ডৌল: জুলেখার জেরাপর্ব

রাদ আহমদ

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৮

জানুয়ারি ২৩ এ চলে গেলেন নিকানোর পাররা, ২৪ এ গীতিকার ও সুরকার কুটি মনসুর (আমি কি তোর আপন ছিলাম না রে জরিনা, দেখলাম শুনলাম কিছুই বুঝলাম না) আর ২৫ এ প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শওকত আলী। যখন চলে যাওয়া শুরু করেন, সমধর্মী মুরুব্বিরা একসাথে অল্প দিনের ব্যবধানে চলে যেতে থাকেন। কেন এমন হয়? এটা ভাবতে ভাবতে জানুয়ারি ২৫ এর বিকেলে এসে নামি শিল্পকলা একাডেমির সামনে। সিএনজি থেকে নামতেই একেবারে `স্ট্যান্ড-স্টিল`। বামে ট্রাফিক পুলিশ, ডানে রিকশা, ফাঁক দিয়ে বেরোতে গেলেই মোটরসাইকেল- ওদিকে সামনে গাড়ি- ফাঁকা স্থানগুলো পথচারীতে পূর্ণ। কোথাও যাবার জায়গা নাই। সেগুনবাগিচা আমাদের ছোটকালে অনেক স্মৃতিময় গাছে ঘেরা কাব্যিক আর মননশীল একটা স্থান ছিল। সেই আশায় গুড়েবালি। এটা মেনে নিয়ে কোনোমতে ফুটপাথে এসে উঠি।

এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নাট্যশালাটি আসলেই এক্সপেরিমেন্টাল। এটা আমি আগে থেকেই জানতাম। টিকেট বিক্রির স্থানটা মূল প্রেমিস থেকে একেবারে বাইরে। চা-সিগ্রেট বিক্রির দোকানগুলোর সাথে। চারতলায় নাটকে ঢুকতে গেলে পুনরায় নিচে পাঠিয়ে দেয় টিকেট কিনতে। তারপর টিকেট কাউন্টার খুঁজে ফিরে শেষপর্যন্ত সফল হয়ে টিকেট যোগাড় করে পুনরায় ফেরত যেতে যেতে ততক্ষণে নাটকের অর্ধেক শেষ। এই অভিজ্ঞতা আমার আগে থেকেই ছিল। সুতরাং স্টুডিও থিয়েটার খুঁজে পেতে সমস্যা হবে, এটা জানতাম। হলেও তাই। গ্রাম-বাংলায় একধরণের ভূত আছে- পথ ভুলিয়ে দেয়। সারা রাত ধরে মানুষকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সকাল বেলায় পুনরায় শুরুর স্থানে এনে দেয়। এই ভূত শিল্পকলাতেও আছে। এটার প্রমাণ পেলাম। সপ্তম ফ্লোরে যাবার লিফট খুঁজে পাই। কিন্তু নামার পরে আর উদ্দিষ্ট থিয়েটার হল খুঁজে পাই না। একবার ৬ এ নামলাম। আরেকবার ৭ থেকে সিঁড়ি ধরে উপরে চলে গেলাম। ৭ এ বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম। পরে একজন ব্যাকস্টেজ কর্মীর সহায়তায় ৫/৭ বার টার্ন নিয়ে শেষপর্যন্ত স্টেজের প্রবেশ পথ খুঁজে পেয়ে শান্তি পেলাম। ছোটো ছিমছাম হলে ঢোকার আগে ওই সপ্তম তলাতেই একটা খোলা স্থান। স্মোকিং করা যায়। চা-কফি খাওয়া যায়। এটা ভালো লাগালো বেশ।

