জগতের সমগ্রতা সন্ধানি অসামান্য পুরুষ গ্যোয়েটে

স্মরণ

হামীম কামরুল হক

প্রকাশিত : আগস্ট ৩০, ২০১৮

শিবনারায়ণ রায়ের মতে, রবীন্দ্রনাথের চেয়ে একজন প্রতিভাই কেবল শিল্পসাহিত্যের জগতে ওপরে আছেন। তিনি গ্যোয়েটে। শিবনারায়ণ রায়ের কথা টানার কারণ, তিনি হচ্ছেন একে তো অসম্ভব মননশীল ও সৃষ্টিশীল মানুষ, তারওপর সারা ভারতে তো বটেই, সারা বিশ্বের সেরা পাঠকদের একজন।

জগতের প্রায় প্রধান সব চিন্তাবিদ ও সাহিত্যকের সৃষ্টিশীল ও চিন্তামূলক বইপত্র তাঁর কেবল পড়াই ছিল না, তিনি একাধিবার সেসব পড়তেন। বারবার পড়তেন। এজন্য তাঁর বাাছবিচারের ওপর ভরসা রাখা যায়। সেই তিনি গ্যোয়েটেকে অনেকগুলি কারণে জগতের সবচেয়ে সেরা সাহিত্য প্রতিভা হিসেবেই কেবল মনেই করেন, তা নয়, গ্যোয়েটের চেয়ে চিন্তাচেতনায় চিরায়ত-আধুনিক মানুষ তাঁর মতে খুব একটা নেই।

মানুষের শরীরে ২০৬ খানা যে হাড় আছে, সেই শেষ ২০৬তম হাড়ের শনাক্তকারী ছিলেন গ্যোয়েটে। সেলিম আল দীন আমাকে বলেছিলেন, ‘গ্যেটের কাছ থেকে নিবি উচ্চতা, তলস্তয়ের কাছ থেকে নিবি বিস্তৃতি আর রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে নিবি সূক্ষ্মতা।’

গ্যোয়েটে বলতেন, ফ্রয়েডের লেখা থেকে পড়েছি, (ফ্রয়েড তো গ্যোয়েটের আরেক ভক্ত), ‘আর্ট, সায়েন্স ও রিলিজিয়ন―  এই তিনটার ভেতরে আর্ট ও সায়েন্সই মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার পাথেয়, কিন্তু যাদের এই দুটোকে গ্রহণ করার সাধ্য নেই, তাদের রিলিজিয়ন দিয়ে দাও। কারণ তাদের শান্ত থাকতে হবে।’ এই কথার গভীরতা যারা বুঝবেন তারা টের পাবেন কী সাংঘাতিক কথা ধরিয়ে দিয়েছিলেন গ্যোয়েটে সেই কালে।

বলা হয়, মানবজাতি যদি ধ্বংস হয়ে যায়, কিন্তু তার আগে গ্যোয়েটের ‘ফাউস্ট’কে যদি মহাশূন্যের কোনো একটা ফরমেটে ছেড়ে দিতে পারে, এবং সেটা, অন্যকোনো গ্রহে যদি কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী থেকে থাকে, তারা যদি আবিষ্কার করে, তাহলে তারা বুঝতে পারবে ‘মানুষ’ জিনিসটা আসলে কী? কেমন? কীভাবে? কী ভাবত?

গ্যোয়েটে জগতের সমগ্রতা সন্ধানি এক অসামান্য পুরুষ। তিনি রবীন্দ্রনাথের এত প্রিয় ছিলেন যে, তাঁর লেখা পড়তে জার্মান ভাষা শেখা শুরু করেছিলেন।... ফরাসিরা যখন তৎকালীন বিচ্ছিন্ন জার্মানির একটা অংশ দখল করে, তখন তিনি ফরাসিদের ওই দখলদারিত্বকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তাতে তাঁর নিন্দাও জুটেছিল, কিন্তু তিনি মনে করতেন, ফরাসিদের মতো সুসভ্য জাতির সংস্পর্শে অপেক্ষাকৃত গেঁয়ো জার্মানরা একটু সভ্য হবে।...

জীবনের বিচিত্র সব প্রথা ভেঙেছেন। উপন্যাস লিখেছেন এমনই যে, সে-সময়ের তরুণদের মধ্যে উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল, দেখা দিয়েছিল প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে আত্মহত্যার প্রবণতা। সাহিত্য শিল্প বিজ্ঞান―  জীবনের এমন কোনো দিক নেই যে, তিনি স্পর্শ করতে বাকি রেখেছেন। ছিলেন কূটনীতিকও। মননে আদ্যন্ত আধুনিক ও কালাপাহাড়ি প্রবণতাও ছিল। তিনি মনে করতেন, জগতে কবি আসলে তিনজন―  কালিদাস, হাফিজ ও শেক্সপিয়র।

তলস্তয়ও গ্যোয়েটের ভক্তদের ভেতরে একজন। বিশ্বসাহিত্য ধারণাটি নিয়ে তিনিই প্রথম কথা তুলেছিলেন। নিজেকে মানে করতেন বিশ্বনাগরিক।... তাঁর রচনাবলি ১৪২ (একশ বেয়াল্লিশ) খণ্ডে গঠিত। মৃত্যুর সময় গ্যোয়েটের শেষ কথা নাকি ছিল, ইংরেজিতে করলে যা হয়― ‘লাইট, মোর লাইট।’

তিনি তলস্তয়ের ও রবীন্দ্রনাথের প্রিয়। ফলে বোঝা যায়, যে চার মহাপ্রতিভা― শেক্সপিয়র, গ্যোয়েটে, তলস্তয় ও রবীন্দ্রনাথকে আমরা মানি, তাঁদের ভেতরে গ্যোয়েটের অবস্থান কোথায়। ২৮ আগস্ট ছিল যোহান উলফগং ফন গ্যোয়েটের জন্মদিন, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।

লেখক: কথাসাহিত্যিক