চোপ, সোজা চল, লাইনে চল
রহমান মুফিজপ্রকাশিত : আগস্ট ০৮, ২০১৮
পৃথিবীর ইতিহাসে এ ঘটনা নজিরবিহীন। একটা নৈরাজ্যকবলিত রাষ্ট্রকে টানা পাঁচদিন অবরুদ্ধ করে রাখে এ দেশের তরুণপ্রাণ কিশোর-কিশোরীরা। না, তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার জন্য এটা করেনি। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা তাদের লক্ষ্য নয়, কাজও নয়। তারা স্রেফ নিরাপত্তা চাইছে। সড়কে নিরাপত্তা, জীবনের নিরাপত্তা- যেটা এ দেশ ৪৭ বছরেও দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ৪৭ বছরের ব্যর্থতার লজ্জা আমরা অনুভব করিনি একবারও। করিনি বলেই ৪৭টা বছর অবাধে এ দেশের সম্পদ লুট করে নিয়েছে তারা। কারা লুট করেছে? শাসক চক্র। শাসকচক্র কারা? যারা বারবার ক্ষমতায় গেছে। (ভাসুরের নাম মুখে নিতে আমারও ভয় হয়। আমি যে ভদ্দরনোক! এ দেশের আইনে শত ধারায় আমার গুষ্ঠি কিলিয়ে শায়েস্তা করার বিধান আছে) এরা কখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহায় দিয়ে, কখনো ধর্মের লেবাস এঁটে, কখনো উন্নয়নের লেবেঞ্চুস ধরিয়ে দিয়ে জনগণের পোঁদ মেরেছে। (প্রমিত ভাষায়: জনগণের সঙ্গে ধাপ্পাবাজি করেছে।)
এ শাসকচক্র এতটা পাপ সারা জীবনে করে বেড়িয়েছে যে, তাদের পাপকে বৈধ করার জন্য সামাজিকীকরণ করা হয়েছে ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম ও উচ্ছৃঙ্খলতাকে। সমাজকে কলুষিত করতে পারলেই যে তারা আখেরে বেঁচে যায়, এ সহজ সূত্র জানে না কে? সমাজে যত নৈরাজ্য এরা ছড়িয়ে দিতে পেরেছে, তাদের ক্ষমতার ভীত ততটাই শক্ত হয়েছে। সড়কে নৈরাজ্য কী নতুন? বছরের পর বছর একটা সর্বগ্রাসী সিন্ডিকেট পুরো দেশকে জিম্মি করে রেখেছে। আমাদের গাঁটের কোটি কোটি টাকার শ্রাদ্ধ তো করেছেই, আবার সুযোগ পেলে আমাদের চোখও রাঙিয়েছে। আমরা অসহায় ছিলাম এসব চোর আর তার মাসতুতো ভাইদের কাছে। কারণ এদের রয়েছে ক্ষমতা। এদের রয়েছে সিন্ডিকেট। এদের রয়েছে হোন্ডা আর গুণ্ডাবাহিনী। জনগণকে প্যাঁদাতে এরা রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে তো রীতিমতো লাইসেন্সই দিয়ে দিয়েছে। আমাদের টাকায় এরা অস্ত্র কেনে, লাঠি কেনে আর সে লাঠি ও অস্ত্র আমাদের ওপরেই চালায়। রাষ্ট্রের কী বুজরুকি! এটা বোঝার বয়স আমাদের এখনো হয়নি (!) সেজন্য আমরা দাস হয়ে থেকেছি। ক্ষমতার দাস। চারদিকে ক্ষমতা গিজগিজ করে তো! ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতা, তার কর্মীর ক্ষমতা, নেতার ক্ষমতা, আমলার ক্ষমতা, কেরানির ক্ষমতা, পুলিশের ক্ষমতা, হোন্ডার ক্ষমতা, গুণ্ডার ক্ষমতা, অনুগত মিডিয়ার ক্ষমতা, অনুগত বুদ্ধিজীবী, সুশীল, কবি-বেশ্যার দালালের ক্ষমতা কি কম দেখছি? এসব ক্ষমতার সঙ্গে আমরা লাগতে যাই না। কয়েক বছরে তো এদের সঙ্গে লাগতে গিয়ে কেউ কেউ এখনো বাসায়ই ফেরেনি। কেউ কেউ খড়গের নিচে রয়েছে কোনো রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে। তাই আমরা এসব বজ্জাতির বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস করি না। উপরন্তু কোথাও কোথাও আপোষ করে নিয়েছি। কারণ আমাদের রক্তে এখন সুবিধাবাদের পাপ।