নাটকের সময় কিছুটা পেছানোতে আমারই লাভ। প্রথম থেকে দেখার সুযোগ পাওয়া গেল। সুন্দর হল। দর্শক আর মঞ্চ খুব কাছাকাছি। মঞ্চের অবস্থান দর্শকদের সমান সমান। এটা ভালো লাগল বেশ। এক ধরণের আন্তরিকতা আছে যেন। নাটক শুরু হতেই মনোযোগ টেনে নিয়ে যায় এর চরিত্রেরা। জেরা, জেরার চমৎকার নাটকীয় কথা, অ্যাকশন, এগুলো মনোযোগ কেড়ে নেয়। জুলেখা বাদশার মেয়ে, এই শিশুতোষ ছড়া-কবিতার স্মরণ, আবার সাথে সাথেই দেখা যায়, এই বাদশা বাদশাহি বাদশা নয়, বরং একজন কৃষক বাদশা। গ্রাম বাংলায় বাদশা নামক কৃষক আছে অনেক, এটাও মনে পড়ে গেল। আমার নিজেরই পরিচিত একজন আছে। নীলফামারীর বাদশা মিয়া। সবমিলিয়ে এক অদ্ভুত পরিবেশের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে কাহিনি। ক্রমান্বয়ে নাটকের ঘটনা বা বক্তব্য উন্মোচিত হতে থাকে। আর বুঝতে পারা যায় যে, না, এই জুলেখা অত সরল জুলেখা নয়। একইসাথে সে বাদশা নামক কৃষকের মেয়ে, শিশুতোষ ছড়ার চরিত্র, একজন লেখিকা, আবার আরবে উদ্ভূত একাধিক একেশ্বরবাদী ধর্মকাহিনির অন্তর্গত সেই সুপরিচিত ইউসুফ-জুলেখার জুলেখাও বটে। আরব কেন্দ্রিক এই ধর্মগুলোকে অনেকে পুরুষতান্ত্রিকতার প্রচার ও প্রতিষ্ঠার সাথে মিলিয়ে চিন্তা করে থাকে। সেই হিসাবে জুলেখার চরিত্রটা যে `অপ্রেসড` (নির্বাপিত) হবে, সে বিষয়টা প্রথমেই সামনে চলে আসে। নবি ইউসুফের কাহিনিও চলে আসে একইসাথে। এই দুজনার কাহিনিকে স্মরণে রেখে নাটকের বিষয় ও বক্তব্য উন্মোচিত হতে থাকে। সুদর্শন নবি ইউসুফকে প্রথম দেখার সময় যে পরস্ত্রী জুলেখার (এবং সাথে সাথে সে ঘরে উপস্থিত অন্যান্য মহিলাদেরও সম্ভবত) ফল কাটতে গিয়ে যে আঙুল কেটে গিয়েছিল, সে কাহিনি আমি কোরান শরীফেই পড়েছি অনেক আগে। সেটার উল্লেখও আছে এই নাটকে। ইউসুফের চরিত্রটা পুরুষতান্ত্রিকতার প্রতিভূ হিসাবে দেখানো হলেও মাঝে মাঝে নিতান্ত মানবিক মনে হয়েছে। একইসাথে ধর্মরক্ষার দায়, মনের সায়, আত্মার সায় খুঁজে ফিরছেন একজন মানুষ। কী করবেন ঠিক যেন বুঝতে পারছেন না। এই দোটানা ভাবও চলে এসেছে চরিত্রে। ফলে শেষ পর্যন্ত বেশ ন্যাচারাল আর মানবিক হয়ে উঠেছে চরিত্রটা।

