জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা: একটি আলোচনা

পর্ব ২

জ্যোতির্ময় মুখার্জি

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৭, ২০১৯

‘জিন্নতুলবিলাদ’ সম্পর্কিত কাহিনি জুড়েই লেখকের এই অভিজ্ঞতা বা শিলাদের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক মননের জার্নিটা স্পষ্ট। জল-স্থল-অন্তরীক্ষ, দিন-রাত, জঙ্গল-নদী, আন্ডার গ্রাউন্ড-মাল্টিপ্লেক্স, বেশ্যাকপল্লী-ক্লাসরুম  ইত্যাদি সময় পরিবেশ ও অবস্থানের যে বর্ণনা আমরা পাই এবং তার সাথে সাথে যেভাবে পাল্টে যাচ্ছে মানুষের প্রকৃতি তা যে মোটেই ভাববিলাসে লিখিত নয়, এইটুকু স্পষ্ট বুঝে নেয়া যায়। ঘটনা, পরিবেশ ও চরিত্রের এই নিঁখুত নির্মাণ বা শার্পনেস্ স্পষ্ট করে দেয় যে, এ সবই লেখকের অভিজ্ঞতালব্ধ। আমরা জানি যে গ্রামোন্নয়ন অফিসারের চাকরিতে তিনি প্রায় চল্লিশ বছর ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার, গ্রামে-গঞ্জে চাষি, তাঁতি, জেলে, ছুতোর, খেতমজুর ইত্যাদি মানুষের জীবনযাত্রা খুব কাছ থেকে দেখেছেন, লেখার সততা রক্ষার জন্য কলমকে অবশ্যই হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে হবে সমাজের কোণে কোণে। শুধু আলোলাগা পথে পথে নয়, ছায়ামায়া গলিতে গলিতে নয় এমনকি কালোআলো সুড়ঙ্গেও। সমাজের প্রতিটি অন্ধকার, নগ্ন, পুঁজমাখা ক্ষতকেও লেখার মধ্যে ধরতে পারলেই লেখাটি তার সততা রক্ষা করবে। তুলে ধরতে পারবে সমাজের প্রকৃত ছবি। তাহলেই পাঠক অনায়াসে নিজস্ব দৃষ্টিপ্রতিভা ও মন দিয়ে পড়ে নিতে পারে সমাজের প্রকৃত চিত্রটিকে। লেখকের কাজই হলো লেখার এই সততা রক্ষা করা এবং সেই লক্ষ্যের পথে যাবতীয় বাধা ও ঠিক-ভুলের দ্বন্দ্ব, ন্যায় অন্যায়ের যাবতীয় বেড়াগুলোকে ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে যাওয়া। লেখার জায়গায় লেখকই নির্মাণকর্তা। আর ঈশ্বর যখন, তখন বিরাজ করবেন সর্বভূতে।

গল্পকার উত্তরঔপনিবেশিক বাঙালির বাস্তবজীবনকে অনবরত স্ক্যানিং করে গেছেন। পাঠবস্তু নির্মাণে তাই কোনো বাছবিচার নেই। নেই নেকুপুসু মার্কা শ্লীল-অশ্লীলের দ্বন্দ্ব। গল্পের সাবজেক্ট পজিশনেও তাই বহুত্বের যথেচ্ছাচার স্পষ্ট। গল্পের হাঁ-মুখে সেঁধিয়ে গেছে বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম, শিক্ষা, সন্ত্রাসবাদ, যৌনতা ইত্যাদি। অনায়াসে সবকিছুকে আত্মসাৎ করে নিয়েছে পাঠবস্তুটি। কখনো পাশাপাশি আবার কখনও বা একটার সাথে আর একটা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে অবস্থান করছে। পাঠককে যে সবসময় পাকগুলো খুলে খুলে পড়তে হবে এমনও নয়। পাঠবস্তুটি সবকিছু গলাধঃকরণ করে নিজেই একটা আলাদা সাবজেক্ট-বহুত্ব গড়ে তুলেছে। সবজিগুলো তাই তাদের একই খেতে উৎপাদিত  হয়েই খুশি। অথচ কনট্রাস্টটি হলো পাঠবস্তুটি যখন বহুধায় বিভক্ত তখন শিলাদকে সামনে রেখে গল্পকার মলয় রায়চৌধুরী নির্মাণ করে গেছেন ব্যনক্তির নিজস্বতা বা ইউনিকনেস। একদিকে গল্পের কৌম-পরিসর বাড়িয়েছেন, খুলে দিয়েছেন পাঠবস্তুকে। অপরদিকে ব্যক্তি আসক্তিকে একক হিসাবে ধরে ব্যক্তির ভালোলাগা, মন্দলাগা, সাদা কালো ধলো দিয়ে নির্মাণ করেছেন ব্যক্তির নিজস্বতা। সামাজিক জীব হয়েও ব্যড়ক্তি এককের নিজস্বতা বা ইউনিকনেস নির্মাণের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন পুরো অরূপকথন জুড়ে।

