চোখের সামনের ঘটনা, অথচ আরেক বাস্তব!

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৯

গল্প আসলে কী জিনিসি? একটি ঘটনা, ব্যক্তিজীবনে ঘটে যাওয়া সময়ের এক একটি ঢেউ। এ ঢেউ যে জলছাপ রেখে যায়, তা দেখতে পারে জগতের কিছু কিছু লোক। তাই তারা সেই ছবি আঁকতে চেষ্টা করে।

 

কেউ সফল হয়, কেউ হয় না। কেন হয় না? এর জবাব পেতে শিশুদের দিকে চোখ ফেরান। তারা কী শুনতে চায়? কিস্‌সা। নিপাট কিস্‌সা। সুতরাং, ছবির মতো করে যে ঘটনাটা শিশুর মনে ছবি এঁকে দিয়েছে, বয়স্ক মানুষটিও ঠিক সেই ছবিই চাইবেন গল্পের ভেতর দিয়ে।

 

গল্প থাক বা না-থাক, অনেকের গল্পেই দ্যাখা যাবে, বাংলা দুরূহ শব্দের আনাগোনা। পাঠক ভিমড়ি খায়। সে তার মতো করে কোনো ছবি তৈরি করতে পারে না। বিশ্ব কথাসাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতা যাদের আছে তারা জানেন, ক্লাসিক্যাল কথাসাহিত্য ছবির মতো সহজ-সরল।

 

গল্পলেখকের প্রধান কেরামতি এই যে, কত সহজে তার অন্তর্জগতে দ্যাখা চরিত্রগুলোকে সে কত পরিষ্কারভাবে তুলে আনতে পারছে কলমে। যাই হোক, এ আলোচনা চলতেই থাকবে, মানুষের গল্প লেখার তাড়নাও ততদিন থাকবে।

 

মারিয়া সালামের ‘নীলকণ্ঠী’ নামের একটি বই এবার বইমেলায় বেরিয়েছে। এটাই লেখকের প্রথম বই। আমরা সকলেই জানি, প্রথম বই নিয়ে সব লেখকেরই একটা সাহসী মনোভাব থাকে। মারিয়া সালামের ক্ষেত্রে কী সেটা? চলুন তবে পড়া যাক ‘নীলকণ্ঠী’র উৎসর্গপত্রটি।

 

পৃথিবীর সকল মানুষের প্রাণের, মনের আর আত্মার সততা ও শুভবোধকে।

 

কী সাহসী উচ্চারণ! সমাজ-সভ্যতার কলুষিত আজকের সময়ে একজন গল্পলেখক তার পাঠকদের উদ্দেশে অনুরোধ জানাচ্ছেন, সততা ও শুভবোধ জাগ্রত হোক।

 

মারিয়া সালামের সাহসী এই উচ্চারণের পরপরই আমরা পেতে থাকি এক একটি গল্প। গল্পগুলোর নাম পড়তেও তো ভালো লাগে। তবে চলুন, পড়ে ফেলি—

বাক্স বালক

অন্য নরকে

নিবিড় বাতাসের মতো

শহরে সন্ধ্যার হাওয়া যখন লেগেছে

বিশুষ্ক বর্ষণে

নীলকণ্ঠী

 

সবমিলিয়ে ৬টি গল্প। কি আছে গল্পতে? চলুন, প্রথম গল্পটি থেকে এক চিমটি পড়ে নেয়া যাক— ‘ঘুমের ঘোর লাগা চোখে বাস থেকে নামতেই ওকে ঘিরে ধরল অন্তত ডজনখানেক শিশু। সবাই রোহিঙ্গা বোঝা যাচ্ছে, বয়স কারোরই দশের ওপর না। এরা কুলির কাজ করে সেটা বুঝতে কিছুটা সময় লাগল ওর। এত্তটুকু হাড় জিরজিরে শরীরগুলো নিযে এরকম ত্রিশ থেকে চল্লিশজনের বেশি শিশু তাদের ওজনের দ্বিগুণ ব্যগগুলো নিয়ে কোনোরকমে টলতে টলতে শিপের দিকে যাচ্ছে। সবার চোখে মুখে আকুতি, কাজ পাবার। মানুষগুলোও আজব! মাত্র বিশ-ত্রিশ টাকা বাঁচানোর জন্য এদের সাথেও দরদাম করে যাচ্ছে সমানে।

 

ওরা তবু ভিক্ষা করে না, মলিন মুখগুলো দেখে অপলার চোখে পানি চলে আসছে। রোদচশমাটা চোখে চড়িয়ে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে।’

 

ছোট্ট এক টুকরো ছবি। সাধারণ বর্ণনা। কোনো পণ্ডিতি নেই। পাঠকের মানবিক সত্তাটা হঠাৎ একটু ঝাঁকি খেয়ে উঠল। এরচে বড় পাওয়া একজন লেখকের আর কী হতে পারে!

 

মারিয়া সালাম যদিও ব্যাপারটি এড়িয়ে যেতে চাইছেন বইটির ভূমিকায়। তিনি লিখেছেন, বই ছাপানোর মতো দুঃসাহসিক কাজ তিনি করেছেন ঠিকই, তবে লেখক হবার অভিপ্রায়টি গৌণ।

 

আমার পাঠঅভিজ্ঞতা বলছে, মারিয়া সালাম লিখতে থাকুন। লেখক হয়ে ওঠা আর না ওঠাও এই জগৎ-সংসারে গৌণ। গল্প ছয়টি পড়তে পড়তে কয়েকবার আমিও ঝাঁকুনি খেয়েছি। আমাদের চোখের সামনের ঘটনা, অথচ এ যেন আরেক বাস্তব!

 

‘নীলকণ্ঠী’র প্রকাশক, কাশবন। প্রচ্ছদ করেছেন রিফাত বিন সালাম। দাম, ১২৫ টাকা। বইমেলায় পাওয়া যাচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৪২ কাশবন স্টলে।

 

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক

একুশে বইমেলা ২০১৮