নাটকের এই পর্যন্ত এসে দর্শক হিসাবে দুটা ভাবনা কাজ করা শুরু করল আমার মাথায়। প্রথমেই তুলনা চলে আসল (অটোমেটিকালি), মেঘনাদ বধ কাব্যের সাথে। ধর্মে কিংবা ধর্মকাহিনিতে যিনি সুপ্রতিষ্ঠিত ভিলেন, তাকে উল্টাভাবে হিরোইক করে দেখা এবং দেখানোর বিষয়টা মনে আসল। পজিটিভ আলোতে নিয়ে এসে পুনর্বিবেচনা। এবং তার উপরে নতুন চিন্তা আরোপ। এই প্রক্রিয়ার সাথে মিলিয়ে নিয়ে ভাবতে ভাবতে মনে হলো, খাইছে! রাবণের পরিবেশটা তার আশেপাশের সভাসদ, স্থান, কাল ও পাত্রত্রীর সমাহার নিয়ে যে বিচিত্র এলিমেন্টে ভরপুর, সে রকম বিচিত্রতা তো জুলেখার কাহিনিতেই নেই। ইউসুফ-জুলেখার খুব বেশি উল্লেখও কিন্তু ওল্ড টেস্টামেন্ট আর কোরান শরীফে নাই। ঘুরে ফিরে অল্প কয়েকটা সেটিংস। ইহুদিদের অবশ্য ইদ্দিশ টেইলস নামে আরেকটা ধারা আছে। ওখানে কিছু অতিরিক্ত এলিমেন্ট থাকতে পারে। তবে সেসব মিলিয়েও রাবণের সভাসদের বৈচিত্র্যের ধারে কাছে এই কাহিনি যাইতে পারবে না। নাট্যকার কিভাবে এর মধ্যে `মজা` কিংবা `বিচিত্রতা` আনবেন? পরে দেখা গেল যে, না, ইতিহাসে জুলেখার অবস্থানকে কেন্দ্র করেই মূলত দুই কি তিনটি দার্শনিক ভাবনা এ নাটকে চলে আসছে। আর এই ধারাগুলোর প্রবল উপস্থিতি দর্শককে গোড়া থেকেই গ্রাস করে ফেলছে আর নাড়া দিয়ে যাচ্ছে।

দ্বিতীয় যে চিন্তাটা মাথায় আসল তাহলো, যে কোনো শিল্পকে তার সময়ের চাহিদা পূরণ করে দামি হয়ে উঠতে হয়। ঢাকা তথা বাংলাদেশের এখনকার সামাজিক ট্রেন্ড বা চাহিদার প্রেক্ষিতে এ নাটকের অবস্থানটা কি রকম হবে, এটা ভাবতে থাকলাম। একটু ব্যাখ্যা করি। বামপন্থী কিছু লিটারেচার পড়ছিলাম একসময়। তারা পুরো ইউরোপীয় রেনেসাঁকে যে রকম যুক্তির আলোকে, তৎকালীন চাহিদার আলোকে ব্যাখ্যা করে ফেলছিলেন, আমি খুব অবাক ও বিস্ময়াপন্ন আর সাথে সাথে হতাশও হয়ে গেছিলাম ওটা পড়ে। মধ্য যুগের রাজা আর ক্যাথলিক চার্চের সাথে টেক্কা দেবার মতো যখন একটা ধনিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটল ইউরোপে, তখন সেই নতুন শ্রেণির কথাগুলা আর বক্তব্যগুলা সমাজে বলিষ্ঠভাবে এস্টাবলিশ করার জন্য নতুন সংস্কৃতির দরকার পড়ে। ধর্মের প্রিস্টিন স্বর্গীয় সৌন্দর্যের চাইতে মর্ত্যলোকের সাধারণ মানুষের দিন যাপনের সাথে এর যোগসাজশ যে বেশি জরুরি, এটা দেখানোটা দরকার পড়ে। `মানুষের কথা` বলার দরকার পড়ে। প্রচলিত শিল্প সংস্কৃতি থেকে একটা শিফট করা দরকার ছিল। কারণ, প্রচলিত সংস্কৃতি শুধু রাজা আর চার্চের স্বার্থ সংরক্ষণ করছিল। আর এ কারণেই রেনেসাঁর শিল্পীদের সাহিত্য, চিত্রকলাকে ধনিকেরা হাইলাইট করে সামনে নিয়ে আসে। অর্থাৎ এ পুরা রেনেসাঁ পর্যায়টি জন্ম লাভ করে আর বিকশিত হয় কেবল মাত্র যেন ওই ধনিক শ্রেণির উদ্ভবের কারণেই। অর্থাৎ সমাজে প্রচলিত চাহিদার সাথে কোন শিল্পটি দাম পাবে তার একটা গভীর যোগসাজশ থাকে।

