টুকে রাখা কথামালা

স্বকৃতি নোমান

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৬, ২০১৭

তালেব। পুরো নাম কবি তালেব রাজ ট্রাম্প অব বাংলাদেশ। তার মোট নাম দুই শ তেরটি। অন্যতম তিনটি নাম হচ্ছে―ডোনাল্ড পোয়েট এড্রিস তালেব রাজ, কবি অ্যাডরিচ মুরসালিন তালেব রাজ মানজি এবং ইটিজটিং তালেব রাজ ওয়াল্ড নম্বর ওয়ান ম্যানুয়াল সিম্পল জেন্টলম্যান। আজ বেলা দুটার দিকে অফিসের পিয়ন জাভেদ এই `জগতশ্রেস্ঠ` কবিকে আমার রুমে নিয়ে এলেন। জাভেদ প্রায়ই এমন ব্যক্তিদের আমার কাছে পাঠিয়ে দেন। আমি জনাব তালেব রাজের সঙ্গে আলাপ শুরু করলাম। তিনি একজন বাস হেলপার। বিআরটিসি’র বাসে কাজ করেন। তবে অনিয়মিত। লেখালেখির কারণে নিয়মিত সময় দিতে পারেন না। কী লেখেন? মূলত কবিতা। তার কবিতার সংখ্যা প্রায় বাইশ শ। উপন্যাসও লিখে থাকেন। কোনো এক কোম্পানির দারোয়ানের চাকরি করতেন। তখন লিখেছেন পাঁচটি উপন্যাস। উপন্যাসগুলোর নাম যথাক্রমে―লাল সূর্য, কথা দিলাম, রঙিল উপহার, মেঘের মতো জীবন, সত্য যখন প্রবাহ, শেষের অধিকার। কবিতাগুলো লিখে থাকেন রুল করা একটি রেজিস্টার খাতায়। এরকম আটটি খাতা তার আছে, যেগুলোতে তার কবিতা লেখা।
কিন্তু তার নামের শেষে ‘ট্রাম্প অব বাংলাদেশ’ কেন? উত্তরে তালেব বললেন, ‘দেখুন, পৃথিবীতে যদি সেরা দশজন কবি থাকে তার মধ্যে আমি একজন। বাকি নয়জন কবি কিন্তু নামের শেষে তাদের দেশের নাম লিখেননি। আমি লিখেছি। আমি এই নিয়মের পাইওনিয়ার।’ জানতে চাইলাম, ‘দশজন কবির মধ্যে কয়েকজনের নাম বলুন তো?’
: যেমন সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটো, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখ।
: জীবনানন্দ দাশ?
: না না, তিনি লো-গ্রেডের কবি। এদের তালিকায় তার নাম আসে না। তিনি সুফিয়া কামালের চেয়েও নিচে। যাই হোক, আমি আমার দেশকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তোলার জন্য আমার নামের শেষে ‘অব বাংলাদেশ’ লাগিয়েছি।
: আচ্ছা আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা, আপনার লেখাপড়া?
: আমি আলিয়া মাদ্রাসা থেকে আলিম (ইন্টারমিডিয়েট) পাস করেছি। পরে টাকাপয়সার অভাবে আর লেখাপড়া করতে পারিনি। কিন্তু বিস্তর বইপুস্তক পড়েছি। ইতিহাস, অর্থনীতি, পৌরনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন....পড়ার যত বিষয় আছে সবই আমি পড়ে ফেলেছি। আমার সামনে বড় বড় পি.এইডি ডিগ্রিধারীরাও কিছু না।
: কীভাবে পড়েছেন?
: কেন, বিভিন্ন লাইব্রেরী থেকে, ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে নিয়ে।
: আচ্ছা আচ্ছা।
: আমি হচ্ছি শব্দবিজ্ঞানী। আপনি এমন একটা শব্দ বলুন, দেখবেন সঙ্গে সঙ্গে আমি সেটার ইংরেজি করে দিচ্ছি।
: বাহ! দেওয়াল-এর ইংরেজি কী হবে?
: দেওয়াল তো বাংলা শব্দ। এর ইংরেজি হচ্ছে ‘ডার্লিয়ার।’
: ফ্যান, যেটা বাতাস দেয়, এটা কি ইংরেজি শব্দ?
: আপনি তো দেখছি ভাই বাংলা ভাষার বিরোধী।
: কেন ভাই! কী অন্যায় করলাম?
: ফ্যান শব্দটি লিখতে য-ফলা (্য) আছে না? এই য-ফলা কি ইংরেজি শব্দে আছে? নাই। সুতরাং এটা বাংলা শব্দ। এর ইংরেজি হবে ‘ফার্নিয়া।’
: বুঝতে পেরেছি। এই নামটা তো আপনি দিলেন। আপনার নাম সবাই মানবে কেন?
: সবাই তো মানবে না। আমার মতো যারা শব্দবিজ্ঞানী আছে তারা মানবে। যেমন ধরুন এরিস্টটল, প্লেটো...এরা মানবে।
: আচ্ছা আচ্ছা।
: শুনুন, পৃথিবীতে যত দেশ আছে সব দেশের নাম কিন্তু বাংলা শব্দ থেকে নেওয়া। আমাদের ভাষা কিন্তু অনেক শক্তিশালী। র, ড়, ঢ, ঢ়...এসব অক্ষরের ইংরেজি আছে? নাই। একমাত্র বাংলায় আছে। বাংলা ভাষা অনেক সমৃদ্ধ। যাই হোক, আপনার সময় নষ্ট করছি।
: না না, আপনার সঙ্গে কথা বলে অনেক কিছু শিখতে পারছি। আপনি বলুন প্লিজ।

