টাকার জন্যে ঋত্বিক সিনেমা বন্ধক রাখেন

পর্ব ২

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৪, ২০১৭

২০১৭ সালের ১১ জানুয়ারি টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে সাক্ষাৎকার দ্যান সুরমা ঘটক। স্বামী ঋত্বিকের কথা বলতে গিয়ে শিশুর মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন ৮৪ বছরের সুরমা। কথা বলতে বলতে তিনি যেন উইন্ডমিলের মতো স্মৃতির বাতাসে অতীতে ভেসে গেলেন। ধীরে ধীরে ধুলো সরে গিয়ে সিপিয়ার রিল থেকে রঙিন হয়ে উঠতে লাগল এক শিল্পীর জীবন্ত প্রতিকৃতি। বাঙ্লায়ন করেছেন রিফাহ সানজিদা। আজ প্রকাশিত হচ্ছে পর্ব ২

ঋত্বিক ঘটকের সাথে সত্যজিৎ রায়ের সম্পর্ক কেমন ছিল?
সুরমা: তারা দুজনই দুজনকে খুবই সম্মান করতেন। আমার স্বামী আসলে কি, সত্যজিৎয়ের বেশ ভক্ত ছিলেন। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে, একবার আমরা সত্যজিৎয়ের কাপুরুষ ও মহাপুরুষ দেখছিলাম। ছবিটা ঋত্বিকের ভালো লাগেনি। তিনি আমাকে বললেন, চুপ করে চলে এসো।
উত্তম-সুচিত্রার জনপ্রিয় সিনেমার ধারা নিয়ে তার মতামত কি ছিল?
সুরমা: তিনি ওগুলো কখনোই দেখতেন না। বরং আন্তর্জাতিক সিনেমাগুলো দেখতে তিনি ফেস্টিভালগুলোয় যেতেন। ওগুলোতে আমিও তার সাথেই থাকতাম। কিন্তু এসবের মধ্যেও তার মন ভাঙছিল। তার প্রথম সিনেমা বেদেনীর চিত্রধারণ শেষ হবার পরও টাকা-পয়সার সীমাবদ্ধতায় কাজটা শেষ করতেই পারছিলেন না।
এটা নাগরিক ছবিটার আগের ছবি ছিল। এরপরও তিনি নাগরিকের কাজ শেষ করলেন। তবে ওটাও মুক্তি দিতে পারেননি। অযান্ত্রিক আর বাড়ি থেকে পালিয়ে ব্যবসাসফল ছিল না। মেঘে ঢাকা তারা দর্শকের পছন্দ হলেও, কোমলগান্ধার পুরোপুরি ফ্লপ হলো। সুবর্ণরেখা বানানোর পর টাকার জন্য ছবিটাই বন্ধক রাখেন। এ ছবিটা মুক্তি পেল না। এর মধ্যে তিনি গল্প, নাটক ও প্রবন্ধ লিখছিলেন।
নিশ্চয়ই তিনি হতাশায় ভুগছিলেন...
সুরমা: আমার স্বামী তার এ হতাশাগুলোকে কখনোই জয়ী হতে দেননি। তিনি নিজেকে অন্য সবে ব্যস্ত রাখতেন। আর এটাও সত্যি নয় যে, তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে মদপান করতে শুরু করেন। তিনি ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত নন-ড্রিংকার ছিলেন। বিয়ের আগেই, আমার বাবা খোঁজ নিয়েছিলেন আমার স্বামী আর তার পরিবার বিষয়ে। বাবা আমায় বলেছিলেন যে, ছেলে মদ-টদ খায় না। একটা সময় ছিল, মদ খেয়ে কেউ সেটে এলে আমার স্বামী তাকে বের করে দিতেন। এরপর বন্ধুদের জোরাজুরিতে তিনি মদপান শুরু করেন। কোমলগান্ধার ফ্লপ হবার পর সব বদলে যেতে শুরু করে। তিনি আরও বেশি মদপান করতে থাকেন। সুবর্ণারেখা যখন মুক্তি পায়নি,
তিনি নিজেকে কাজে ডুবিয়ে রাখলেন। তিনি লিখতেন, পড়তেন আর গান শুনতেন সবসময়ে।
তাহলে সংসারে অনেক কিছুই বদলাতে থাকল নিশ্চয়ই?
সুরমা: না, আমাদের সাধারণ আটপৌরে সংসারই ছিল। তিনি বাচ্চাদের ভীষণ ভালোবাসতেন। ঘরে যা যেভাবে চলার, সেভাবেই চলতে লাগলো। বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছিল। আমি রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকতাম। যখনই তিনি পুনে (এফটিটিআইতে পড়াতে) কিংবা বাংলাদেশ যেতেন, বাচ্চাদের জন্য ভালো কাপড় আনতেন। চিড়িয়াখানায় নিয়ে যেতেন। ভালো খাবার কিনে দিতেন। আমাদের মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব ছিল না। যদিও তার ছবিগুলো ফ্লপ করছিল। তিনি দিল-দরিয়া ছিলেন। মানুষজনকে বাসায় খেতে ডাকতেন। একবার আমি বললাম, এতগুলো মানুষ খাওয়াতে গিয়ে রসুইঘরে খরচাটা বাড়ছে। অন্তত কিছু টাকা জমানো উচিত। সে বললো, অতিথিদের আমার ভাগের খাবারটাই দিও। আমি বিরক্ত হলে তিনি বলতেন, পেঁচা কয়, পেঁচানি/থামা তোর চেঁচানি। তার মধ্যে সবটা সময় প্রাণপ্রাচুর্য্য থাকতো। মেঘে ঢাকা তারার সময়ে আমি তখনও যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ছাত্রী ছিলাম। ফাইনালের আগে আমার বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়ল। আর রান্নার লোকটা গেল ছুটিতে। একজন আমাকে বললো, পরীক্ষায় ফেল করবার চেয়ে ড্রপ দেয়া ভালো হবে। উপদেশটা মন্দ নয়। ভয় পেয়ে আমিও ড্রপ দিলাম ৬২ সালে। এম.এ. টা আর শেষ করতে পারিনি। রিতাবনের জন্ম `৬৩ তে, তখন আমি ভাবলাম ওনার মানসিক অবস্থা। যা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছিল। এবার একটু হলেও উন্নতি হবে। কিন্তু সেটা হলো না। `৬৫ তে তিনি পুনে গেলেন আর আমি আমি শিলংয়ে চলে এলাম ঘর ছেড়ে। ওখানে তিনি অসুস্থ হয়ে গেলেন। কলকাতা ফিরে তিনি আবারও তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো।
চলবে...