জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা: একটি আলোচনা

পর্ব ১

জ্যোতির্ময় মুখার্জি

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৬, ২০১৯

আমার ছোটবেলা কেটেছে রূপকথার দেশেই। ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি, সুয়োরানি-দুয়োরানি, ব্যাং-রাজা ইত্যাদির ছবির খোঁজে প্রায়ই পাড়ি দিতাম কল্পনার সাতসমুদ্র তেরোনদীর পারে, আমার প্রিয় পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে। তখন তো মোবাইল ছিল না বা ভিডিও গেম, কার্টুন চ্যানেল। টিভি ছিল বটে, কিন্তু বয়স্কদের মতে টিভি দেখলে যেহেতু ছোটদের চোখ পচে যায় তাই টিভির সাথে বন্ধুত্ব হয়নি কোনোদিন। হলেও খুব একটা লাভ হতো বলে মনে হয় না, সেই তো গুরুগম্ভীর ডি.ডি। তাই ছোটবেলায় আনন্দ বলতে চুটিয়ে খেলা খেলা আর খেলা। মাটি মেখে ধুলো মেখে জলে ভিজে কাদা মেখে গাছে চড়ে পুকুরে সাঁতরেই কেটে গেছে আমার ছেলেবেলা। এসব রিয়ালিটির মাঝেই কল্পনার ফানুস উড়িয়ে দিতাম চাঁদমামা, শুকতারা, কিশোরভারতী, ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদার ঝুলি, আবোল তাবোল, ছোটদের রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদিতে। রূপকথার গল্প সমন্ধে তাই আমার একটা স্পষ্ট ধারণা ছিল বা আছে।

মলয় রায়চৌধুরী যখন বললেন, ‘তুমি আমার একটা গল্প আলোচনা করো’, তখন আমি ভয় পেয়ে গেলেও বিশ্বাস ছিল যে, কিছু একটা লিখতে পারব। কিন্তু সেই সমস্যা যে কতবড় পদক্ষেপ ছিল, তা বুঝতে পারলাম ‘জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা’ গল্পটি পড়তে গিয়েই। মলয় রায়চৌধুরীর ‘গল্পসংগ্রহ’তে অন্তর্ভুক্ত একটি কাহিনি। আত্মপ্রশ্নে ক্রমাগত আক্রমণ সয়ে যাবার পর ভাবলাম, জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা নামের কাহিনির বুনন ও বাঙালি ‘পলিটি’ সম্পর্কে মলয় রায়চৌধুরীর ভাবনাচিন্তা নিয়েই লিখি।

গল্পের নাম, জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা। প্রকৃত প্রস্তাবে এটি রূপকথা নয়, অরূপকথা, বাস্তবতা থেকে ছেঁকে নেয়া অতিবাস্তব রূপকথা। লেখা হয়েছে, ২০০৬-এ। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ বইটির একশো বছর পূর্তিতে। কাহিনির প্রধান চরিত্র এক যুবক শকুন, যার নাম শিলাদ, সে শকুন পরিবারের শেষ সদস্য। কিন্তু সেই অর্থে শিলাদ কেন্দ্রীয় চরিত্র নয়। শিলাদের ক্রম পরিবর্তনশীল কায়া, আকার, রূপ, জীবন ও যাপনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেছে গল্পস্রোত এবং পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গের জীবনযাপনকে। অবশ্য  শিলাদের সঙ্গে সঙ্গে এগোয়নি গল্প, ও গল্পটি ওপন এনডেড। পোস্টমডার্ন বলা হবে নাকি হাইপাররিয়াল? কনফিউজড্? দেখা যাক। আসুন, এবার তবে ঢোকা যাক গল্পের মধ্যে। গল্পের মূল কাহিনিটা ঠিক এইরকম, শিলাদ নামক একটা শকুন যে তার দাদুর সঙ্গে গভীর আকাশে উড়ছিল, দাদুর সান্নিধ্য থেকে হারিয়ে গিয়ে, গল্পের ধাপে-ধাপে সে অন্যান্য প্রাণিতে পরিবর্তিত হয়েছে। প্রথমে পেঁচা তারপর টিকটিকি (গিরিগিটি) তারপর মাছ তারপর বাঘ এবং শিকারির গুলিতে সুন্দরবনের নদীতে সমুদ্রের দিকে ভেসে গেছে সে।

তার চামড়া ছাড়ানো দেহের ওপরে বসে তার দাদু তার নাম ধরে ডাকলেও সে শুনতে পাচ্ছে না। শিলাদের এই প্রতিটি রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেছে কাহিনি। শিলাদের চোখ দিয়ে দেখছি পৃথিবী আর কান দিয়ে শুনে নিচ্ছি পৃথিবীর অরূপকথন। জল, স্থল, অন্তরীক্ষ, জঙ্গল, ভূগর্ভ থেকে, দিনে ও রাতেও। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চেয়েছেন গল্পকার, শিলাদের অস্তিত্ব বিশ্লেষণের মাধ্যমে। মুভি ক্যা মেরা নিয়ে পশ্চিমবাংলার রূপান্তরিত ঘটনাবলির পেছু নেবার মতো। এখানে ক্যা মেরা হলো শিলাদ আর জীববিজ্ঞানী ক্যা মেরাম্যারন? মলয় রায়চৌধুরী। গল্পের কাহিনী এগিয়েছে ক্যাামেরা ম্যানের সাথে সাথে উত্তরাধুনিক ক্যামেরার পরিবর্তিত অবস্থান ও লেন্সে। গল্পটি পড়তে পড়তে তাই আমরা যা পড়ছি, মানে গল্পের মূলটেক্সট,  তার বাইরেও রয়েছে আরো একাধিক সাবটেক্সট। যা বলা হচ্ছে না, বা যা লেখা নেই। পাঠককে সবই একসঙ্গে বিশ্লেষণ করতে-করতে এগোতে হবে, সমান্তরাল ভাবে। গল্পের মধ্যে ছাড়া আছে সেই পরিসরগুলো, যার মধ্যে দিয়ে পাঠক অনায়াসে ঢুকে জেনে নিতে পারেন না-লেখা সাবটেক্সটগুলো।