আমি কবি তালেব রাজের কাছে জানতে চাইলাম কেন তিনি কবিতা লেখেন? উত্তরে তিনি বললেন, সমাজের উপকার করার জন্য। সমাজের মানুষগুলা তো মানুষ না, বুঝলেন না? এদেরকে তো মানুষ বানাতে হবে। আমি তাদেরকে মানুষ বানাতে চাই। বুঝলেন, আমি যে পাড়ায় থাকি সেই পাড়ার কেউ কেউ আমাকে নাস্তিক বলে। আমি নাকি নাস্তিক। লেখকরা নাকি নাস্তিক হয়। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করি, তুমি কী? সে বলে, আমি ধার্মিক। আমি তখন বলি, আচ্ছা, আরবিতে ধার্মিক বানান করো তো? সে তখন বানান করতে পারে না। আমি তখন বলি, তোমরা মিয়া কচুর ধার্মিক। আমার কাছ থেকে ধর্ম শেখ। এই জন্যই আমার একটা নাম ‘কবি অ্যাডরিচ মুরসালিন তালেব রাজ মানজি।’
: এই নামের মাহাত্ম্য কী?
: দেশের বাইরে থেকে বড় বড় ইসলামি স্কলাররা যদি আমার কাছে আসে, তাদের জন্য আমি এই নাম রেখেছি। তারা তো আমার সঙ্গে ইসলাম নিয়ে ফডর-ফডর করবে।
: ফডর-ফডর মানে কী ভাই?
: ঐ দেখেন না হুজুরেরা ওয়াজের মধ্যে কেমন ফডর-ফডর করে।
: আচ্ছা আচ্ছা, বুঝেছি।
: আমি তখন ঐ স্কলারদেরকে জিজ্ঞেস করব, বল, মানজি অর্থ কী? তারা উত্তর দিতে পারবে না।
: মানজি অর্থ কী?
: মানজি অর্থ নবী। আমি তখন তাদের নবী হয়ে যাব। নবী হয়ে তাদের প্রশ্নের উত্তর দেব। তাদেরকে আমি পাল্টা যেসব প্রশ্ন করব একটারও উত্তর দিতে পারবে না। কদিন পরই আমি কোরানের বাংলা অনুবাদ শুরু করে দেব। ভাই গিরিশচন্দ্র সেন অনুবাদ করেছে না? আমি অনুবাদ করলে তার নাম মুছে যাবে। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে তখন আমার নাম থাকবে : অনুবাদক কবি তালেব রাজ ট্রাম্প অব বাংলাদেশ।
: এই কাজটি আপনি কবে থেকে শুরু করবেন?
: আমার একটি কবিতার বই বের করতে হবে। আমি এখন সেই চেষ্টায় আছি। বাংলা বাজারে গিয়েছিলাম। প্রকাশক বলেছে ২৫ হাজার টাকা লাগবে। টাকার জোগাড় করছি। বইটা বের করার পরপরই আমি কোরান অনুবাদের কাজ শুরু করে দেব। প্রতিদিন একটানা ছয় ঘণ্টা অনুবাদ করব। ছয় মাস লাগবে গোটা কোরান অনুবাদ করতে।