মধুসূদনের মেঘনাদ বধও কি তৎকালীন কোলকাতা কেন্দ্রিক সনাতনধর্মী বাঙালি সম্প্রদায়ের নতুন পলিটিকাল অবস্থান জোরালো করার জন্য দরকার ছিল না? ব্রিটিশদের সাথে টেক্কা দেবার জন্য নিজেদের আবহমান স্বীকৃত সংস্কৃতিকে ভেঙে পুনর্গঠনের ও পুনর্বিবেচনার দরকার ছিল। ঠিক একইভাবে আমি ভাবতে চাইলাম, জুলেখাকে কেন্দ্র করে এই ডৌল নাটকের অন্যতম মূল বক্তব্যটি ঢাকা শহরের বর্তমানে প্রচলিত চাহিদার প্রেক্ষিতে কি রকম হবে। ঢাকার সব কিছু আমি নিজে বুঝে বসে আছি তা নয়, কিন্তু একটু ভাবতে চাইলাম, আমার পর্যবেক্ষণ মতে সেই চাহিদাটা কি রকম। নাটকটি নিঃসন্দেহে নারীকে একটা স্বাধীন উচ্চতায় নিয়ে এসে বিবেচনা করছে। আর নাটকের অনেক বক্তব্যের মধ্যে একটি বক্তব্য হলো, নারীকে অপ্রেস (নির্যাতিত, নির্বাপিত) করে রাখছে ধর্ম আর পুরুষ। ঢাকার নারীদের কথা চিন্তা করলে, মোটা দাগে দুটা জিনিস আমার চোখে পড়ে। ড্রেস-আপ বা ফ্যাশন দিয়েই বিবেচনা করা যাক। একশ্রেণি সরাসরি পশ্চিমা বা আন্তর্জাতিক শহুরে কালচারে চলে যাচ্ছে। আর আরেক শ্রেণি দেখা যাচ্ছে পর্দার ছড়াছড়ি। অর্থাৎ বোরখা ও হিজাব এসবের ব্যবহার ভালো পরিমাণে হচ্ছে। যারা আন্তর্জাতিক নাগরিক কালচারে চলে যাচ্ছে তাদের কথা বাদ দেয়া যায়। কারণ তার প্রথমেই ধর্মের বা প্রচলিত কালচারের অপ্রেশন থেকে মুক্ত থাকার ঘোষণা দিয়ে দিচ্ছে। আবার যারা হিজাবের ধারাটি ফলো করছে, তাদের মধ্যে খুব ইদানীং কালে দেখা যাচ্ছে, হিজাবের মধ্যেই আকর্ষণীয় স্টাইল নিয়ে আসার চেষ্টা করছে ইয়াং মেয়েরা। একাধিক স্তর বিশিষ্ট মাথার ঘোমটা। বেশ ইন্টারেস্টিং, নয়নাভিরাম আর স্টাইলিশ একটা কায়দা। আবার অনেক বয়স্করা, আমার মনে হয়েছে, সম্পূর্ণভাবে মনেপ্রাণে হিজাবকে সমর্থন না করলেও বাসা থেকে বের হয়ে বাইরে কাজ করার সুযোগটি যেন অন্তত পায়, এই কারণে হিজাব জিনিসটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে আগ্রাসীভাবে মেনে নিয়েছে। মূল লক্ষ্য হলো, কাজ করার স্বাধীনতা। এখন এর প্রেক্ষিতে যদি হিজাব পরতে হয়, ঠিক আছে, আমি তাও পরব। এই ভাবনাটা মনে হয়েছে কাজ করে অনেকের মধ্যে। সুতরাং এখানে কিন্তু ধর্ম বড় বিষয় নয়। বিষয়টা হলো কোনোমতে একধরণের লোক-কালচার রক্ষা করে নিজের প্রাপ্তি বা স্বাধীনতাটা অর্জন করে নেয়া।

