‘জীবন খুব ছোট, গুজবে কান দেয়ার সময় নেই’

ওয়ালী নেওয়াজ

প্রকাশিত : আগস্ট ১২, ২০১৮

নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক স্যার বিদ্যাধর সূর্য প্রসাদ নাইপল (ভিএস নাইপল) পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পাড়ি জমালেন না-ফেরার দেশে। আর তিনি ফিরে আসবেন না। কিন্তু রেখে গেলেন তার পৃথিবী ভ্রমণের কিছু চিন্তা। অক্ষরে যা তিনি গেঁথেছেন তার সাহিত্যকর্মে।
অবশ্যি বেশ পরিণত বয়সের পৃথিবী নামক গ্রহটি ছাড়লেন। ৮৫ বছর বয়সে লন্ডনে নিজ বাড়িতে শনিবার তিনি মিশে গেলেন অনন্ত মহাশূন্যে। ১৯৭১ সালে বুকার এবং ২০০১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া নাইপলের জন্ম সাবেক ব্রিটিশ ঔপনিবেশ উত্তর আমেরিকার ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র ত্রিনিদাদে, ১৯৩২ সালের ১৭ আগষ্ট।  বাবা ছিলেন সেখানকার ব্রিটিশ রাজকর্মচারী।

ইংরেজি সাহিত্য পড়ার জন্য নাইপল বৃত্তি নিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ১৯৫০ সালে ইংল্যান্ড আসেন। ১৯৫৪ সাল থেকে স্যার বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নাইপল ইংল্যান্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। তবে তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন পৃথিবীর নানা স্থান ঘুরে বেড়িয়ে। ব্রিটিশ সংস্কৃতির স্তম্ভ হওয়া সত্ত্বেও তিনি আধুনিক শিকড়হীন জীবনের প্রতীকও হয়ে উঠেছিলেন।

বিশ্ব সাহিত্যে ভিএস নাইপল ঔপন্যাসিক হিসেবে বেশি সমাদৃত হলেও তিনি ইংরেজি ভাষায় কমিক্স ও প্রচুর ভ্রমণকাহিনি এবং প্রবন্ধ লিখে রেখে গেছেন। প্রায় পঞ্চাশ বছরের লেখালেখির জীবনে ফিকশন, নন-ফিকশন মিলিয়ে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিরিশটির বেশি।

নিজের সম্পর্কে ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই কথাসাহিত্যিক বলেছিলেন, ‘আমার জীবন খুব ছোট, গুজবে কান দেয়ার সময় নেই।’ সত্যিই গুজবে কান দেননি আত্মমগ্ন ধ্যানী এই কথাকার। তা না-হলে একের পর এক লিখতে পারতেন না ‘দ্য ম্যাজিস্টিক ম্যাসিওর’, ‘দ্য সাফরেজ অফ এলভিরা’, ‘মিগ্যাল স্ট্রিট’, এ হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস’ এবং ‘দি এনিগমা অফ অ্যারাইভালে’র মতো কালজয়ী উপন্যাস।

নোবেল কমিটি নাইপলের সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছিল, ‘তার লেখা ভুলে যাওয়া ইতিহাসকে নতুন আঙ্গিকে আমাদের সামনের তুলে ধরার প্রয়াস পায়।` নাইপল সমালোচনামূলক মন্তব্য করে বারবার আলোচিত হতেন। কথনও লেখিকাদের নিয়ে, কখনও আফ্রিকা, ভারত বা ইসলাম নিয়ে।

একবার তো সোজাসুজি বলেই দিলেন, ‘মেয়েরা আবেগপ্রবণ, তাদের লেখালেখিতেও সেই সঙ্কীর্ণ চিন্তাধারা থাকে। এ কারণেই জেন অস্টেন থেকে ঝুম্পা লাহিডী কেউই সাহিত্যিক হিসেবে প্রথম শ্রেণির নন।’ ‘অ্যান এরা অব ডার্কনেস’-এ নিজের পূর্বপুরুষদের দেশ ভারতের অপরিচ্ছন্নতা তিনি বর্ণনা করেছেন কড়া ভাষায়।

আফ্রিকা নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘ঠিক-ভুলের কোনও ব্যাপার নয়, ঠিক ব্যাপারটাই এখানে নেই।’ ইরান ও ইরাক থেকে পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ঘুরে সেখানকার মুসলিম জনজীবন নিয়ে নাইপলের পর্যবেক্ষণ, ‘ইসলাম আসলে ঔপনিবেশিকতার চেয়েও খারাপ। ইসলাম ধর্ম মেনে নেয়া মানে সেই জাতিগোষ্ঠী নিজের অতীত অস্বীকার করছে। এ যেন বলা, আমার পূর্বপুরুষের কোনও সংস্কৃতি ছিল না।’

বহু লেখকই নাইপলের এসব কথাবার্তার সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। উইকিপিডিয়াতে এ কালেকশন অব ওয়ার্স্ট থিংস ভিএস নায়পল হ্যাজ এভার সেড’-এর মতো সাইটও তৈরি হয়েছে।

নাইপল নারীসঙ্গ ভালোবাসতেন। ব্রিটিশ কন্যা প্যাট্রিসিয়া হেলের সঙ্গে নাইপলের কলেজজীবনে প্রেম হয়। দুজনেই অক্সফোর্ডের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক করতে গিয়ে প্রথম দেখা। প্যাট্রিসিয়া দরিদ্র পরিবারের মেয়ে, তার বাবা জর্জ হেল ব্যাঙ্কের কেরানি। বিদ্যাধরও ত্রিনিদাদের গরিব বাড়ির ছেলে। মিসেস কিং নামের এক ভদ্রমহিলার বাড়িতে তিনি পেয়িং গেস্ট হিসাবে থাকেন।

মার্গারেট রবার্টস নামে কেমিস্ট্রির এক সিনিয়র ছাত্রী ওই ঘর ছেড়ে দেয়ার পর বিদ্যাধর সেখানে ঢোকে। এই মার্গারেটই পরে ডেনিস থ্যাচারকে বিয়ে করে মার্গারেট থ্যাচার নামে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৭২ সালে আর্জেন্টিনা ভ্রমণে গিয়ে মার্গারেট গুডিং নামের বিবাহিত তিন সন্তানের এক মায়ের প্রেমে পড়েন তিনি।

এর এক বছর পর বিষয়টি স্ত্রী প্যাট্রিসিয়াকে জানিয়ে বলেন, সে তার যৌন আকাঙ্ক্ষা মেটাতে পুরেপুরি অক্ষম। পরবর্তীতে প্রায় চব্বিশ বছর গুডিংয়ের সাথে যে তার দৈহিক সর্ম্পক ছিল, তা স্ত্রী জানতেন। ১৯৯৫ সালে গুডিংয়ের সাথে ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণরত অবস্থায় স্ত্রী প্যাট্রিসিয়া ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।

ওই বছরই তার মৃত্যু হয়। এর দুই মাসের মধ্যে নাইপল গুডিংয়ের সঙ্গেও সম্পর্কের ইতি টেনে পাকিস্তানি সাংবাদিক নাদিরা আলভিকে বিয়ে করেন, যিনি তার চেয়ে বিশ বছরের ছোট। শেষজীবন অবশ্যি তারা সুখেদুখে একসাথেই কাটিয়ে দ্যান।

লেখক: সংবাদকর্মী