জাহিদ সোহাগের একগুচ্ছ কবিতা

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৮

যাই যাই বসন্ত

ওই শীতের কথা মনে আছে, দেয়ালঘেরা উদ্যানে ওই শুষ্ক রেখাগুলো যেন শূন্যে চেয়েছে প্রার্থনা; মেঘবৃষ্টি, ঝুমঝুম, আর কেকা মিলনের অস্পষ্ট ধনি— বা এমনও হতে পারে, তার হৃদয়ে ফুল ফোটার ঋতুতে ফুল ফোটে;
আমরা দুজন হেঁটে হেঁটে চলি, ছায়ারৌদ্রে পাতাঝরা পথে, কথা হয় সামান্যই, যার যার কথা বেশিরভাগ নিজের সঙ্গেই বলা;
আমি কি আশ্চর্য হতে পারি মৌতাত ছাড়া? বা জুয়ার কোর্ট ছাড়া মুঠোয় নিতে পারি উত্তেজনা? সঙ্গিনী এইসব জানে না— এই অরণ্যে, তার কামিনী ফুটতে দেবো? —সে তলপেটে ঘুমন্ত রেখেছে করতালি;
ওই শীতের কথাই মনে আছে— এরপর তো বসন্ত, চড়ুই স্নানের জলও পেয়েছে রেখাগুলো, হাতে হাতে পেয়ে গেছে হলুদ খাম, ফুলআঁকা কাগজ উড়ছে হাওয়ায় হাওয়ায়, এমন একটা চিঠি অসতর্কে ধরে ফেলবে তুমিও— না জানি আবার ভুল প্রেমিকার ভর্ৎসনা কি না!
এই ভেবে ভেবে, যাই যাই বসন্ত, অষুধ খেয়ে খেয়ে শুধু ঢুলছি


কোনো এক গ্রামে

তুমি যে এলে বৃষ্টি দেখেছো? ঝমঝম রেলগাড়ির নিচে ওই লোহার হৃদয় ছুঁয়ে? কুলি আর চোরাগোপ্তা কিশোরের মুখে?
শুধু হাত বাড়ালে— এই ট্যাক্সি? আঙুলের ডগায় কি লেগেছে বৃষ্টি? পায়ে জলকাদা?
ওদিকে হয়ত বৃষ্টিই নেই। ক্রমাগত নীল জ্বলছে প্রিজম-ময়ূরে। যেন শাল-সেগুনের ডালপালা ভেঙে ভাবছো সহজেই চিনে নেবে পথ।
আমাদের গ্রাম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বসে আছে। হাতে ধানের চারা, একটু থামলেই নেমে পড়বো। আরো বৃষ্টি হবে? তোমাদের কাগজে কী বলে? নালায় পুঁটি-খলসের লাফালাফি থেমেছে। ছেলেমেয়েদের নাকে সর্দি, খুশখুশে কাশি। ঘরের মাচায় গরু-ছাগলও আছে কষ্ট করে।
যদি বৃষ্টি না-ও থামে, ভেবো না, নৌকা পেয়ে যাবে একটা, শিমুলপুর বেশি দূরে নয়, দেখবে দুটো তালগাছ গ্রামের মাথায় দিনরাত জেগে আছে, পথে দুটো সাঁকে পেরুতে হবে, হাতল নেই, অবশ্য ভেসে গেছে কিনা জানি না।

এমন গ্রামে বেড়াতে যাবার কথা তুমি লিখেছো। অথচ তোমার ট্যাক্সি সেই যে আসছে আসছে আসছে— আমি কবে থেকে দাঁড়িয়ে আছি ১৫/বি ঝুমকো লতার সামনে।

ফসফরাস

সারাদিন রৌদ্রে ধুলো ধুলো, সন্ধ্যায় হ্যাজাকের নিচে ফুটছে জল, যত না চায়ের পিপাসা, ভেতরে বাঘিনীর ছোপছোপ, ফুঁ দিয়ে দিয়ে তাতিয়ে রাখি তার গন্ধ;
আমার তো উপাস্য নেই, কাকে বলি সন্ধ্যাকে বাঁধো তুমি প্ররোচনায়, শুধু ব্যয়িত হতে জোয়ার তো ছেনে যায় না নৌকার হৃদয়;
ফিরে গেলে যে বিছানা, তা যে হারানো মায়ের অসুস্থতা ঘাম আর ঘৃণায় নিভে আছে— আমি চিৎকার করে ওই বৃদ্ধ রাতকে বলি, তোমার খুচরো পয়সাভরা আকাশের তলে আমি উটের মতো নিজের ভেতর থেকে পান করি;
দৃশ্যত তা নারীসংগ্রহ থেকে অনেক ফসফরাস