কিন্তু সে পাপ স্পর্শ করেনি এ দেশের সূর্যপ্রাণ কিশোর ও তরুণদের। তারা ঠিকই সময়ের আওয়াজ সময়ে তুলেছে। এরা শাহবাগের গণজাগরণ প্রত্যক্ষ করা প্রজন্ম। এরা ভ্যাট আন্দোলন দেখেছে পথে পথে। এরা কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং তার সঙ্গে ক্ষমতার গাদ্দারি দেখেছে সম্প্রতি। এরা জেনে গেছে, পথে নামলেই পথ মিলে যায় আগামীর। শাহবাগ এটা অন্তত শিখিয়ে দিয়ে গেছে। আমাকে যারা প্রশ্ন করে, কী পেয়েছিলে শাহাবাগে? আমি এখন অঙ্গুলি নির্দেশ করে, গর্বে সিনার ছাতি দুই ইঞ্চি উঁচু করে বলবো, এই দেখো, পথে নামা শিখিয়েছে। চিৎকার করে স্লোগান দেয়া শিখিয়েছে। অবিরত লড়াইয়ের প্রেরণা দিয়েছে শাহবাগ। শাহবাগের সুদূরপ্রসারী প্রভাব আঁচ করেই কায়েমি গোষ্ঠী তাকে খণ্ডবিখণ্ড করার চেষ্টা করেছিল। প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আগুন ঠিকই আমরা ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলাম সর্বত্র। এ প্রজন্মের সোনামনিরা তার প্রমাণ দিল আবার। আমাদের ভাই-বোনেরা মিথ্যে শিক্ষা নেয়নি, বিভ্রান্ত হয়নি। শাহবাগ থেকে যা নেবার নিয়ে নিয়েছে। আর যা দেবার কথা ছিল তাই দিয়েছে। আরো দেবে।
এ প্রজন্ম এঁটো, পুরনো, বস্তাপচা সুশীল ভাষায় কথা বলে না। এদের ভাষায় রয়েছে নিদারুণ তেজ, স্লেষ, ক্ষোভ, ঘৃণা আর দম্ভ চূর্ণ করা শব্দ-প্রত্যয়। কখনো কখনো সে শব্দ প্রত্যয়সমূহ বিদ্রোহের ভাষা বুঝতে না পারা আনাড়ি মানুষের কাছে অশ্রাব্য ঠেকেছে, অশালীন ঠেকেছে। এ নিয়ে অনেকের চুল ছেঁড়াঁছেঁড়ি দেখছি। অবাক লাগে! ৪৭টা বছর আপনার-আমার মুখে লেবেঞ্চুষ ধরিয়ে দিয়ে যারা পেছন থেকে অসভ্য চ’বর্গীয় কর্মটা সেরে যাচ্ছিল, আজ তাদের ওপরই যখন ‘চ’ বর্গীয় আক্রোশ ঝরে পড়ছে তখন কেন আপনাদের এত জ্বালাপোড়া! (আপনি এই ফাঁকে ভাবতে পারেন, আপনার মুখে লেবেঞ্চুস আর শাসকচক্র আপনার পাছা মারছে! কী ভয়ানক, কী লজ্জাস্কর, গ্লানীকর সে দৃশ্য! শরীরটা গুলিয়ে উঠবে বমিতে) আপনি কোথাকার কোন সভ্যতার নিক্তি হাজির করে বলছেন যে, এরা বিশ্রি, এরা অশালিন? এসব কপটতা রাখুন। ভাঁড়ামি ছাড়ুন। বলুন এটা ‘পবিত্রতম বিশ্রি’, ‘পবিত্রতম অশালীন’। কখনো কখনো এই ‘পবিত্রতম অশালিনতা’ই হয়ে ওঠে দুঃশাসনের দাঁতভাঙা জবাব।
আজ আমাদের ভাই-বোনেরা পৃথিবীর প্রতিবাদের ইতিহাসকে পাল্টে দিয়েছে। হাজার বছরের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে একটা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তারা। ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার কাছে নতজানুতাকে মেনে নিয়ে আমরা যারা নষ্ট-পচাগলা সিস্টেমের দাস হয়ে ছিলাম, মুখ বুঁজে মেনে নিয়েছিলাম ক্ষমতার বজ্জাতি তাদেরকে এমন শিক্ষা দিয়ে গেছে, যে শিক্ষা সারা জীবন কেবল মনেই থাকবে না, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এটা গল্প হয়ে ফিরবে, মিথ হয়ে ফিরবে।
টানা সাত ঘণ্টা পায়ে হেঁটে হেঁটে দেখছিলাম সূর্যিত স্পর্ধা নিয়ে তরুণ প্রাণেরা শাসন করছে ঢাকার রাজপথ। তখন মনে হচ্ছিল, একালের সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতাকে দেখছি; একেকজন মুজিবকে দেখেছি। একেকজন কিশোর যেন একেকজন নায়ক! একেকজন কিশোরী যেন তীব্র স্ফূলিঙ্গ! আঙুল তুলে শাসিয়ে দিচ্ছে ক্ষমতার দম্ভ, অনিয়মের চোরাগলি, নৈরাজ্যের বিপুল পাপ বয়ে চলা মানুষগুলোকে। শুধু অসভ্য মানুষগুলোকেই শাসায়নি, প্রকৃতপক্ষে তারা শাসিয়ে দিয়েছে বেশরম রাষ্ট্রকে, যার সর্বত্র জেঁকে বসেছে দুর্বৃত্তের শাসন।
এরা নতুন বিপ্লব সম্পন্ন করেছে। এ বিপ্লব বাঙলায় ‘আঠারোর বিপ্লব’ বলে খ্যাত হোক, ‘কিশোর বিদ্রোহ’ বলে খ্যাত হোক বা খ্যাত হোক ‘কিশোর বিপ্লব’ নামে। যে নামেই ডাকা হোক, এ বিপ্লব এ বার্তাই ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবে, দুঃসাশনের বিরুদ্ধে যখন কেউ জাগবে না, তখন আমার শিশুটি জাগবেই। উত্তোলিত উদ্ভাসিত মুষ্ঠিবদ্ধ হাত দুর্বিপাকের ঘনায়মান বাতাসকে নাড়িয়ে দিয়ে বলবে, ‘চোপ, সোজা চল। লাইনে চল’। আর আধো ঘুমে ঢলো ঢলো মায়ের (এখানে মা মানে দেশ ও দেশের মানুষ) কানে কানে বলবে ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে’।
লেখক: কবি ও গল্পকার