অন্যদিকে, মালয়েশিয়ার হিজাবীদের একটা জিনিস চোখে পড়েছিল কয়েক দিন আগে। ওদের নগরের কিছু মেয়ে মাথায় হিজাব পরছে ঠিকই, কিন্তু জামা কাপড়ে এমন কোনো নিদর্শন নেই যে তারা তাদের শারীরিক চার্মকে ঢেকে রাখবে। বরং আঁটসাঁট গেঞ্জির কাপড়ে বুনন করা জামায় তাদের শারীরিক সৌন্দর্য বেশ ভালোভাবেই প্রকাশিত হয়ে থাকে। হিজাবের মূলতত্ত্বে কিন্তু একটা বিষয় ছিল, পুরুষ ও নারী উভয়কেই (নারীদেরকে বেশি করে) তাদের শারীরিক চার্ম (সৌন্দর্য বা আকর্ষণ) ঢেকে রাখতে হবে। এমন না যে বোরখাই পরতে হবে। কিন্তু নিজের শারীরিক চার্মটা প্রদর্শন না করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ওখানকার ওই নারীরা ধর্মের মূলতত্ত্বকে না মেনে (চার্ম ঢেকে রাখা) দায় সারাভাবে লৌকিক দায় রক্ষা করছে। ঢাকায়ও এরকম বিষয় ঘটছে বলে মনে হয় অল্পবিস্তর। পুরোদমে নয়। কিন্তু একশ্রেণির ট্রেন্ড হয়তো ওইদিকেই যাবে। মূলকথা যেটা বলতে চাচ্ছি, এখানে কিন্তু গোড়াতেই ধর্মের সাথে একধরণের লুকোচুরি খেলা শুরু হয়ে গেছে। অর্থাৎ ধর্মের বিধিনিষেধ দ্বারা নারীরা কিন্তু নিজেদের সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত হতে দিচ্ছে না। যেভাবেই হোক, সৎ বা অসৎ, সরাসরি কিংবা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে, বলতে চাচ্ছি, ঢাকার এখনকার পরিস্থিতিতে ধর্ম দ্বারা নারীদের সরাসরি পর্যুদস্ত হওয়ার বিষয়টি অত স্ট্রং নয় এই মুহূর্তে। সুতরাং, নাটকের অন্যতম একটি ভাবনা অর্থাৎ, ধর্ম দ্বারা নারীদের অপ্রেসড হয়ে থাকার বক্তব্যটা গ্রহণ করার পিছনে অতখানি চাহিদা হয়তো বা ঢাকা শহরে এ মুহূর্তে নাই।

নাটকে ফেরত আসি। সর্বপ্রথম ভালো লেগে গেল যখন সংলাপ পর্যায় থেকে গান, এরপর গান থেকে সংলাপ, এরপর পুনরায় সংলাপ থেকে গানের পর্যায় আসতে থাকল। এ পালাবদলের পর্যায়গুলো ছিল খুবই স্বাভাবিক, ন্যাচারাল, সুন্দর আর মধুর। কোনোভাবেই খটকা লাগেনি। বরং ভালো লেগে যাচ্ছিল। মোলায়েম ট্র্যানজিশন। অদ্ভুত। বুদ্ধিদীপ্ত, চমৎকার সংলাপগুলো তো ছিলই। সংলাপের সময় গানের পর্যায়ের জন্য অপেক্ষা, আবার গানের সময় সংলাপের। আর এই চাহিদা মেটানো হয়েছে বেশ দক্ষভাবেই।

নাটকের অভিজ্ঞ দর্শক নই, তাই এ টার্মগুলো জানি না। নাটকের চরিত্রগুলো ব্যাকস্টেজের বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছিল প্রকাশ্যে, নাটকের ফাঁকে ফাঁকে। যেন নাটকেরই অংশ, এটা বেশ ভালো লাগছিল। জেরাকারী নাটকের মধ্যেই স্টেজের পিছনে গিয়ে টেবিলে ঝুঁকে লাইটিং নিয়ন্ত্রণ করছে, আবার সূত্রধর স্টেজের পেছনে গিয়ে লাইভ বাদ্য বাজিয়ে যাচ্ছে (আবহসঙ্গীত)। মাঝে মাঝে সবাই একসঙ্গে হয়ে চমৎকার সিনক্রোনাইজড এ্যাক্ট করে যাচ্ছে, এটা খুব চমৎকার লাগল। কোনো বাহুল্য নেই। নাটকের লাইটিং আর মিউজিক চালিয়ে নিচ্ছে নাটকের চরিত্রেরাই।

