ছোটদের পূর্ববঙ্গ গীতিকার গল্প

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : জুলাই ১৮, ২০১৮

বাংলাদেশ ভাবের দেশ, গানের দেশ, কবিতার দেশ। চৌদ্দ থেকে সতেরশো শতকের মধ্যে পূর্ববঙ্গের সাধারণ কৃষকদের মুখে মুখে রচিত হয়েছিল অসংখ্য কাহিনিকাব্য বা পালা। রচয়িতারা স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। কেউ কেউ হয়তো সামান্য লিখতে-পড়তে পারতেন। তবে তাদের মধ্যে ভাবরসের কোনো কমতি ছিল না। তৎকালীন সমাজ, ইতিহাস, যুদ্ধ, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, ধর্মীয় সম্প্রীতি, মানব-মানবীর প্রেম, নারীর আত্মত্যাগসহ মানবজীবনের নানা ঘটনা নিয়ে ছড়া-পাঁচালির ঢঙে মুখে মুখে পালাগুলো রচনা করতেন তারা। পরে গায়েনের দল সুরারোপ করে গ্রামে গ্রামে গেয়ে বেড়াত। এসব পালাই ছিল গ্রামবাংলার মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম।

১৯১৩ সাল থেকে চন্দ্রকুমার দে প্রথম এই ধরণের পালাগুলো ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করতে থাকেন। খ্যাতিমান লেখক ও গবেষক শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুর পালাগুলো পড়ে মুগ্ধ হন এবং চন্দ্রকুমার দে’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরে তার নেতৃত্বে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফরিদপুর, সিলেট, ত্রিপুরা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে পালাগুলো সংগৃহীত হয়। প্রধান প্রধান সংগ্রাহকের মধ্যে ছিলেন চন্দ্রকুমার দে, দীনেশচন্দ্র সেন, আশুতোষ চৌধুরী, জসীমউদ্দীন, নগেন্দ্রচন্দ্র দে, রজনীকান্ত ভদ্র, বিহারীলাল রায়, বিজয়নারাণ আচার্য প্রমুখ। পরবর্তীকালে দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্কলন ও সম্পাদনায় চারখণ্ডে প্রকাশিত হয় পূর্ববঙ্গ গীতিকা। এই চার খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত পালাগুলো থেকে নির্বাচিত আটাশটি পালা নিয়ে ছোটদের পূর্ববঙ্গ গীতিকার গল্প। গল্পগুলো ছোটদের উপযোগী ভাষায় এবং সংক্ষেপে রচিত।

বইটি রচনায় আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল ছোট্ট একটি ঘটনা। ছোটবেলায়, দশ-এগার বছর বয়সে, আমার জন্মগ্রামের আবদুল কাইয়ুম নামে এক বড় ভাই শীত-বসন্ত নামে ছোটদের একটি গল্পের বই আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন। বইটি পড়ে কিশোরমনে মনে দাগ কেটে গিয়েছিল। সেই গল্প এখনো মনে আছে। পরবর্তীকালে বইটি অনেক খুঁজেছি। কোথাও পাইনি।

২০০৮ সালের দিকে শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন সঙ্কলিত ও সম্পাদিত পূর্ববঙ্গ গীতিকার পাঠ শুরু করি। চতুর্থ খণ্ডে কমল সদাগরের পালাটির সঙ্গে শীত-বসন্তের গল্পের মিল খুঁজে পাই। পালার শুরুতে দীনেশচন্দ্র সেন লিখিত ভূমিকার মাধ্যমে জানতে পারি, কমল সদাগরের পালাটি সেই শীত-বসন্তেরই রূপান্তর। সেদিনই প্রথম পূর্ববঙ্গ গীতিকার পালাগুলোকে ছোটদের উপযোগী করে সংক্ষিপ্ত গল্পরূপ দেয়ার ভাবনাটি আমার মধ্যে জারিত হয়। কারণ, পূর্ববঙ্গ গীতিকার পালাগুলো আঞ্চলিক ভাষায় রচিত। ছোটদের পক্ষে এই ভাষা বোঝা কষ্টসাধ্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বড়দের পক্ষেও। নানা ব্যস্ততার কারণে কাজটি করা সম্ভব হচ্ছিল না। ২০১৮ সালের জুনের শুরুর দিকে আলমিরা থেকে পূর্ববঙ্গ গীতিকা বের করে আবার পড়তে শুরু করি। আটাশটি পালা নির্বাচন করে শুরু করি লেখা। প্রতিটি গল্প সর্বোচ্চ তিন হাজার শব্দের মধ্যে রাখার চেষ্টা করেছি।

রেডিও, টেলিভিশন, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ইলেক্ট্রনিক খেলনা সামগ্রী, অভিভাবকের অসচেতনতাসহ নানা কারণে বর্তমান প্রজন্ম বইবিমুখ। ছোটদের মানসিক উৎকর্ষের জন্য বইপাঠের বিকল্প নেই। ছোটদের পূর্ববঙ্গ গীতিকার গল্প হতে পারে তাদের মানসগঠনের উপযোগী একটি অনন্য বই। পূর্ববঙ্গ গীতিকার এসব পালা বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আটাশটি পালাকে ছোটদের উপযোগী ভাষায় গল্পরূপ দিতে পেরে স্বস্তি অনুভব করছি। মানুষের কল্যাণ হোক। সর্বপ্রাণ সুখী হোক।
ছোটদের পূর্ববঙ্গ গীতিকার গল্প, প্রকাশক: রিয়াজ খান, রোদেলা প্রকাশনী, প্রচ্ছদ: মোবারক হোসেন লিটন, প্রকাশকাল: ২০১৯

একুশে বইমেলা ২০১৮