চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৩

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৯

সন্ত্রাসের জন্ম হয় `ভয়` থেকে। ভয় আসে অজ্ঞতা থেকে, যা কিছু আমার বলে ভেবে শক্তি পাই আমি, তা আমার নাও থাকতে পারে আগামীকাল— এমন অনিশ্চয়তা বোধ থেকে। এই অধিকারবোধ এই ভয় এসবই জন্মগত তাড়না, যা প্রাণকে তাড়িত করে আজীবন। ভেতর থেকে শক্তি জোটানো সে বড় কঠিন। প্রাণের প্রবণতা তাই সংগ্রহের দিকে, তা যা কিছুই হোক না কেন, পার্থিব কিংবা অপার্থিব। এখন সমস্যা হলো, যে কোনো প্রশ্নের উত্তর আমরা বাইরের দিকে খুঁজি, অন্য অনেকের ভেতর। বাকি থেকে যায় কেবল নিজের ভেতর খুঁজে দেখা।

এই পৃথিবীর মালিক কে? মানুষ তা নিজেকেই প্রতিপন্ন করতে চেয়েছে তো আজন্মকাল। আবাল বৃদ্ধ বনিতা লোমচর্মসার মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়া মানুষ সেও জানে, আকাশ যতই অসীম হোকনা কেন, এই ভূখণ্ডের মাটি তার জন্য অপরিসীম নয়। অথচ ওই টুকুই তার ফুটিং, এই পৃথিবীতে লগ্ন থাকার। প্রতি বর্গফুট মেপে তাই পাঁচিল গড়ে ওঠে মানুষে মানুষে, যে যার সংগ্রহে লাগিয়ে রাখে দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্য প্রহরা। এই সংগ্রহের প্রবণতা ক্রমে পরিণত হয় সমষ্টিগত অভ্যেসে। এবাড়ি আমার, ওবাড়ি তোমার। এদেশ আমার, ওদেশ তোমার।

বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। ওপাড়ার কুকুরও এপাড়ায় ঢুকলে রাতবিরেতে লড়াই বেধে যায়। অনন্ত শূন্যতায় চার গজ জমিন নিয়ে লড়াই বাধে এপ্রাণে ওপ্রাণে। কখনো তো কেউ বলে দেয় না, কতটুকু বাতাস কার জন্য বরাদ্দ কিংবা কতখানি আলো কার? দাঙ্গা বাধে কেবল জমি নিয়ে, অভাব হয় খাদ্যের। কারণ বস্তুকে চিহ্নিত করা সহজ।

যখন `দেশ` বলে একটা কনসেপ্ট থাকবে, যখন সম্পত্তির কিংবা জমির অধিকার নিয়ে লড়াই থাকবে, যতদিন অবধি `যুদ্ধ` বিবেচিত হবে একটি স্বীকৃত পদক্ষেপ হিসেবে, যতদিন প্রতিটি ভূখণ্ডের সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার প্রয়োজন থাকবে অনিবার্য, যেহেতু প্রতিটি দেশের একটি নির্দিষ্ট যুদ্ধনীতি থাকবে, অস্ত্রশালায় মজুত থাকবে ভয়ংকর সব যুদ্ধাস্ত্র, থাকবে ইন্টারন্যাশনাল প্রটোকলের নামে একে অপরকে আউটউইট করে দেয়ার ষড়যন্ত্র, ততক্ষণ ততদিন এই মৃত্যু এই রক্তক্ষয় অনিবার্য, তা হোক পাকিস্তানের কিংবা ভারতের, তা হোক আমেরিকায় কিংবা প্যালেস্তাইনে।

আমার কেন ভুলে যাই, যুদ্ধ একটি অতি প্রাচীন বিষয়। আমরা কেন ভুলে যাই, জিঘাংসা এক অতি প্রাচীন রিপু। আমাদের মনে এ প্রশ্ন কেন জাগে না, সভ্যতা নিয়ে বড়াই করা মানুষের কেন এত প্রয়োজন হয় যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার? কারণ এটাই তার রক্তগত সম্পদ। শুধু প্রেম নয়, কেবল দয়া নয়, নয় শুধু ক্ষমা, এই যুযুধান ঈর্ষা এই চূড়ান্ত লিপ্সাই এই পৃথিবীব্যাপী তার তাণ্ডব তথা প্রতিষ্ঠার অন্যতম কারণ। মানুষ এক হিংস্র জাত। সে তার অন্তরে বড় করুণ এক অন্ধকারের জন্মগত দাসত্বে বন্দি হয়ে পড়ে আছে বলেই হয়তো, বড় বেশি মুক্তিকামী সে, বড় বেশি আলোর পিয়াসী।

