জেবের কবিতা লেখার খেসারত

দেবদুলাল মুন্না

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৮

জেবউন্নিসার প্রেমিককে ফুটন্ত তেলে জীবন্ত হত্যা করে কেন প্রিয়বিদুষী মেয়েকে বন্দিনী করেছিলেন অওরংজেব? করেছিলেন। অথচ এই মেয়েকেই তিনি বেশি ভালবাসতেন। কিন্তু তার ধর্মান্ধতা তাকে একাজটি করতেও বাধ্য করেছিল। সে কথা পরে বলি। জেবউন্নিসা জেব নামেই পরিচিত। ছোট আদরের ডাকনাম।

জেবের শিক্ষা লাভের যেন কোনও ত্রুটি না হয়, সেজন্য তার বাবা অওরংজেব শিক্ষককে পারিশ্রমিক দিতেন ৩০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা। আজ থেকে ৪০০ বছর আগে। বড়মেয়ে জেবউন্নিসাকে এতটাই ভালবাসতেন অওরংজেব। কিন্তু সেই আদরি দুলালিকে একসময় আজীবনের জন্য কারাবাসে পাঠিয়ে দেন। কুড়ি বছর বন্দি দশায় কাটিয়ে সেখানেই মৃত্যু হয় জেবউন্নিসার। ‘মখফি‘ ছদ্মনামে যার কবিতা অমর হয়ে আছে। আজ ফিরে যাব এই মুঘল রাজকন্যার জীবনে।

শাহজাহানের শাসনকালে ১৬৩৮ সালে দৌলতাবাদে জন্ম হয় জেবের। বাবা তখন মুঘল যুবরাজ অওরংজেব। মা পারস্যের রাজকুমারি দিলরস বানু বেগম। প্রিয়তম বড় মেয়ের জন্য অওরংজেব নিয়োগ করেন হাফিজা মরিয়মকে। তাকেই দেয়া হতো ৩০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা। ধর্মপ্রাণ পিতার প্রভাব কিনা বলা যায় না‚ মাত্র তিন বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ কোরান মুখস্থ হয়ে গেল জেবের। সাত বছরের বালিকা হয়ে গেলেন হাফিজ।

এ উপলক্ষে তার বাবা এলাহি ভোজসভা দেন। ছুটি ঘোষণা করেন নিজের জায়গিরে। জেবকে দেন ৩০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা পারিতোষিক। তবে শুধু ধর্মগ্রন্থ নয়, জেব আয়ত্ত করলেন গণিত‚ দর্শন‚ জ্যোতিষ‚ সাহিত্য। দখলে আনলেন পার্সি‚ আরবি ও উর্দুভাষা। আর এখানেই তার পথ আলাদা হয়ে গেল বাবার জীবনদর্শন থেকে।

অন্য মুঘল শাহজাদিরা যখন নিজেদের চেহারা আর মহল সাজাচ্ছিলেন‚ জেব মনের মতো করে সাজালেন পাঠাগার। কোরানসহ সেখানে স্থান পেল হিন্দু এবং জৈনলিপি‚ গ্রীকপুরাণ‚ পার্সিবই‚ বাইবেলের অনুবাদ‚ অলবিরুনির ভ্রমণবৃত্তান্ত…তালিকার শেষ নেই। বহু লেখক নিযুক্ত হলেন জেবের নির্দেশে। সাহিত্য সৃষ্টিতে অথবা অনুবাদে লিপ্ত হলেন।

জেবের আর এক প্রেম ছিল সঙ্গীত। বলা হয়, তিনি ছিলেন তার সময়ের সেরা সঙ্গীতশিল্পী। এত কোমল বৃত্তিধারী জেব কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে লড়াইও করেছেন। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল তার কবিসত্ত্বা। মাত্র ১৪ বছর বয়সে কবিতা লিখতে শুরু করেন কিশোরী জেব। কিন্তু যেহেতু বাবা এসব কিছু পছন্দ করতেন না‚ তাই লুকিয়ে কাব্যচর্চা করতেন। তার পার্সিয়ান কবিতাচর্চার ধারা এসেছিল প্রপিতামহী সালিম বেগমের থেকে। এক শিক্ষক উস্তাদ বায়াজের উৎসাহে কাব্যচর্চা চালিয়ে যান জেবউন্নিসা।

শোনা যায়‚ ঘানি কাশ্মীরি‚ আকিল খান রাজি‚ নৈমতুল্লাহর মতো বড় কবিদের সঙ্গে লুকিয়ে কবিতার মজলিশ করতেন জেব। আগুনের মতো ফুটে উঠেছিল তার রূপ। দীর্ঘাঙ্গী‚ ফর্সা‚ ছিপছিপে জেবের মুখাবয়ব ছিল গোলাকৃতি। বাঁগালে দুটি তিল। পাতলা ঠোঁটের আড়ালে মুক্তোর মতো দাঁত। ভ্রমরের মতো কালো চোখ আর কোমর ছাপানো কালো চুলের রাশি। এহেন সুন্দরী মুঘল রাজনারী একসময় শুধু সাদা পোশাক পরতে লাগলেন। গয়না বলতে গলায় একছড়া মুক্তোর মালা। কেন এ বৈরাগ্য‚ তার জন্য দায়ী জেবের জন্মদাতা অওরংজেব।

