লাগলে সহজে ওঠে না। তারপরও সে বলতো, দেখি! কত বড় হয়েছে!

মিসেস মন্টানা বড় কাঠের টাবে গরম পানি জড়ো করতো। মাকে কোলে নিয়ে সেইটার ভিতরে বসাতো। অনেক্ষণ ধরে মায়ের পিঠে রাব্ করে দিতো। সারা সপ্তাহে ঐটা ছিলো মায়ের আনন্দের দিন। রন পাশে বসে মায়ের মুখের দিকে দেখতো, শিশুর মতো কিড় কিড় করে হাসতো মা।

ম্যাডেম তোমার ছেলের বয়স কতো হলো? দশ?
হুম
বিয়ের বয়স তো হলো, এখনও গাইটাকে ছাড়লো না। প্রত্যেকদিন বাটে মুখ দেয়। কিছু একটা করো।
এইসব বলতে বলতে মা আর মিসেস মন্টানা হো হো করে হাসতো। রন লজ্জায় মাটিতে মিশে যেত, মিশতে মিশতে দেখতো মায়ের স্পাইনাল কলামের ব্যথাটা উধাও, মা একটা কিশোরী হয়ে গ্যাছে।

রন কাঠের সিঁড়ি বেয়ে সাবধানে নামে, তার চোখ ঝাপসা আর ভারী হয়ে আসছে। হার্বারের দিকে যেতে হবে, ওখানে ওর সী-ফুড এর দোকান। আজকে টুরিস্টদের ভিড় বাড়ছে, বিকেলে লাইট- ফেস্টের জন্য জড়ো হচ্ছে সবাই। দোকানে সার্বক্ষনিক লোক হান্। তারপরও ঢুঁ মারা দরকার।

দোকানে দুজন ফিলিপিনো যুবতী, একজন বুকে তার বাচ্চাকে ক্যারি করছে। তারা অর্ডার করেছে অয়েস্টার স্যুপ। বাচ্চাটা অনবরত তার মায়ের বুকের দিকটা চেটেই যাচ্ছে।

হেই, ডু ইউ স্পিক ইংলিশ?
হ্যাঁ, আমাকে রন ডাকুন
বের্জেনে কি ওপেন স্পেসে ব্রেস্টফিডিং চলে, নাকি জরিমানা গুনতে হবে?
আপনারা কিছু মনে না করলে আমার বাসায় আসতে পারেন, হার্বারের কাছেই এটা। তাছাড়া ট্যুরিস্টদের আমি পেয়িং গেস্ট হিশেবে অফার করেছি আগে।
না, না— ট্যুর প্যাকেজে আমাদের আগে থেকেই হোটেল রিজার্ভ করা। এনিওয়ে, থ্যাংকস।
আজকে লাইট- ফেস্টে আসছেন তো? আপনাদের নাম জানা হলো না।
আমি কিউয়ি আর ও লোলা।

রন ইতস্ততভাবে ঘুরে দাঁড়ায়। কিউই বাচ্চাকে দুধ দিচ্ছে। বুকের নীল রগগুলো ফুলে উঠছে তার। কিউয়ির চোখ আলতো খোলা, আরামে বারবার ঠোঁট কামড়ে ধরছে সে। রন গ্লাভস খুলে ঘাড়টা চাপ দিয়ে ধরে, মাথাটা টপটপ করছে। মিরিয়ান একবার বলেছিলো শিশুদের মুখে দুধ দিলে মায়েদের পেনিট্রেশন হয়, ওর হতো। এইকথা শুনে সেন্ট্রাল চার্চের পেছনে মিরিয়ানকে চেপে ধরেছিলো রন। ডান দুধে ওর বাচ্চাটা মুখ ডুবিয়ে রেখেছিলো, বাম বুকটা খুলতেই দেখা গেলো অঝোরে দুধ ঝরছে। রন সেদিন পাহাড়ী ছাগলের মতো জেঁকে ধরেছিলো মিরিয়ানকে। টানা একবছর সম্পর্কে ছিলো ওরা, অবশ্য মিরিয়ান এটাকে এ্যাফেয়ার বলতে নারাজ। সেবার ন্যাশনাল ডে তে মিরিয়ানের সাথে দেখা, ওর বাচ্চা দুটোর হাতে ঝলমল করছিলো ফ্ল্যাগ। বরকে পাশ কাটিয়ে রনের কাঁধের কাছে এসে কটাক্ষ করলো— বের্জেনের সব মায়েদের ডেট্ করা শেষ?

