জুতো পায়ে ভিতরে আসুন

আবু হাসান শাহরিয়ার

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৪, ২০১৮

অতিথি নারায়ণ। তাকে তো জুতো পায়েই ঘরে ডাকা উচিত। একুশ শতকের নগরজীবনে সনাতন প্রাচ্যদেশীয় রীতিতে অতিথিকে বাড়ির ভেতরে ডাকতে হলে হিম্মত লাগে। ভেতরে এনে অতিথিকে পরখ করে নিতে প্রজ্ঞাসঞ্জাত গাম্ভীর্য লাগে। একই মনোরাজ্যের বাসিন্দা হলে অসমবয়সী বন্ধুর সঙ্গে প্রাণখোলা আড্ডা দেয়ার জন্য একটা চিরবালক মনও দরকার হয়। সব গুণ ভাষাচিত্রী শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়েছিলেন মা-প্রকৃতি। তার দেশপ্রাণ শাসমল রোডের বাড়ির দরজায় ঝুলিয়ে রাখা এই নোটিশ সেই সাক্ষ্যই দিত।

রামকৃষ্ণ বলতেন, ‘ঈশ্বরের বালকস্বভাব।’ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো বালকস্বভাবী ঈশ্বর আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি জীবনে। `কুবেরের বিষয়আশয়`-এর পর বাঙলা সাহিত্যে ওইরকম জীবনঘনিষ্ঠ দ্বিতীয় একটি উপন্যাসও চোখে পড়েনি। মানি, `ঈশ্বরীতলার রূপোকথা`, `গতজন্মের রাস্তা`, `অদ্য শেষরজনী`, `আলো নেই` কিংবা শেষবয়সে লেখা `শাহজাদা দারাশুকো`ও মহার্ঘ উপন্যাস। কিন্তু, `কুবেরের বিষয়আশয়` একজন কালজয়ী-হতে-আসা লেখক একবারই লিখতে পারেন জীবনে।

বোকা বাঙালি বোরহেসের তর্জমায় যে-জাদুবাস্তবতাকে বুঝেছে, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় বহু আগেই তা দিয়ে গেছেন ছোটোগল্প ও উপন্যাসে। না বললে অন্যায় হবে, ছোটগল্পেও তিনি মোহন জাদুকর। নিজে না লিখলেও নিবিড় পাঠক ছিলেন কবিতার। কলকাতায় যাব অথচ শ্যামলদা-ইতি বৌদির বাড়িতে যাব না– একসময় এমনটা ভাবতেও পারতাম না। ঢাকায় এলে তিনিও পায়ের ধুলো দিয়ে গেছেন আমার বাড়িতে। আমাদের মধ্যে নিয়মিত চিঠি-চালাচালিও হতো।

না, আজ সেই মহান ভাষাচিত্রীর জন্মদিন-মৃত্যুদিন কিছুই না। সৃষ্টিকর্ম বিষয়ে ন্যূনতম খোঁজখবর না রেখে এইসব দিনে বস্তা বস্তা শ্রদ্ধানিবেদনে হাসি পায়। অথচ, এমনই এখন যুগধর্ম। চলিতেছে `সেল্ফিশ`দের সেল্ফিযুগ। যুগের জঞ্জাল। মাছের নামে কবিতা উৎসব হয় এখন– `ইলিশ উৎসব`। করপোরেট বেলেল্লাপনাকে বলা হয়– `আর্ট ক্যাম্প`। যত সব বুজরুকি। কিন্তু, সময় বড়ো বলবান। যুগের সব জঞ্জালকে মুছে শুধু শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো উচ্চমানবদেরই মনে রাখে।

`সময় বড় বলবান` নামে কৃশতনু একটি আত্মজৈবনিক বই আছে শ্যামলের। শুধু সেটা পড়লেও বোঝা যায়, কী শক্তিমান লেখক ছিলেন তিনি। সত্যের পরিচর্যা করতে না জানলে বলবান সময়ের পিঠে বেশিদিন সওয়ার থাকা যায় না। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন বলবান সময়ের সেই সাহসী অশ্বারোহী।

চিরকুর্নিশ, হে প্রণম্য অশ্বারোহী।

 

লেখক: কবি