শাহজাহান চেয়েছিলেন জেবের বিয়ে হোক মুঘল যুবরাজ সুলেমান শিকোর সঙ্গে। সুলেমান ছিলেন দারাশিকোর ছেলে। জ্যেষ্ঠ পুত্রের উত্তরাধিকারের হিসেব মতো ময়ূর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। কিন্তু অওরংজেব দারাকে পছন্দ করতেন না। তিনি সুলেমান-জেব-এর বিয়ে হতে দেননি। এবং পরে দারাশিকো সিংহাসনও পাননি‚ সে অবশ্য আর এক ইতিহাস।

যাই হোক‚ অনেক ঐতিহাসিক দাবি করেন‚ জেবের সত্যিকারের প্রেমিক ছিলেন আকিল খান রাজি। সেকালের লাহোরের শাসক আকিল আবার কবিও। একবার হাওয়া বদলাতে ১৬৬২ সালে লাহোর গিয়েছিলেন অওরংজেব। স্বপরিবারে এবং স্বপার্ষদ। তখন নাকি জেব-আকিল প্রণয় জমে ওঠে। কিন্তু তা ছিল ক্ষণস্থায়ী। এবং এর পরিণতি স্বরূপ নাকি আকিলকে ফুটন্ত তেলভর্তি কড়াইয়ে জীবন্ত দগ্ধ করা হয়।

তবে অনেকেই মনে করেন, এগুলো মুঘল শাসনের বিরুদ্ধে বিদেশিদের মিথ্যাভাষণ। অনেক আগেই জেবউন্নিসা বেছে নেন একাকী জীবন। ঠিক করেছিলেন জীবনভর অবিবাহিত থেকে কবিতা-অন্ত-প্রাণ থেকে যাবেন এবং তাই উনি করেছিলেন। মেয়ের উপর থেকে কবিতার ছায়া সরাতে না পেরেই সম্ভবত অওরংজেব তাকে বন্দি করেন। শাহজাহানাবাদের (আজকের পুরনো দিল্লি) সালিমগড় কেল্লায় রাখা হয় তাকে। আবার বলা হয়‚ অওরংজেবের নীতি মেনে নিতে পারেননি জেব। তাই এই বিদূষীর স্থান হয় কারাগারে। কারণ তিনি বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ রচনায় সাহায্য করেছিলেন ভাই মহম্মদ আকবরকে।

যে মেয়ে অওরংজেবকে পরামর্শ দিতেন রাজকার্যে‚ সেই জেবউন্নিসার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হলো সব সম্পত্তি। বন্ধ হয়ে গেল তার বার্ষিক ৪ লক্ষ টাকা অবসর ভাতা। ১৭০২ সালে ৬৪ বছর বয়সে প্রয়াত হন বন্দিনী জেব। পার্থিব সবকিছু কেড়ে নেয়া হয়েছিল তার কাছ থেকে। কিন্তু রয়ে গিয়েছিল কবিতা। পার্সি ভাষায় মখফি কথার অর্থ হলো, যিনি লুকিয়ে আছেন। এই ছদ্মনামে কত যে কবিতা‚ গজল লিখেছেন তিনি‚ তার কোনও ইয়ত্তা নেই। শুধু ‘দিওয়ান‘ বইয়েই আছে ৫ হাজার কবিতা।

জেবের কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে বই। বিশ্বের নানা দেশে সংগ্রহশালায় আছে তার পাণ্ডুলিপি। তার পছন্দ অনুযায়ী বানানো বাগানের ভগ্নাবশেষ আছে লাহোরে। আর জেব নিজে ঘুমিয়ে আছেন পুরনো দিল্লিতে। প্রথমে তার সমাধি ছিল তিরিশ হাজার গাছের উদ্যানে। পরে দিল্লিতে রেললাইন পাতার সময়ে তা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আগ্রার সিকান্দ্রায়। সেখানেই প্রপ্রপিতামহ আকবরের সমাধি ক্ষেত্রে চিরবিশ্রামে শায়িত কবি মখফি‚ শাহজাদি জেবউন্নিসা।

জেবের আরও চার বোন ছিলেন। তাদের মধ্যে দুইবোন জিনাতউন্নিসা আর জুবদৎউন্নিসা ছিলেন জেবের মতো কবিতা মনস্ক।

লেখকের ‘উপেক্ষিত প্রেম উপাখ্যান’ বই থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হলো। বইটি ২০১২ সালের একুশে গ্রন্থমেলায় লেখক-পাঠক সমাবেশ থেকে প্রকাশিত হয়।