জীবন থেকে নেয়াঃ স্বাধীনতার আগেই এক মুক্তির সংগ্রাম

রিফাহ সানজিদা

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৮

জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০) চলচ্চিত্রটি এমন এক সময় জহির রায়হান নির্মাণ করছিলেন তখন - যুদ্ধ যে হবে একটা , লড়াই যে একটা হবে সংগ্রামের সে কথা আঁচ করা যাচ্ছিলো-তখনকার রাজনৈতিক আর সামাজিক বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে। সিনেমাটির অনেক ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে। জহির রায়হানের পরিচালনায় এই ছবিটি তখনকার গণমানুষের যে আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছে তা আজকের দিনেও সমান ভাবে প্রযোজ্য।  একটা সিনেমা কিভাবে ইতিহাস হবার আগেই ইতিহাস লেখে তার সবচে ভালো উদাহরণ এই সিনেমা। ৬২-৭০ এই উত্তাল সময়ে বাঙালীর জীবনের গল্প নিয়ে জহির রায়হান সৃষ্টিকরেছেন - জীবন থেকে নেয়া ।

গল্পে দুই বোনের একই সংসারে শুরু হওয়া টানাপোড়েন একসময় ভয়ংকর মোড় নেয়- বড় বোনের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করতে চাওয়ার ফলস্বরুপ সাংসারিক দ্বন্দের শুরু।পারিবারিক সাধারণ একটা গল্প থেকে সমাজ-রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী মনোভাব পর্যন্ত টেনে নিয়ে প্যারালাল একটা চিত্রকল্পের সমাবেশ ঘটানো খুব সোজা নয়।
যদিও এই পরিবারই ক্ষুদ্র একটা সরকার-ব্যাবস্থার মতো পরিচালিত হয়।মিছিলের দৃশ্য, কারাবন্দী ভাষা আন্দোলনকারীদের কন্ঠে নজরুলের সেই দুনিয়া কাঁপানো গান- " কারার ঐ লৌহ কপাট " এখনো শরীরে বিদ্রোহের আগুন ধরিয়ে দেয় সিনেমাটা দেখতে গ্যালেই। বাংলাদেশকে স্বাধীনতার আগে পশ্চিম পাকিস্তান যেমন করে কোনঠাসা করছিলো সব সুযোগ-বঞ্চিত করে, সেই প্রেক্ষাপটে ছবিতে দুই ভাইয়ের স্ত্রীর দ্বন্দে স্পষ্ট ফুটে উঠছিলো বৈষম্য আর অন্যায়ের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার নতুন কাহিনী । পারিবারিক দ্বন্দের সাথে ভাষা আন্দোলন , গণ-অভুথ্যান মিলেমিশে যেনো একাকার। বিভিন্ন ইন্টারভিউতে ছবিটির লেখক আমজাদ হোসেন জানান, এই গল্প পুরোপুরি পারিবারিক ছিলো তবে শহীদ আসাদের কথা মাথায় রেখে লিখতে গিয়ে বারবার আসছিলো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। জহির রায়হান ও সুদক্ষ হাতে তাতে যোগ করেছেন গান আর দৃশ্য। স্বাধীনতার আগেই স্বাধীনতার আভাস পাওয়া গেছিলো ছবিটায়, পুরো ছবি জুড়ে পারিবারিক দ্বন্দ আর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষোভ , আন্দোলন, সংগ্রাম সমান তালে চলেছে। ১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটার শেষ দৃশ্যে শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের উদ্দেশ্যে ফুল দেবার সময় বেজে ওঠে , রবি ঠাকুরের বিখ্যাত গানটি- " আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি " - এটি পরেস্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি পায়। উপমহাদেশে রবি ঠাকুরের কোনো গানে , যন্ত্রের ব্যাবহার হয়েছে প্রথমবারের মতো তাও এই "জীবন থেকে নেয়া" ছবিতেই , আজ যখন বিতর্ক হয়- জাতীয় সংগীত নিয়ে, তখন সত্যি আশ্চর্য্য হই, এত বিভক্তি কোথেকে এসে ঢুকেছে আমাদের চেতনায় আর মননে ? এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে , সোনার বাংলা, কারার ঐ লৌহ কপাট একেকটা রক্তে আগুন ধরানো গান ছিলো ছবিতে। রওশন জামিল , খান আতাউর রহমান , রাজ্জাক, আনোয়ার হোসেন সবাই মিলিয়ে এত দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন সব ক`টা চরিত্রে দেখে মনে হবে এ যেনো কালজয়ী এক সাংঘর্ষিক গল্প ।
জহির রায়হানের মতো গুণী নির্মাতার পক্ষেই এরকম ছবি নির্মাণ সম্ভব,যাকে আমরা হারিয়েছি ৭১ এ ,জহির রায়হানের নিখোঁজ হওয়া- সে আরেক রহস্যের আধার যা আজো অস্পষ্ট আর বিতর্কের ধোঁয়াশায় ঢাকা।
এই ছবির কাজ চলাকালীন সময়ে বার বার সেটে আসতে থাকে তৎকালীন সরকারের পুলিশ, আর্মি। এক সাক্ষাৎকারে ছবির অন্যতম প্রধাণ অভিনেতা রাজ্জাক জানিয়েছিলেন সে কথা, তাঁদের ছবির সেট থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে নিয়ে যাওয়া হয় একবার, জহির রায়হান তাও দমে যাননি, সাহসী হাতে শেষ করেছেন ছবির কাজ। আর আজ তো ছবিটা ইতিহাস রীতিমতো । 
মুক্তির পরো আবার নিষিদ্ধ করা হয় ছবিটি, কারণ একটাই , ছবিটি মুক্তির স্লোগানে কাঁপিয়ে দিচ্ছিলো পূর্ব পাকিস্তান, পরে সেন্সর বোর্ড আবার দ্যাখে ছবিটি, তারা চরম আপত্তি জানালেও  মুক্তি দিতে বাধ্য হয় নানান ষড়যন্ত্র করেও ।
জহির রায়হান নিজে প্রত্যক্ষ ভাষা আন্দোলনকারীদের একজন এবং প্রথম দশ কারাবরণকারীদের একজন আর তাই , ছবিটির প্রত্যেক গান আর শকিশালী চিত্রায়ণে সেই আবেগ , দেশপ্রেম স্পষ্ট ।
ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বানানো এই ছবি প্রমাণ করে দেয় চলচ্চিত্র কেমন করে দেশ আর জাতির মুক্তির কথা বলে, চলচ্চিত্র কেনো একটা শক্তিশালী মাধ্যম । স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, তবে আসলেই কি বদলেছে পরিস্থিতি ? সিনেমা কি মুক্তি পেয়েছে সেন্সরের অযথা হয়রানি থেকে ? রাজিবুল হোসেনের ছবি " হৃদয়ের রংধনু " আটকে রেখেছে সেন্সর বোর্ড প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে। জীবন থেকে নেয়া- এরকম ছবি ও আজ আর কোথায় ? আজ আর সাহসী পরিচালক কোথায় যারা কথা বলেন চলচ্চিত্রে, আভাস দেন নতুন দিনের ? সিনেমা একটি অন্যতম সাংস্কৃতিক বিপ্লবের হাতিয়ার, জহির রায়হান`রা ছিলেন সেইসব বিল্পবের অগ্রভাগের যোদ্ধা- সিনেমা,গান,নাটক দিয়েও বিপ্লব হয়, মুক্তির ডাক আসে-যুদ্ধ হয় মননে।  ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে এই চলচ্চিত্রের সকল অভিনেতা , পরিচালক জহির রায়হান, গল্পকার আমজাদ হোসেন সহ সহ স্মরণ করছি সেইসব রফিক,সালাম, বরকত, জব্বার সহ নাম
না জানা সকল শহীদদের, যারা প্রাণ দিতে পিছপা হননি, কিন্তু আঁকড়ে ধরে ছিলেন বাংলা ভাষাকে।