‘আমি সত্যিই কনফিউজড, ঘুমন্ত ঘুমে ঘুমিয়ে থাকা শিলাদ ঘুমের মধ্যে নিজেকে দিয়ে বলালো।’ মানুষ সামাজিক জীব হলেও যে সে আদতে আলাদা বা ইউনিক, প্রতিটি মানুষেরই যে কৌম এবং নিজস্ব আইডেন্টিটি থাকা উচিত, সে যে ভিড়ের মাছ নয় বা পালের ভেড়া নয়, সে যে চিন্তা করার ক্ষমতাসম্পন্ন  মানুষ এটাই বারবার হাইলাইট করেছেন শিলাদের চরিত্র নির্মাণে। আবার নির্মাণের সাথে সাথে তিনি ভেঙে ফেলেছেন নির্মিত চরিত্রের ইঁট-বালি-রড-পাথর। ব্যাক্তি এককের আইডেন্টিটি বা ইউনিকনেস নির্মাণ ও বিনির্মাণের খেলা চলেছে পুরো অরূপকথন জুড়ে। ‘রাতের জীবন চেয়ে শেষে কি এই ঘন অন্ধকার জুটল?’ ক্রিয়েট করেছেন আইডেন্টিটি ক্রাইসিস। বারবার। বারবার শিলাদ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে নিজেকে নিয়ে, নিজের পরিচয় নিয়ে, আত্মজিজ্ঞাসায় আক্রান্ত হয় । ‘জীবনের মানে খুঁজতে চাই। নিজেকে ডিফাইন করতে চাই।’….’আমি একটা পারপাস চাই, অতিরঞ্জন চাই, কর্মব্যস্ততা চাই।’ আবার ঠিক পরক্ষণেই ‘কেয়ার ফ্রি লাইফ চাই আমি, কাঁধের ওপর উদ্দেশ্যপূর্তির নোংরা বস্তা যাতে না বইতে হয়। আই ওয়ান্ট টু জাস্ট ফ্রিক আউট, জাস্ট চিল, হ্যাভ ফান।’ পাঠককে খুব সচেতন ভাবে খেয়াল রাখতে হবে এই ভাঙা-গড়ার খেলাটি। ‘আমি তো অন্যরকম জীবন চেয়েছিলুম’ ; কীভাবে সময়, পরিবেশ, পরিস্থিতি, সুযোগ, লোভের তালে তালে মানুষ পাল্টে ফেলে তার রং। ‘স্বপ্নভঙ্গ বলে কিছু হয় না, অবস্থা বুঝে নিজেকে বদলাতে হয়। তার ফলে জীবনের উদ্দেশ্য আপনা থেকেই পাল্টি খায়।’

‘এসে পড়েছে যখন-তখন সঙ্গমের অবরোহী ঋতু, শকুন যুবতীর খোঁজে বহু ব্যর্থ ওড়াউড়ির শেষে, সাতসকালে, একজন বয়স্কা ভূবনচিল যখন বটগাছের ন্যাড়া ডালে বসে তৃপ্তি করে মুর্গিছানার হৃৎপিণ্ড চোষায় মগ্ন, শিলাদ তার অন্যমনস্ক পিঠে আলতো করে নেমে, ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল। অসবর্ণ সঙ্গমের হবোহবো মুহূর্তে, ওই চিলগৃহিণীর পরিবারের লোকজন শিলাদকে ঘিরে ফেলে হৈ-চৈ বাধাতে, প্যাঁদানির ভয়ে মেঘের এগলি-সেগলি হয়ে ও পালায়, চিলেদের অনধিগম্য আকাশে, যেখানে ওকে হাঁপাতে দেখে, জেরা করে সবকিছু জানার পর, যাতুধান ওকে বুড়ি শঙ্খচিল, খুকি উটপাখি আর সোমত্ত টার্কিদের নামঠিকানা বাতলায়, যাদের ওপর আচমকা বসে তাড়াতাড়ি পায়ুসঙ্গম বা ধর্ষণ সেরে কেটে পড়া যায়, যদিও তাতে মন ভরবে না, উল্টে আনচান বেড়ে অসুখ করবে। বাট দেন, দ্যাট ইজ লাইফ।’.….যৌনতা এবং জাতিপ্রথার দ্বন্দ্ব এসেছে এভাবেই, স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। জীবনের অংশ হিসেবে নয়, সমাজের সদস্যদের জীবনযাপনের অবিচ্ছেদ্য ক্রিয়া হিসাবে। ইয়েস্ দ্যাতট্ ইজ লাইফ। মলয় রায়চৌধুরীর লেখায় অবশ্য এটাই স্বাভাবিক।