জুলেখার মুখে নিজের বাড়ির (বাবার) বর্ণনা ভালো লেগেছে। খুব দৃশ্যময়। যেন তার বাবা যখন গ্রাম থেকে শহরে আসে, মা আর তাকে ভিজিট করতে (অথবা, মায়ের বাবার সাথে ব্যবসায়িক আলাপ সারতে), সেই বর্ণনাগুলো খুবই উজ্জ্বল। যেন মনে মনে দেখা যায় সেই সময়গুলো। জুলেখা নাম্নী শিশুকন্যাটির চোখ দিয়েই। বিড়ালের মুখোশ পরা অভিনয় অত্যন্ত বিনোদন-সমৃদ্ধ। একটা মুখোশ আর তার সাথে সাথে উপযুক্ত অভিনয় যে কত অন্যরকম একটা মাত্রা নিয়ে আসতে পারে, এটা দেখে আমি ব্যক্তিগতভাবে বেশ অভিভূত। যে কোনো মুখোশকে এরকম বাস্তবিক পরিস্থিতির সাথে অবলীলায় মিশে যাওয়াটা কখনোই এর আগে কোথাও দেখিনি।

যতগুলো গান ছিল এরমধ্যে প্রত্যেকটির সুর অবশ্যই উৎকৃষ্ট মানের। স্বভাবিকের চেয়ে ভালো। একটা প্রযোজনায় এরকম একাধিক উৎকৃষ্ট ও ভিন্নধারার সুরের সমাহার (ডামাডোলের বাইরের সুর) চমৎকার একটা বিষয়। এরকম সহজে পাওয়া সম্ভব নয়। নারীকে শুধু একটা টিপিকাল চরিত্রের মধ্যে আটকে রাখেননি নাট্যকার এবং অভিনেত্রী। নারী যেন একইসাথে কোমল, ক্রিয়েটিভ, জনপ্রিয়, দুর্বল, সবল, অত্যাচারিত, অত্যাচারকারী (চোখে পেন্সিল ঢুকিয়ে দেয়া), নিষ্ঠুর, সাহসী, যৌনতায় অ্যাডভেঞ্চারাস (এক বুজির উল্লেখ ছিল নাটকের প্রথমদিকে,আরেক বুজিকে চুমায়)... অনেক কিছুই। এরকম কিন্তু সহসা পাওয়া যায় না আমাদের প্রচলিত নাটকে।

সবচেয়ে যেটা দাগ কাটল মনে, জানি না হয়তো এটা আমার ব্যক্তিগত ইন্টারপ্রিটেশনও হতে পারে, আমার মনে হয়েছে, জুলেখা আর ইউসুফের এই দ্বন্দ্বটি শেষপর্যন্ত শুধু নারী অপ্রেসনের ভিতর আটকে থাকেনি। এটা একজন শিল্পী তথা সাধারণ মানুষের খুব অন্তর্গত অন্যতম একটা দার্শনিক দ্বন্দ্বে চলে গিয়েছে মাঝে মধ্যেই। এটা করব, না ওটা? এটা করলে কেন করব, বা ওটা করলেই বা কেন? প্রচণ্ড ডিপ্রেশনের একটা রূপ ফুটে ওঠে। অর্থহীনতার টানাপোড়েন যা কিনা অনেকেই আমরা আমাদের জীবনে মাঝে মাঝে খুঁজে পাই, এই জিনিসটা প্রকাশিত হয়েছে নাটকে। বিশেষ করে ওই সময়টার কথা বলছি, যখন প্রেমিকের (নাকি জেরাকারীর) চোখে জুলেখা পেন্সিল ঢুকিয়ে দ্যায়।

ওই সময়টাতে জুলেখা আর তার সাথে সাথে জেরাকারীর মধ্যে পর্যায়ক্রমে যেই ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের প্রকাশ পেতে থাকে। একেবারে `ইনসেইন` বলা যায়। এটা অদ্ভুত। এর রিজল্ভ হয় সম্ভবত ওই প্রচণ্ড রকমের অর্থহীন অমীমাংসিত একটা টানাপোড়েন দিয়ে। যা শেষপর্যন্ত নারী আর পুরুষকেও ছাড়িয়ে যায়। ধর্ম আর শিল্পকেও ছাড়িয়ে যায়। তবে একটা সমালোচনা আছে। নাটকের শেষপর্যায় পিকাসোর আঁকা ছবির রেপ্লিকাটা (ডোরামারের একটা ছবি) নিয়ে আসাটা আমি অত সহজে নিতে পারিনি। মনে হচ্ছিল, ওই ছবিটা নাটকের বক্তব্যকে অনেকখানি খেয়ে ফেলতে উদ্যত হয়েছে। অনেক কথা যা নাটক দিয়ে বলা হয়ে গেছে, এর জন্য আবার ছবিটা কেন?

