চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ১

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৯

জৈবনিক অতৃপ্তি এবং কোনো কিছুতেই সম্পূর্ণ না হতে পারার বোধই শিল্পীকে মহৎ শিল্পের দিকে নিয়ে যায়। `শিল্পী` সত্তা হলো একটি মানসিক অবস্থা, যার নিউরোটিক বেস অনেকটাই জেনেটিক, বাকিটা জীবনের অন্তহীন অস্থিরতার সূচকে গনগনে আগুনে ঝলসে উত্তীর্ণ হওয়া কোনো তীব্র নশ্বরতাবোধের পরিণাম। প্রতিটি শিল্পী নিজের অন্তরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকা অধীনস্থ দাস, যে গলা ফাটিয়ে কিছু বলতে চায়, প্রতিবাদ করতে চায়। সেই অপারগতাই সেই পরাধীনতাই তাকে দিয়ে সৃষ্টি করায়। শিল্পী একটি অভিশপ্ত জাত।

বাজারে দাঁড়িয়ে সেই শিল্পীকে যে পরীক্ষা দিতে হয় সে এক অন্য ধাঁচের প্রশ্নপত্র। বাজার নিজের মতো করে পসরা সাজায় অগণিত। সেখানে লেখককেও বিকোতে হয়। কারণ বাজার বলে দিয়েছে পণ্যায়নই হলো গিয়ে শেষ কথা। মার্কেটে কিলো দরে বিকোতে বসে লেখকের মুণ্ডু বিক্রি হয় সবার আগে, আঁশবটিতে রক্ত লেগে থাকে অনেক অন্ধকার বেয়ে গেঁজিয়ে ওঠা মননের।

ক্রয় করতে আসা মানুষ এসে দাঁড়ায় পিরামিডের স্টাইলে। যত নিচের দিকে তাকাবে দেখবে সংখ্যা ততোধিক, চিড়িয়াখানায় যাওয়ার মতোই যারা এসে ভিড় করে বইখানায়, কেনে বেশি সেই বই যা চানাচুরের মতো, পিজ্জার মতো, কোক পেপসির মতো, গোগ্রাসে গিলে একবার যা ফেলে দিতে হয়। যা কোনোদিন কোনো হৃদয়ের আশ্রয় হবে না, যে লেখাকে আঁকড়ে থাকতে ইচ্ছে হবে না প্রেমিকের কনিষ্ঠাঙ্গুলির মতো, সে লেখা কোনো শিল্পীর কাজ হতে পারে না, সে কেবল এক যান্ত্রিক অধ্যাবসায়ের অনুলিপি।

শিল্পী একক ও নিবিষ্ট। সে কারোর ভালোবাসার দাস নয়। সে সকল প্রণয়ের ঊর্ধ্বে। সে কোনো তিতিক্ষার পাত্র নয়। সে কেবল এক অনুপম জীবনসন্ধানী। তার কলম মাটি কোপানোর কোদাল নয়, তার অনুলিখন কোনো শ্রমিকের দিনগত অভ্যাস নয়, সে কেবল এক কাল্পনিক ভবিতব্যের তুলি। তার অঙ্কন এক নিভৃত বুদবুদযাপন, বরণীয়কে নাতিবিলম্বে আত্মস্থ করার প্রয়াস। তবেই তৈরি হয় একটি ভাষা, যা তার একক আত্মপ্রকাশের মাধ্যম। তবেই রচনা হয় সাহিত্য। তবেই লেখা হয় কবিতা। নচেৎ কেবলই ডকুমেন্টেশন।

কিন্তু সে ধৈর্য কই? কোথায় সেই নীরবতাচারণ? তোমার সামনে তোমার থেকে বৃহতাকায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে, সে হলো বাজার। নিজেকে তার গিলোটিনে পিষে মেরে দেয়ার থেকে বড় ভবিতব্য আর কিছু নেই আজ। বাজারই বলে দেবে কাকে কতখানি পেষাই করলে কত মেদ বেরিয়ে আসবে সুলতিত তরলের মতো। সে তরল মৃগনাভি নয়। সে কারোর জীবনবর্তিকা নয়। সে কোন জীবনারণ্য ছেনে খুঁজে আনা জীবনৌষধি নয়। সে কাউকে অমরত্ব দেয় না। সে যা দেয় তা হলো `প্লেজার`, একবার সাঙ্গ হলেই যে শুকনো পাতার মতো ঝরে যায়, যার কোনো প্রাণ নেই।

আমরা তাই আজ `চানাচুর` খুঁজি বেশি। কোক পেপসি খুঁজি। এটা খেয়েই পরেরটাতে চলে যাওয়া যায় যাতে অনায়াসে। আমরা আর আটকে থাকতে চাই না। কোন কিছুতেই নয়। উই ডোন্ট ওয়ান্ট ট্যু গেট হুকড!

 

লেখক: কবি