জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা: একটি আলোচনা

পর্ব ৩

জ্যোতির্ময় মুখার্জি

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৯, ২০১৯

শকুন শিলাদের মধ্যে আবার দেখতে পাই খাদ্যিযোগ্য পাখিদের খাদ্য হিসাবে নয়,  যৌনক্রিয়ার খেলনা হিসাবে ভাবছে। ‘সবরকম রঙের প্রাণী খেলে স্বাস্থ্য নাকি ভালো থাকে। অথচ শিলাদের ইচ্ছে করে রোজ একটা রঙ বেছে নিয়ে সেই রঙের পাখির পিঠে বসে, মাথার চাঁদিতে চঞ্চু টিপে ধরে, দুপাশে ডানা নামিয়ে ইয়ে করে।’ অর্থাৎ তারমধ্যে নারীদের সেক্স এলিমেন্ট হিসাবে দেখার প্রবণতা প্রবল। শুধু অভাবে নয়, স্বভাবেও সে ইভটিজার ও ধর্ষণকারী। কখনো বাস্তবে আবার কখনোবা কল্পনায়। বাসে ট্রেনে রাস্তা ঘাটে শকুন-শিলাদের যে অভাব নেই সে তো স্পষ্ট আর ধর্ষণের বিরামহীন ঘটনায় শকুন-শিলাদরা যে শুধুই যৌনসঙ্গীর অভাবে ধর্ষণ করে এমন নয়, মানসিক চরিত্রের অভিঘাতেই একজন মানুষ ধর্ষক হয়ে ওঠে, ‘এসে পড়ে যখন তখন সঙ্গমের অবরোহী ঋতু’। অপরদিকে প্যাঁচা-শিলাদের সুখী ও পরিপূর্ণ সেক্স লাইফ। খাও-হাগো-শোও আর সেক্স করো, শোও-হাগো-খাও আর সেক্স করো। সুন্দরী ও তৃপ্তিযোগ্য সেক্স পার্টনার, সেক্সকে আকর্ষণীয়, নিত্য-নতুন রঙিন করে তোলার জন্য বিছানার ডেকরেশনে অনবরত পরিবর্তন, তবুও প্যাঁচা-শিলাদ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। চিন্তা নেই, ভাবনা নেই, কাজ নেই, কর্মব্যস্ততা নেই, শুধু সেক্স সেক্স আর সেক্স,  একটা প্রাণীকে ক্লান্ত করে তোলার জন্য যথেষ্ট।