এরই মধ্যে কথাসাহিত্যিক হামীম কামরুল হক এলেন। কবি তালেব রাজের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ চলতে লাগল। হামীম ভাইও তাকে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। হামীম ভাই তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নামের সঙ্গে ‘রাজ’ কেন? তিনি উত্তর দিলেন, কবি হতে হলে রাজ বংশের সাথে যোগাযোগ লাগে। সেকারণে আমি নামের শেষে ‘রাজ’ লাগিয়েছি। যাই হোক, কবি তালেব রাজের এখন অন্যতম স্বপ্ন হচ্ছে কবিতার একটি বই বের করা। এটা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে এক কোটি টাকা চলে আসবে। কীভাবে আসবে? তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার দশমিনা থানার আদমপুর গ্রামে। তার উপজেলায় যত স্কুল-কলেজ আছে সবগুলোতে বইটি নিয়ে যাবেন। প্রতি শিক্ষক ও ছাত্রের কাছে একটি করে বই বিক্রি করবেন। বিক্রিলব্ধ টাকা এক কোটির কম হবে না। এ টাকা দিয়ে প্রথমে তিনি একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়টি নাম হবে : ‘ডোনাল্ড পোয়েট এড্রিস তালেব রাজ ট্রাম্প ওয়াল্ড নম্বর ওয়ান ইউনিভার্সেল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।’ আমেরিকাতেও এর একটা শাখা হবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ শাখার কোড নম্বর হবে-১, আর আমেরিকান শাখার কোড নম্বর হবে-২। তিনি কোনোভাবেই আমেরিকার শাখাটির কোড নম্বর ১ দেবেন না। কারণ তার কাছে বাংলাদেশ আগে, দেশের সম্মান তার কাছে অনেক বড়। বাংলাদেশ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের হেড অফিস থাকবে বাংলাদেশে, শাখা অফিস থাকবে আমেরিকায়। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর তিনি বাংলাদেশের সব কবিদের ডাকবেন তার অফিসে। অফিসের সামনে বড় একটা মাঠ থাকবে। তিনি আরএফএল কোম্পানি থেকে তিন শ চেয়ার কিনবেন। আগত কবিরা বসবে সেসব চেয়ারে। প্রত্যেক কবি একটি করে কবিতা আবৃত্তি করবেন। বিনিময়ে প্রত্যেকে তিনি ৫ শ করে টাকা দেবেন। তার দুজন পি.এস থাকবে, দুজন পিয়ন থাকবে। তিনি প্রাইভেট কারে চড়ে অফিসে আসবেন। অফিসে বসে সারাক্ষণ শুধু লিখবেন আর লিখবেন।

কবির কাছে তার লেখা কবিতা শুনতে চাইলাম। তিনি প্রথমে পড়তে চাইলেন না। পরে পড়তে শুরু করলেন। আমি কয়েকটি কবিতার স্ক্রিনশর্ট নিলাম। বানানরীতি হুবহু রেখে একটি কবিতার কিছু অংশ তুলে দেওয়া যাক। কবিতার নাম ‘স্বাধীন মনের সেই ছেলেটী।’

জীবনের দুঃখ রোগ আর থাকবে না ভাই
হবে না রোগের ভাটা
ক্ষেতের ভিতর পরে আছে অনেকগুলো ধান,
বছরের পর বছর রেখে করে অবোশান;
জীবন বাঁচে জেসব খেয়ে এতো তাদের অবোদান...
অনেক পুরনো একটি ঘর, ভেড়া ভেঙে একি হাল,
তবু উপরে আছে, নতুন টিনের লম্বা চাল
তালগাছের লম্বা আড়া, ভেঙে পরলে যাবে মারা
বন্দু নিধি করিস নে ঘর ভাড়া
ভেঙে গেলে সকোল হারা...।

ভবিষ্যতে এই কবির ইচ্ছে আছে দেশের বাইরে যাওয়ার। তিনি আমেরিকা যাবেন, ইন্ডিয়া, রাশিয়া যাবেন। আমেরিকা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তার একাউন্টে ঢুকে যাবে বিশ কোটি টাকা। আমি জিজ্ঞে করলাম, এত টাকা কীভাবে ঢুকবে আপনার একাউন্টে? তিনি বললেন, প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা বা খালেদা যে বিভিন্ন দেশে যায় তার একাউন্টে কত টাকা ঢোকে আপনি জানেন? একবার দেশের বাইরে গেলে দুই কোটি টাকা ঢোকে। আমি তো প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে অনেক বড়। আমি রবীন্দ্রনাথ, এরিস্টটল, প্লেটোর সমমানের কবি। হাসিনা-খালেদা তো আমার কাছে মাছি, তুচ্ছ একটা মাছি। আমি আমেরিকায় গেলে আমার একাউন্টে বিশ কোটি টাকা ঢুকবে না? ভারতে গেলে ঢুকবে দশ কোটি টাকা। আমেরিকার চেয়ে ভারত একটু নিচে তো, তাই অর্ধেক ঢুকবে।
কবির সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা আলাপের পর একটা জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় তাকে বিদায় জানালাম। চলে যাওয়ার জন্য তিনি উঠে দাঁড়ালেন। হাতে সেই রেজিস্টার খাতাটি, যেটিতে তিনি কবিতা লেখেন। এটি তার ছয় নম্বর খাতা। আমি তার মুখের দিকে তাকাই। তার চোখেমুখে স্বপ্নের দোলাচল।