সনাতন ভারতবর্ষে যৌনতা নিয়ে এখনকার মতো ভিকটোরিয় বাছবিচার ছিল না, বরঞ্চ যৌনতা ছিল জীবন-শিল্প-সাহিত্যের স্বাভাবিক শর্ত। দেখা হতো লেখাটি নবরসকে মান্যতা দিয়েছে কিনা। আর শৃঙ্গার তো নিজেই আদিরস। যৌনতা ব্যরভিচার নয়, সনাতন ভারতবর্ষে যৌনতা আবশ্যিক যাপন। ক্রমশ ইসলামি শাসন তারপর খ্রিস্টধর্মি যাযকদের চাপানো মূল্যহবোধে মাথা গেঁজিয়ে এবং দেখনদারি হিন্দুয়ানার দাপটে ভারতবর্ষের এই স্বাভাবিক ব্যা পারটাই অস্বাভাবিক বা অশ্লীল হয়ে পড়েছে। মলয় রায়চৌধুরীর লেখায় আমরা সনাতন ভারতবর্ষের সেই স্বাভাবিক যৌনতাকে রিগেন করতে দেখি স্বতঃস্ফূর্তভাবে। মলয় রায়চৌধুরীর লেখায় যৌনতা আরোপিত নয় বা লেখায় মশলা মেশাবার উদ্দেশ্যেও নয়। হাগা-মোতা-খাওয়া-শোওয়ার মতোই যৌনতা এসেছে দৈনন্দিন যাপনে। আবার ওনার লেখায় যৌনসংসর্গের অভাবহেতু যেমন যৌনতার হাহাকার দেখি তেমনি দেখতে পাই ক্রমাগত সেক্স করতে করতে মেন্টাল ফ্যা টিগনেস। ‘আমার এই জীবন এমনই সুখী যে ভীষণ রিপিটিটিভ হয়ে গেছে, প্লিজ ডু সামথিং, একদম ভাল্লাগছে না। এরকম খাও-দাও-সঙ্গম করো জীবনের মানে হয় না’ যৌনক্রিয়া বা সেক্সকে তিনি বিভিন্ন ডাইমেনশনে ধরেছেন। সেক্সকেই একটা নিজস্ব চরিত্র করে তুলেছেন, যা প্রয়োজন ও অপ্রয়োজনে, স্বভাবে ও অভাবে ক্রমাগত বদলে বদলে ফেলে তার আদল। শকুন-শিলাদ যখন যৌনসঙ্গী এবং জীবনসঙ্গীর অভাবে ইভটিজিং ও ধর্ষণে উদ্যশত তখন মাছ-শিলাদের সে সাহস নেই। সে দূর থেকেই দৃশ্যঅসুখে ও কল্পনায় পরিতৃপ্ত হতে বাধ্য। কিন্তু আপনা হাত জগন্নাথ নয়। ‘যারা পাত্তা পায় না তারা মাছকুমারীটাকে লক্ষ্য করে ফিচিক-ফিচিক বীর্য ছোঁড়ে। শিলাদের অনেকটা জমে ভাঁড়ার থইথই টসটস রসরস, কিন্তু ছুঁড়ে অপচয়ের মানে হয় না বলে যোগ্য-অযোগ্য যে-কাউকে খুঁজে বেড়িয়েও জোটাতে পারেনি।’…..স্বমেহনকে মলয় রায়চৌধুরী একবারো যৌনক্রিয়ার মধ্যে ফেলেননি। এটা আমার বেশ আবাকই লেগেছে, বরঞ্চ মাছ-শিলাদ খোঁজ করছে সমকামী সঙ্গীর। ‘মাছসমাজে সমকামের গোপন গোষ্ঠীটার সাকিন-ঠিকুজি জানলে কিছুটা অন্তত দুঃখামৃত বেরিয়ে যেত।’

চলবে