চুমুকাহিনি

এহসান হাবীব

প্রকাশিত : আগস্ট ১৫, ২০১৮

চুমোচুমি নিয়ে একটা তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেল। চুমু যদিও নিষ্কাম একটা আদর, তবু তা কখনও কখনও কাম উদ্রেককারী। আর বঙ্গদেশে যেহেতু মানুষ লিমিট জানে না, সেহেতু চুমু নিয়া তাদের একটা ফোবিয়া আছে। বিশেষত প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া নিয়া।

আমি অবশ্য প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার পক্ষে। কিন্তু বিষয়টা যেহেতু দ্বিপাক্ষিক, সেহেতু আমার একার ভাবনা এখানে কাজে লাগানো ঠিক হবে না। ফলে আমার চুমুচাট্টির ইতিহাস যা আছে, তার সবই গোপন। চুমু বলতে আমরা যা বুঝি, মানে যে চুমুটা এই দেশে প্রকাশ্য না গোপনে খাইতে হয়, এইরকম চুমুর কাহিনি দুই একটা আজকে যখন এই বিজন সন্ধ্যায় আমার মনে পড়তে লাগলো, তখন একে একে আমি কতজনের নিকট এই চুমুর শিকার হইছি তার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করতে পারছি না।

আঙুলের কড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। জীবনের প্রথম চুমুটা খুব মনে আছে আমার। রিকশায় বসে পার্শ্ববর্তিনী আমাকে চুমুটা খেয়েছিল। অনেক অনেকদিন আমি তার কাছে আব্দার করেছি একটা চুমু খাব বলে। আমি তাকে বলতাম, একটা চুমু দেই? ও বলতো, দেও। আর অমনি আমি ফিউজ হয়ে যাইতাম। কত কতদিন যে এইরকম হইছে।

আমি তার সামনে চিৎকার করে বলতাম, আল্লাহ আমারে শক্তি দেও, যেন আমি তারে চুমু খাইতে পারি। ও হাসতো। খিলখিল করে হাসতো। কিন্তু আমি চুমু খাইতে পারতাম না। ওর হাসি দেখে আমার চুমু খাওয়ার তৃষ্ণা দ্বিগুণ বাড়তো, কিন্তু চুমু খেতে না পারায় কী যে কষ্ট হতো! তারপর একদিন দুপ্পুরবেলায় আমরা রিকশা করে যাচ্ছি। রিকশা তখন কাঁচিঝুলি মোড় থেকে জয়নুল পার্কের দিকে যাচ্ছে। ওইদিন সম্ভবত অনার্স প্রথম বর্ষের রেজাল্ট হইছিল। আমরা সারাবছর তাইরে নাইরে করে দুজনেই পাশ করে ফেলছি। পুনর্বার আর পরীক্ষা দিতে হবে না। তার মা বা দিদি আমার সাথে ঘুরতে আর বাঁধা দেবে না, এই আনন্দে সে আত্মহারা ছিল!

আমি চিরচারিত স্বভাব অনুযায়ী বললাম, তাইলে একটা চুমু দেই? হঠাৎ করে কী জানি হলো, ও আশপাশে তাকিয়ে ফট করে আমার গালে একটা চুমু দিয়ে দিলো। ক্ষণিকের জন্য মনে হলো, গালটায় একটা ছ্যাঁকা লেগে গেল। আমি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিলাম। ওইটাই শেষবার। এরপর আর কোনোদিন ওইরকম মনে হয় নাই। চুমু নিয়া কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা আছে আমার। সমবয়সী, কমবয়সী, বেশিবয়সী কতো রকমের বন্ধুরা আমাকে চুমু খেয়েছে। একবার তো একজনে চুমু খাওয়ার পর বমি করে দিয়েছিলাম। তার মুখে সিগারেটের গন্ধ ছিল। ও বিস্ফোরিত নয়নে আমার দিকে তাকিয়েছিল।

একজন সন্ধেবেলায় আমাকে রিকশায় ডাকতেন। তারপর রিকশা একটু লোকালয়ের বাইরে এলে তার ডান হাতটা আমার বাম ঊরুতে রেখে বলতেন, আপনাকে একটা চুমু দেই? আমি চুপ থাকতাম। সে খুব আবেগে আমার গালে চুমু দিতো। অনেক অনেক দিন এরকম হয়েছে। একদিন সে আমাকে খুব করে বলেছিল, আমাকে একটা চুমু দেবেন? আমি না শোনার ভান করে বসেছিলাম।

সময় চলে গেছে। সময় চলে যায়। তার সাথে আমার এখনো মাঝে মাঝে দেখা হয়। কিন্তু চুমুর আব্দার সে আর করো না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে জিজ্ঞেস করি তার সেই চুমুর খাওয়ার ইচ্ছেগুলো এখনো আছে কীনা? তারপর ভাবি, থাক। খুঁচিয়ে কী লাভ?

আরেক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে চুমুর একটা অদ্ভূত স্মৃতি আছে। সে যেদিন আমাকে চুমু খেয়েছিল, ওইদিন তার খুব মন খারাপ ছিল। সে চুমু খাওয়ার পর আমিও তাকে চুমু খেয়েছিলাম। হঠাৎ সে আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কী হলো? সে অনেকক্ষণ আমাকে ধরে কেঁদেছিল। তার সাথে আজো আমার দেখা হয়।

হঠাৎ হঠাৎ আমি তারে জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা, আমাদের প্রথম চুমুর দিন তুমি অমন কাঁদছিলে কেন? সে তখন খিলখিল করে হাসে। আমি যেমন ওই কান্নার মানে আজো উদ্ধার করতে পারি নাই, তেমনি তার এই হাসির মানেও উদ্ধার করতে পারি না। আমি তখন বোকা সেজে চুপ করে বসে থাকি।

লেখক: কবি