‘শিলাদ বুঝতে পারছিল যে, খারাপ লাগার ক্রিয়াটা রয়েছে ওর নিজের প্যাঁচা-মস্তিষ্কে, ঘাপটি মেরে, তাতে ফর্সা-তামাটে-কালোর কিছু করার নেই, চব্বিশ ঘণ্টা অহরহ সঙ্গম করেও তা যাচ্ছে না, নানা সুরের মিউজিকাল কনডোম পরা সত্ত্বেও। সেক্সের জন্য লাইফ নয়, লাইফের জন্য সেক্স। যৌনতাকে আলোকিত করার জন্য লেখা নয়, লেখার প্রয়োজনেই যৌনতা আসবে স্বাভাবিক ভাবে, মলয় রায়চৌধুরীর এই বার্তা স্পষ্ট বুঝে নেয়া যায় এই অরূপকথন থেকে। আবার গিরিগিটিরূপী শিলাদের সেক্স লাইফ দ্রুত, ঝটিতি, স্যা টাস্যাবট মাল খসিয়ে খালাস। ‘ওরফে গরম-গরম উত্তেজিত স্বরে বলল, কী রে রঙিলা স্পাই, টিপতে এসছিস মাই, নে, কত টিপবি; বি কুইক অ্যান্ড ফাস্ট।’ যুবতীটির নাম ‘ওরফে’, যৌনকর্মীরা যেমন প্রতি সন্ধ্যায় নাম পালটে নতুন নাম রাখে. সেই সতত নাম পরিবর্তনকে ‘ওরফে’ শব্দের সাহায্যে আক্রমণ করেছেন মলয়। আমরা দেখেছি, পার্কে, হোটেলে, ঝোঁপেঝাড়ে রকেটসেক্স ঘটতে। তাও তো রকেটসেক্সের পিছনে কারণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে সেক্স এন্ড ওনলি সেক্স। কিন্তু বাঘ-শিলাদের সেক্স লাইফ আবার শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের জন্য। কোনো উপভোগ্য যৌনক্রিয় নয়, জাস্ট প্রয়োজনের তাগিদে ঝটতি সেক্স। গড় বাঙালির সেক্স লাইফ তো আদতে তাই-ই। আমাদের সমাজ ও ধর্মের জ্যেঠামশাইরাও ভাবেন ঠিক এমনই। যৌনতা সন্তান উৎপাদনের তরে, পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা, আর নারী সেই সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। বাঘ-শিলাদের সেক্স এক্সপেরিয়েন্স বর্ণানায় সন্তান উৎপাদনের প্রয়োজনে আসা সেক্স পার্টনারের মুখ দিয়ে বারবার ‘হালুম’ শব্দের প্রয়োগ কি এই সেক্স নিয়ে অচলায়তন ধারণাকে টিটকারি মারা? ব্যাঙ্গ করা? হয়তো তাই।

কাহিনির বাকি অংশের সাথে ‘হালুমের’ রিপিটেশন খাপ খায় না। এই অংশটি পড়তে বেশ বিরক্তি লাগে, দুর্বল লাগে গল্পের বুনোটে। ‘ল্যাজের অবগুণ্ঠন সরিয়ে আগে আমার স্ত্রীযন্ত্রের অগরু শোঁকো মুখপোড়া, হালুম, তবে তো বুঝবে, হালুম, আমি অনঘ-নিরঞ্জন হিটে আছি কি না, হালুম, নাক দিয়ে হৃদয়ে সৌরভবার্তা গেলেই, হালুম, দেখবে বাদবাকি কাজ আপনা-আপনি ঘটে যাচ্ছে, হালুম।’ হয়তো বিরক্তি সৃষ্টি করাই এই দুর্বল বুননের উদ্দেশ্য। পাঠকের লিঙ্গ দাঁড়াবে না বা সেক্স ফিল হবার সুযোগটুকুও দিতে চান না গল্পকার। বাঘ-শিলাদের সেক্স এক্সপেরিয়েন্স বর্ণনার মধ্য দিয়ে তিনি করে ফেলেছেন ঘর ঘরকা সেক্স এক্সপেরিয়েন্স বর্ণনা। ‘ভারজিন যুবকের বীজ নিলুম, হালুম, আনন্দ নিলুম, হালুম, চললুম, হালুম।’ আর সেক্স পরবর্তী মানসিক অবস্থার সাথেও বেশ পরিচিত বেশিরভাগ বাঙালিরা বিশেষ করে বাঙালি বধূরা। শুধু তাই নয় সমাজে অসম বয়স্ক যৌনক্রিয়ার চাহিদাকেও তিনি দেখিয়েছেন অনায়াসে, ‘হ্যাঁ, আজকাল তো বয়স্কা বাঘিনীরা টয়বয় খোঁজে।’