গদ্যের নির্মাণ করা হয়েছে এমনভাবে যাতে পাঠক প্রতিমুহূর্তে পরিসর খুঁজে পায় গল্প থেকে গল্পের বাইরের ইশারাগুলো বুঝে নেয়ার। পাঠককে গল্পটি পড়ার সময়ে এগোতে হবে একাধিক দিক থেকে, একইসাথে, মস্তিষ্কের রসায়নে। মলয় রায়চৌধুরীর রচনামাত্রেই সিরিয়াস অনুধাবন দাবি করে। মুসলমান শাসকরা বঙ্গদেশকে বলতেন জিন্নত-উল-বিলাদ। অর্থাৎ মর্ত্যের স্বর্গ। কিন্তু গল্পের প্রেক্ষাপট অখণ্ড বাংলা নয়, মূলত পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে। উত্তর ঔপনিবেশিক পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থনৈতিক, প্রসাশনিক, শিক্ষাব্যলবস্থা ইত্যাদির কঙ্কালটা চোখের সামনে ঝুলিয়ে দেয়াই মলয়ের ঝুলির এই আড়ালে অরূপকথনের লক্ষ্য। ‘যাতুধান তরফদার…. এই দেশের এক অতি বৃদ্ধ শকুন, এককালের বিশাল পরিবারের অভিজ্ঞ কুলপতি, যার পরিবারে যুবক নাতি শিলাদ ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই।’ উত্তর-ঔপনিবেশিক পশ্চিমবাংলায় ক্রমশ ভেঙে পড়ছে একান্নবর্তী পরিবারগুলো। টুকরো টুকরো হয়ে পড়ছে পরিবারগুলোর গঠন ও সামাজিক দায়দায়িত্ব এবং মূল্যরবোধ। যৌথ-পরিবারের শেষ উত্তরাধিকারী মলয় রায়চৌধুরীর কি দীর্ঘশ্বাস পড়েছে যাতুধান তরফদারের বুকের ভেতর থেকে?

তার ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ কি প্রতিফলিত এই অরূপকথনে? জানি না। কিন্তু প্রাক-ঔপনিবেশিক সাবটেরানিয়ান এথনিক বাঙালিয়ানা যে আর সম্ভব নয় সেটা মলয় রায়চৌধুরীর’ বিভিন্ন প্রবন্ধে আমরা পড়েছি। খোপ-বাড়ির খোপে খোপে বাস করা বাঙালির চিন্তা জগতেও যে দৈন্যতা প্রকট হয়ে উঠেছে এই ব্যাোপারেও মলয় রায়চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধগুলোতে বিশ্লেষণ করেছেন, বিশেষ করে তাঁর ‘উত্তরদার্শনিকতা’ প্রবন্ধে। বহুত্বের পাঁচমেশালি পঞ্চরত্ন বা লাবড়া নয়, বাঙালি তৃপ্ত আজ আলুভাতে ডালভাত আর পোস্তগোলাতেই। একান্নবর্তী পরিবারের  বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে যে বহুমাত্রিক সম্পর্ক ও তার টানাপোড়েন, বিতর্ক-বিবাদের পর’ও একসাথে, একই ছাদের নিচে, বাস করার যে সহনশীলতার শিক্ষা, তা থেকে বাঙালি আজ বঞ্চিত। বঞ্চিত নিজেকে বহুধায় বিভক্ত করতে, যার প্রভাব পড়ে জনজীবনে, সমাজে, সংস্কৃতিতে, রাজনীতিতে, চিন্তায় ভাবনায়, লেখালেখি শিল্পজগতে। মলয় রায়চৌধুরী, স্বীকার করেন যে, লেখালেখি ঘরের দরজা জানলা এঁটে সাধনা নয়। মানুষ ও সমাজবর্জিত হয়ে চিন্তাজগতে ঢেউ তোলা নয়। তাতে সাহিত্য খন্ডিত বা একপেশে হয়ে পড়ে, তাতে আর যা হোক সমাজের আসল চিত্রটি প্রতিফলিত হয় না। লেখক-শিল্পী যত মানুষের সাথে মিশবেন, যত সমাজের আনাচে কানাচে পৌঁছাবেন তত পুষ্ট হবে তার অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার ইরিটেশনেই নির্মিত হবে সাহিত্য, শিল্প।

মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে উৎপলকুমার বসু লিখেছেন যে, ‘বাংলা সাহিত্যের প্রধান ধারাটি একপ্রকার স্থিতাবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল। তার বাঁধ ভেঙে দেয়া ছাড়া উপায় ছিল না। তিনটি উপন্যাস ও স্মৃতিচারণেও মলয় রায়চৌধুরীর ওই আক্রমণকারী প্রবণতা লক্ষ করি। কথা প্রসঙ্গে তিনি একবার বলেছিলেন— “লেখা রাজনীতি ছাড়া আর কী হতে পারে।” বলা বাহুল্য, তিনি দলীয় বা সংসদীয় রাজনীতির কথা বলেননি। তিনি বলেছেন, “পলিটি”র কথা। আমরা সবাই মিলে কীভাবে থাকব— মলয় রায়চৌধুরী তারই একটা বোঝাপড়ার দলিল তৈরি করেছেন।

চলবে