সব মিলিয়ে ভালো লাগার পাল্লাটাই ভারি বলতে হবে। নাটকের শেষে দর্শকেরা অনেকেই কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাতে তালি দিয়ে উঠেছেন। কিন্তু আমার খটকা লাগল, এ ধরনের মঞ্চনাটকে দর্শক এত কম কেন? কয়েক মাস আগেও একটি চমৎকার মঞ্চনাটক দেখা হয়, নভেরা। সেখানেও আমার একই জিজ্ঞাসা ছিল। এত চমৎকার চমৎকার কাজ হচ্ছে, নিজেদের চিন্তা, আবেগ, ধারণা উস্কে দেবার মতো কাজ হচ্ছে, অথচ দর্শকদের মধ্যে ঢাকার নব্য কিংবা পুরনো লেখকশ্রেণির কাউকে কিংবা নব্য ইন্টেলেক চুয়ালদের কাউকে তেমনভাবে দেখা যাচ্ছে না কেন? অন্যান্যদের দৈনন্দিন লেখালেখিতে স্টেজ-নাটকের কথা উঠে আসে না কেন? পত্রপত্রিকা বা মিডিয়াতেই বা মঞ্চ-নাটক নিয়ে এত নীরবতা কেন? চমৎকার শিল্পমাধ্যম, আর এই মাধ্যমে নানা চমৎকার কাজের মধ্যে আরও একটি যুক্ত হলো `ডৌল`। অথচ যে রকম সাড়াশব্দ আশা করা সমীচীন, তার অনেকখানিই কিন্তু নাট্যপাড়ার বাইরে অনুপস্থিত।

ঢাকা শহরের পয়েন্ট জিরো ওয়ান পারসেন্ট (০.০১%) লোকেও যদি নাটক নিয়ে উৎসাহী হয়, থিয়েটার হলগুলোর সবগুলো মিলিয়েও তো স্থান সংকুলান হবার কথা নয় সারা সপ্তাজুড়ে। এখনকার অবস্থা মোটেই স্বাভাবিক পরিস্থিতি বলে মনে হচ্ছে না। সম্ভাব্য দর্শকদের কাছে নাটকের খবর পৌঁছিয়ে দেয়া যাচ্ছে না। ডৌল নাটকটি সামনে আরও পরিবেশিত হতে হতে মানুষের চিন্তা, মনন ও আবেগকে উস্কে দিতে থাক। নানা ক্ষেত্রের সংস্কৃতিকর্মীরা, ইন্টেলেকচুয়ালেরা, দর্শকেরা, ছোছ-বড় সবাই মঞ্চনাটকে নিয়মিত গতায়াত করুক, এই কামনা করি। নাট্যকার, নির্দেশক আর চমৎকার দক্ষ কুশীলবদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। জুলেখা চরিত্রে পারভীন পারু, জেরাকারী কিংবা ইউসুফ চরিত্রে জুনায়েদ ইউসুফ, সূত্রধর কিংবা গায়েন চরিত্রে শিশির রহমান এবং নাট্যকার চয়ন খায়রুল হাবিব- প্রত্যেকেই অসাধারণ শ্রম আর আন্তরিকতা দিয়ে এই স্মার্ট প্রোডাকশনটি গড়ে তুলেছেন, এটা বোঝা যায়। আমার জানা মতে, ডৌল প্রোডাকশনটি ‘জুলেখা ট্রিলজ’র অংশ। বাকি দুটো পর্ব দেখার জন্যেও অনেক আগ্রহ জারি থাকল।