মিরিয়ানের জিভে খুব বিষ, হবেই তো— উদ্দাম যৌবন তার। শুধু বুকে মুখ গুঁজে দিলে পোষাবে কেন!
রনকে লাথি দিয়ে ফেলে দিয়েছে বহুবার।
তুমি কি ইমপোটেন্ট? তুমি জীবনেও এই মুখ আর দেখাবেনা আমাকে।
রন কিছু বলতো না, হামাগুড়ি দিয়ে ওর বুকের কাছে যেতো। কাঁদতো।

একটা সময় সে রনের সাথে দেখা করা বন্ধ করে দিলো। তারপরও উইকেন্ডে রন মেক্সিকান রেস্তোরায় যেতো, একা— মিরিয়ানের ফেভারেট ডিশ অর্ডার করতো। বছর ঘুরতেই মিরিয়ানকে আর মিস করতো না সে, কিন্তু সন্ধ্যা হলেই একটা ক্ষুধা চাগাড় দিয়ে উঠতো— স্পাইসি ফুডের।

রনের খুব অসহায় লাগে। আকাশে টানা কয়েকমাস ঝুলে থাকা সূর্যটাকে তার জন্য একমাত্র বরাদ্দ স্তন মনে হয়। মাঝে মাঝে ট্রেনে চড়ে সে শহরের মাথায় ওঠে। মাউন্টেনের ভাঁজে জমে থাকা দুধ-সাদা বরফ। কখনো মাউন্টেন কটেজে গিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে তার। ইলেকট্রিসিটি আর সাপ্লাইয়ের অবিরাম জল থেকে দূরে... বদ্ধ একটা কেবিনে। মিরিয়ানকে নিয়ে রন একবার এসেছিলো মাউন্টেন কটেজে। সেখান থেকে দূরে দুধের মতো ঝর্ণা দেখতে দেখতে মিরিয়ান বলেছিলো—
কী সুন্দর, দ্যাখো রন!
রন বলেছিলে, হুমম... শো মি ইয়োর্স।

সাড়ে তিনটা বাজে। তিনটা পঁয়তাল্লিশে অর্কেস্ট্রা দিয়ে শুরু হবে লাইট-ফেস্ট, সাড়ে চারটায় ফায়ার ওয়ার্কস। রন ভায়োলিনের সুরে দুলে দুলে মবের ভেতর মিলিয়ে যায়। দূরে কিউয়িকে দেখা যাচ্ছে, এক হাতে ক্যান্ডেল অন্যহাত নেড়ে রনকে ইশারা করছে। রন পিছিয়ে যায়। প্রাচীন চার্চের গোলকটাকে আবছা স্তনের মতো লাগে।এখানে সবার হাতে হাতে ক্যান্ডেল, আগুনের শিখার ছায়া গিয়ে পড়ছে মাঝখানের পুকুরটায়। কিউকি আচমকা পেছন থেকে এসে রনের হাতে ক্যান্ডেল গুঁজে দেয়—

তোমাকে খুঁজতে সী-ফুড শপ পর্যন্ত গেলাম দুবার। হান্ বললো এখানেই নাকি তুমি আছো। তুমি এভয়েড করছো নাকি?
আরে না, মাত্র ঢুকলাম আমি।
আমরা রিজার্ভেশন ক্যানসেল করেছি। কাল তোমার কাঠের বাড়িতে উঠতে চাই।
তাই!
রন, দ্যাখো! ক্যান্ডেলের আলোগুলি পুকুরে গিয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে একটা আগুনের গোলক। কী সুন্দর!
রন ব্লাশ করতে থাকে। তার মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়..
হ্যাঁ সুন্দর, কিউয়ি। নাউ শো মি ইয়োর্স!