জয় বাবা ভাণ্ডারি

চয়ন খায়রুল হাবিব

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৩, ২০১৮

মাহেসওয়ারি দাদার ওরশ মোবারকে যাবেন?
আপনারা তো প্রিয়জনদের জানাজা, কুলখানি ও মৃত্যুদিবস করেন। পরিচিত রাজনীতিকের মেজবানিতে আগত রবাহুতদের মৃত্যুতে গলা ফাটিয়ে কে ছোট, কে বড় বিতণ্ডাও করেন। আমার দাদার ব্যাপারটা তাকে প্রিয় মনে করা মুরিদ, মাস্তানদের কাছে সেরকম একটি প্রিয় ব্যপার।
দাদার নাম জমির শাহ। মুরিদদের কাছে হযরত শাহ জমির নূর নগরী। যেখানে ওনার মাজার, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার সে গ্রামটির নাম লতিফ শিকদার বা লতিহদ্দার। মুরিদেরা সে গ্রামটিকে ডাকে তৃষ্ণা। দাদা হচ্ছেন বগুড়ার মহাস্তান গড়ে সমাহিত সুলতান শাহর অধস্তন।
সুফি খানদানে, বিশেষ করে আমাদের সিলসিলায় কে গদিনসীন বা ঊর্ধ্বতন-অধস্তন সে হিসাবে নয়, যারা সুফ বা আলোকপ্রাপ্ত পীর তাদের বলা হয় মাহেসওয়ার বা মাছের সওয়ারী। সিলেটের শাহ জালাল, শাহ পরান, মাইজভাণ্ডারের সৈয়দ আহমাদুল্লাহ, বগুড়ার সুলতান শাহ, কুষ্টিয়ার একদিল শাহ, ঢাকার দায়েম শাহর মতো আমার দাদাও একজন মাহেসওয়ার। কবি জালালুদ্দিন রুমি ও তাবরিজের দিওয়ানা শামসের যে প্রেমদর্শন মাহেসওয়ারিরা ধিকর, ঝিকর, আশকার, দরবেশি কুন্দনের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন, তাতে এক ধর্মের ওপর আরেক ধর্মকে স্থান দেয়া হয় না। বাংলাদেশি সুফি তরিকায় গায়েনদের মধ্যে পাবেন রমেশ শীল ও রায়হানকে। ধর্মীয় এ ভেদ না করাতে সুফিরা ইরানি শিয়া ইমাম, সৌদি ওয়াহিবিদের বিরাগভাজন। শতশত বছর আজমির থেকে বাংলায় সুফিরা ভারতের অন্তস্থ সংগীতকে আত্মস্থ করেছে আন্তরিকভাবে।
পদবীপ্রেম আমাদের যাপনে কতটুকু লাপাত্তা, তার প্রমাণ আমার বাবার মতো অনেক অধস্তনের শাহ, সৈয়দ, শেখ পরিত্যাগ! তাবিজবাজি, মাদুলিবাজির ওপরেও পারিবারিক নিষেধাজ্ঞা আছে।
এই আন্তরিকতার জন্য কট্টর মৌলবাদী ঔরংগজেব থেকে পাকিস্তানি ওয়াহাবি জেনারেলরা সুফিদের ওপর খড়গহস্ত হয়েছে। যখনই উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানো হয়েছে, তুরস্কের এরদোগান, সৌদি রাজবংশ, ইরানি ইমামেরা সুফিদের ওপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়েছে। বাংলাদেশের জামায়াত ইসলামি ও অপরাপর ওয়াহাবি ফতোয়াবাজেরা যখনই সুজোগ পেয়েছে, সুফিদের বিরুদ্ধে উস্কানি দিয়েছে। কিন্তু তুরস্ক, ভারত ও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভালবাসার জোরে সুফিরা টিকে আছে। এসবের ভেতর যে ভণ্ডামি, নষ্টামি ও স্বার্থপরতার নোংরামি নেই, তা নয়। বিভিন্নখানে, ইতিহাসের বিভিন্ন মোড়ে নবাব, বাদশাহেরা সুফি পীরদের বিপুল জমি পত্তনি দেয়াতে, সেগুলোর সূত্র ধরে সামন্ত বিষাক্ততা সুফি সিলসিলায়ও সংক্রমিত হয়েছে। কিন্তু মূল সম্পদ শেষ অব্দি সংগীত। এই সুফি সংগীতের ভেতর দিয়ে জালালুদ্দিন রুমি, মিরাবাই, হাজি পিয়া, চৈতন্য, লালন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ। যার কোনও সামাজিক ডিভোর্স নাই।
মাঘমাসে তৃশ্না গ্রামে সমবেত নারি ও পুরুষ মাস্তানেরা দিনরাত উপাসনা করবে, গান গাইবে, জিকিরের উদ্যামে বলবে, হক! এটাকে যারা নাহক বলে, তাদের সাথে আমরা তার্কিক বিরোধে যেতে চাই না। পারিবারিক আবহে আমাদের রাজনীতির মেরুকরণে যেতে নিরুৎসাহিত করা হলেও, আমরা ভোট দেই, গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতাকে আন্তরিকভাবে ধারণ করি। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধে আমাদের তরিকার তরুণেরা সরাসরি রণাঙ্গনে গিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা হিশেবে, শহিদও হয়েছে চাদপুরে, মিরপুরে। আবার হাল্লাজের হককে ডাকলেও আমরা রাজনীতিকভাবে কালার ব্লাইন্ড নই, পাল্টিবাজও নই। যে সুফের কথা আমাদের ঊর্ধ্বতন ইউসুফেরা বলেছেন, তাতে জুলেখা শরিয়া শাষিত নন, বরং জেন্ডার সমতায় আসীন।
তৃশ্নার গ্রামে মোম জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অতি দীন শাড়ি, লুঙি পরা সাধারণ কিষাণ-কিষাণীর চোখে আমি যে অসাধারণ দ্যুতি দেখেছি, তাতে আমার বিশ্বাস দৃঢ়তর হয়েছে যে, ভালবাসার জয় আমাদের এগিয়ে নেবে।
জয় বাবা ভাণ্ডারি! জয় তৃশ্নার নূর নগরী!