প্রতিটি মানুষই আসলে জঙ্গি, যে তার নিজের অধিকারের জন্য লড়ে চলেছে। যে কোনো ধরনের ঈর্ষার বপনই হলো সন্ত্রাস। যে অন্যকে ঘৃণা করতে শেখায় সেই সন্ত্রাসবাদী। পৃথিবীব্যাপী ঘৃণার কণ্ঠ একটাই কথা বলে, ‘ক্যাচ দেম ইয়ং।’ ছোট থেকেই শুরু হয় মগজধোলাই। এক একটা ঘৃণার পাঠশালায় চলে এক এক রকম পাঠক্রম, থাকে নানান অ্যাজেন্ডা। এইসব স্কুল থেকে বেরিয়ে আসা প্রোডাক্টরা হয় মূলত বিদ্বেষী। কেউ পাকিস্তানবিদ্বেষী, কেউ ভারতবিদ্বেষী। কারোর বিদ্বেষ ধর্মে, কেউ হিন্দু বিদ্বেষী তো কেউ মুসলিমবিদ্বেষী। কেউ কেউ আবার রেসিস্ট, তাদের বিদ্বেষ মূলত জাতিকেন্দ্রিক। কেউ কেউ আবার পুরুষবিদ্বেষী।

সে বিদ্বেষ যার বিরুদ্ধেই হোক না কেন, হিংসা আর ঘৃণার চরিত্র মূলত এক। অথচ এই বিদ্বেষ প্রাণে নিয়ে কেউ জন্মায় কি? সবটাই বপন করা হয়,সবটাই সঞ্চারিত হয়, কারণ ঘৃণারও এক আশ্চর্য উত্তরাধিকার আছে।

বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলির হাতে আজ কি আছে? কিসের বলে বলীয়ান তারা? আছে কি প্রতিটি মানুষকে একটি সুষম জীবনের সুরক্ষা দেয়ার নিশ্চয়তা? আছে প্রত্যেকের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান কিংবা স্বাক্ষরতার আয়োজন? পৃথিবীর কত মানুষ এই আজকের দিনেও না খেয়ে ঘুমোবে? কত মানুষের মৃত্যু হবে এই আজও ফুটপাতে বিনাচিকিৎসায়? তবে কি আছে রাষ্ট্রের কাছে? আছে পরমাণু বোমা। যা দিয়ে একটা গোটা দেশের সমস্ত শিশুকে বিকলাঙ্গ করে দেয়া যায়। কিসের উত্তরাধিকার বহন করছি আমরা তবে? কেন সুস্বপ্ন দেখি, দুটি দেশের সীমানায় মৃত্যু হবে না কোনো জওয়ানের? কেনই বা তবে প্রয়োজন হয় সেই সীমানার? কেনই বা তাকে বাঁধতে হয় কাঁটাতারে? তা গোলাপের পাপড়িতে নয়, যুদ্ধবাজ একটা স্পিসিজের কিছু তরুণ রক্তে রঞ্জিত হওয়াতেই যে তার যথার্থতা, কেন ভুলে যাই এই নির্মম সত্য?

আজ থেকে বহু বছর আগে কবি নজরুল ইসলামের কণ্ঠে বেজেছিল দুর্ধর্ষ সেই বাণী—

হিন্দু না ওরা মুসলিম এই জিজ্ঞাসে কোন্ জন,
হে কাণ্ডারী বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।

আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও আমরা ভুলে যাই মৃতের কোনো দেশ হয় না, কোনো জাতধর্ম হয় না। মৃত্যু হয় তার যে কারো সন্তান, যে কারো প্রেমিক, কারো ভাই বোন অথবা বন্ধু। মৃত্যু হয় ভালোবাসার, কারণ তাকে জন্ম দিতে হয় আলোর মতো। ঘৃণার কোনো মৃত্যু নেই, কারণ সে চিরায়ত, যার শুরু অথবা শেষ নেই, নেই যেমন অন্ধকারের কিংবা অজ্ঞতার।

লেখক: কবি