যৌনতা নিয়ে মলয় রায়চৌধুরীর এই দ্বিধাহীন স্পষ্ট ও বহুরৈখিক ভাবনার পরিচয় পাই হাংরি আন্দোলনের সময় থেকেই। তার বিখ্যাত কবিতা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত যৌনচেতনা। এই কবিতাটির উপর অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছিল। যদিও আমার মনে হয় প্রশাসনের কাছে এই অশ্লীলতার অভিযোগটি করার উদ্দেশ্য ছিল যেনতেন প্রকারেণ একটা অভিযোগ খাড়া করা। কোমরে দড়ি বেঁধে ঘোরানোর মানসে করা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ধোপে টিকবে না দেখে, এবং সেই অভিযোগটা আদালতে এনে ফেললে নিজেদেরই নিম্নদেশ বস্ত্রহীন হবে দেখে, অশ্লীলতার অভিযোগটিকেই ভেসে যাওয়া খড়খুটো হিসাবে ধরা। যদিও এই অভিযোগটিতে মলয় রায়চৌধুরীর লাভ হয়েছিল প্রচুর, ও ক্ষতিও। মামলা চলাকালীন সময়ে মলয় রায়চৌধুরীর নিঃসঙ্গে, কপর্দকহীন, অসহায় ও অসহ্য জীবনের কথা মাথায় রেখেও বলব এই অভিযোগ রাতারাতি মলয় রায়চৌধুরীকে হেডলাইন বানিয়ে ফেলেছিল। দেশে ও বিদেশেও।

এই একটি কবিতা মলয় রায়চৌধুরীকে খ্যাতির চূড়ায় টেনে তুলেছে, তাঁকে মিথ বানিয়ে তুলেছে। এই ব্যিপারটা আমরা সবাই জানি, নতুন করে আর কিছু বলার নেই। হাংরি আন্দোলন ও ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ নিয়েও কোনো একদিন আমার মতামত লিখব কোথাও। দীর্ঘ প্রস্তুতি ও চিন্তা ভাবনা সত্ত্বেও কীভাবে একটা ছোট্ট ভুল এক আলোকবর্ষ দূরত্বের ঠিকানা খুঁজে নিয়েছিল বলব সেটাও কোনো একদিন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে গ্রেপ্তারি ও কবিতাকেন্দ্রিক মামলা, এই ঘটনাটি মলয় রায়চৌধুরীর ক্ষতিও করেছে প্রচুর এবং করে চলেছে আজও। ব্যক্তি মলয় রায়চৌধুরীর কথা অনুমান করতে পারি, কিন্তু সৃষ্টিশীল মলয় রায়চৌধুরীর ক্ষতিটা অপরিসীম। মলয় রায়চৌধুরীকে মিথ বানিয়ে আর ওই একটি কবিতাতে মগজ নয় শুধু হাত সেঁকেই মলয় রায়চৌধুরীকে পাঠক-পাঠিকারা স্যা লুট ঠোকে বারংবার। এই পপসঙ্গে জিন্নতুলবিলাদে একটি চরিত্রের উক্তি প্রসঙ্গিক: ‘আমাকে কেউ শ্রদ্ধাভক্তি করে না, ওরা জাস্ট আমার কংকালটাকে ভয় পায়। কেননা কংকালটা হল আমার রাজনৈতিক জীবনের কিংবদন্তি।’ মলয় রায়চৌধুরীর রচনাগুলোর আগে-আগে ছোটে ওনার কিংবদন্তি। অথচ ওনার লেখা পড়ে যেটুকু বুঝেছি, প্রায় শতাধিক বই আছে ওনার, উনি বারবার চেয়েছেন বা মনে করেন, লেখক নয়, রচনা-বিশেষের গুরুত্ব থাকা উচিত পাঠকের কাছে। অথচ ওনার ক্ষেত্রে ঘটে ঠিক উল্টোটাই। সাধারণ পাঠক-পাঠিকা ওনার অন্য লেখা পড়েন না বা পড়তে চান না, ওই একটা কবিতা দিয়েই দূর থেকে মেপে নিতে চান মলয় রায়চৌধুরীকে। অথচ যখন তিনি বারবার বদলে ফেলছেন তাঁর গদ্যের ডিকশন, কবিতার ফর্ম, সিরিয়াস পাঠক ছাড়া  খেয়াল করেন না সেটা।

চলবে