হোটেল আকাশ ইন:

এই রাস্তা হোটেলের দিকে গেছে। সামনে রেলক্রসিং, অসহ্য যানজট। কতদিন বিরক্ত হয়ে নেমে গেছি রিকশা থেকে। ওই হোটেলে আমি শীতল ড্রয়িংরুমে গল্প করি তপ্ত নারীদের সঙ্গে। এরা আমাকে নিয়ে রুমে যেতে চায়। আমি বলি, ‘সমঝোতা করে নাও, কে যাবে’— এরই মধ্যে যার সাথে আমার বেশি ভাব হয়েছে, তাকেই ওরা ঠেলে দেয়। যেন সে কতকালের ভালোবাসাবাসি!
আমি নিজের রক্ত পোড়াতে সিগারেট জ্বালাই। দু’একটা টান দিয়ে ওর হাতে দেবার ভঙ্গি করি, দেই না; শুরু হয় আবার আমাদের ছোঁয়াছুঁয়ি। ও ধৈর্য্যহীন হয়ে বলে, ‘চলো, রুমে চলো।’
আমি জানি, এরা দরোজার বাইরে যতটা উত্তেজক, ভেতরে কাফন খুলে আসা ঠাণ্ডা শরীর।

এই হোটেলের চারপাশে তরি-তরকারি লুটোপটি খায়। কচি লাউ থেকে ধনে পাতা, সব পাবেন : পেঁয়াজের ঝাঁঝালো গন্ধ আর রৌদের নিচে শূন্য ট্রাক।

গাঁজা

চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দেই। যেন এই দুপুর উন্মাতাল করে ডাকছে, ‘আয় আয়।’ আমি রৌদ্রের এসিড পান করি করোটি ভরে।
হাঁটতে হাঁটতে টের পাই কপালের দু’পাশে গেঁথে গেছে বর্শা— একটা প্যারাসিটামল খেয়ে কোথায় দাঁড়াবো! তারচেয়ে গুণ্ডামার্কা কিশোরদের খুঁজি— যেভাবে কুকুর প্রস্রাবের গন্ধ শুকে শুকে চলে— যারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে র‌্যানডম গাঁজা খায়। ছুরি চালায়। আজ তারা কোত্থাও নেই। একটা শূন্য দুপুর উল্টে দিয়ে গেছে শহরের ভাগ্যে। আমি আশা ছাড়ি না। কোনো একটা নির্জন দেয়াল দেখে জিপার খুলে দাঁড়াই। কেউ তো আসবে [প্রস্রাবের অযুহাতে] গাঁজার ঝটপট দম নিতে! এদিকে দুপুরের শেষেও আছে সন্ধ্যা। তখন না জানি এই দেয়ালটা হয়ে যায় তানপুরা।

প্রস্রাব

এবার আমি মূত্রথলির কথা বলবো। মূত্রথলির মাহাত্ম্যের কথা বলবো (আমি অবশ্য  জানি না মূত্রথলি ছাড়া অন্য কিছুর মাহাত্ম্য আছে কিনা)।
ওই যে মানুষটা হাঁটছে, বা নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান ভাবছে, বা নিদেনপক্ষে যে ঠেলা ঠেলছে— আমি শুধু মূত্রথলি দেখি। তাদের হাত-পা, মাথা-বুক-পেট সবকিছু, কোনো এক ফুৎকারে মূত্রথলির ভেতর ঢুকে গেছে।
তারা হাসছে মানে প্রস্রাব করছে, কাঁদছে মানে প্রস্রাব করছে। প্রস্রাব করার জন্যই তারা জন্মেছে। মরবেও প্রস্রাব করতে করতে।

প্রস্রাবের ধ্বনি ও সুখ, ধ্রুপদী।