তাদাও আনদো ও তার হাইকু স্থাপত্য

তারিকুল লাভলু

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৭, ২০১৮

এশিয় স্থপতিদের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত জাপান কংগ্রেসে অংশ নেয়া শতাধিক বাংলাদেশি স্থপতি ও স্থাপত্যের ছাত্রছাত্রীদের `ক্রাশ` ছিল জাপানি স্থপতি তাদাও আনদো ও তার অসাধারণ সব কাজ। ছোট ছোট গ্রুপে ঘুরে বেড়ানো আমাদের দলগুলির প্রত্যেকের ভ্রমণ তালিকায় স্থান করে নিয়েছিল টোকিও, ওসাকা বা কিওতোর নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা স্থপতি আনদোর ছোট বড় উল্লেখ্যযোগ্য নানা স্থাপত্যকর্ম। বর্তমান ও হবু স্থপতিরা সেই কাজগুলি দেখে একধরনের প্রশান্তির অনুভবে ভাসিয়ে দিয়েছেন নিজের কান্তি ও ক্লান্তি। অনুপ্রাণিত হয়েছেন। বিমুগ্ধ, বিহবল ও সমৃদ্ধ হয়েছেন নিজের চিন্তায় ও সৃজনকল্পনায়।

স্থাপত্যের ভিতরে ও বাইরে যথার্থভাবে ঠিক এই অনুভবের ক্ষেত্রটুকু সৃষ্টি করতে পারাটাই হচ্ছে স্থপতি তাদাও আনদোর কাজের অন্যতম সাধনা ও সফলতা। আনদোর সৃষ্ট স্থাপত্য সাধারণভাবে সহজবোধ্য, সরল, স্পষ্ট এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি বন্ধুসুলভ। এই বিরল শৈলী তিনি অর্জন করেছেন নিজের চিন্তার স্বচ্ছতা ও বলিষ্ঠতা থেকে এবং যার অনুপ্রেরণা তিনি সংগ্রহ করেছেন দিনের পর দিন অপরাপর গুরু স্থপতিদের বিখ্যাত অথচ আপাতঃ আটপৌরে সব কাজের সৌন্দর্য মন্থন করে।

জাপানের অসংখ্য স্থাপত্যের স্থপতি তাদাও আনদোর জন্ম ১৯৪১ সালে। আনদো কখনোই কোনো প্রথাগত স্থাপত্যের ছাত্র ছিলেন না। অন্তর্গত শিল্প সুষমা যার থাকে তার জন্য প্রথাগত শিক্ষা জরুরিও নয়। শিল্পের নানা শাখায় সফল অনেক শিল্পীর ক্ষেত্রেই এই কথা প্রযোজ্য। যৌবনের শুরুতে তিনি যখন একজন মুষ্টিযোদ্ধা এবং কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, নিজের জন্মস্থান ওসাকা থেকে টকিওতে এসেছেন বেড়াতে। উঠেছেন টোকিওর ইম্পেরিয়াল হোটেলে। বলা যায়, এই হোটেলে ওঠার ঘটনাটাই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।

ইম্পেরিয়াল হোটেলের স্থাপত্যশৈলী দেখে আনদো একাধারে এতই বিস্মিত, মুগ্ধ ও অনুপ্রাণিত হলেন যে, তার অন্তরের সমস্ত বাসনা স্থপতি হবার আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল হয়ে উঠলো! কারোই অজানা নয়, এই হোটেলের স্থপতি ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইট! পরবর্তী দুই বছর আনদো তার বক্সিং পেশায় ইস্তফা দিয়ে এবং হাইস্কুল গ্রাজুয়েশন শেষ করে স্থপতি হবার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। নৈশক্লাসে ভর্তি হয়ে অঙ্কন ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনে তালিম নেয়ার পাশাপাশি স্থাপত্যের পঞ্চগুরুর অনন্য চারজন অর্থাৎ লী করবুসিয়ের, মিজ ভেন্ডার র‍্য, ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইট ও লুই কানের নক্সা করা কাজগুলোর যতগুলো সম্ভব দর্শন, নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও অধ্যয়নে নিবেদিত হলেন।

১৯৬৮ সালে ওসাকায় ফিরে নিজ ফার্ম প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত তিনি একনিষ্ঠভাবে এসবেই বুঁদ হয়ে থাকলেন। একজন ওসাকান জাপানি হিসেবে আনদোর কাজে জাপানি ধর্ম ও জীবনাচারের প্রত্যক্ষ প্রভাব সুস্পষ্ট। বলা হয়, আনদোর স্থাপত্য হচ্ছে জাপানি `হাইকু` কবিতার মতো, যেখানে স্থাপনার সৌন্দর্য ও সাধারণত্ব প্রকাশের জন্য একটা পরিসর সৃষ্টি করে তার শূন্যতাকেই বিশেষ গুরুত্বের সাথে ত্রিমাত্রিক অবয়বে ফুটিয়ে তোলা হয়। অর্থাৎ নির্মিত স্থাপনা নয়, তার দ্বারা সৃষ্ট পরিসরটাই স্থাপত্য। সেটাই গল্প।

হাইকু হচ্ছে পৃথিবীর সংক্ষিপ্ততম কবিতা। ১৭ শতকে চর্চিত তিন লাইনে সতেরোটা (৫-৭-৫) সিলেবলে রচিত এই কবিতার গঠনশৈলী একমাত্র জাপানি ভাষাতেই সম্ভব। অন্য ভাষায় অনুদিত হাইকু তাই তিন লাইনে রক্ষা পেলেও সতেরো সিলেবলর নিয়ম মেনে চলতে ব্যর্থ হয় প্রায়শই। হাইকুর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তাতে ঋতুর প্রতি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কের আভাস থাকতেই হবে। এমনকি যখন ব্যক্তিগত আবেগকে কেন্দ্র করে হাইকু লেখা হয়, সেখানেও ঋতুর ইঙ্গিত প্রত্যাশা করা হয় যাতে ব্যক্তির আবেগ আর প্রকৃতির নৈর্ব্যক্তিক অভিব্যক্তির মধ্যে একটা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবেই বিশেষ আবেগ বা অভিজ্ঞতাকে প্রকৃতির মাধ্যমে সর্বজনীন করে তোলা হাইকুর বিশেষ গুণ হিসেবে বিবেচিত ও স্বীকৃত।

হাইকু সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তার জাপানযাত্রীতে লিখেছেন, ‘এ ছবি দেখার কবিতা, গান গাওয়ার কবিতা নয়।’ এই যে একটা ভাবকে দৃষ্টির সামনে ছবির মতো ফুটিয়ে তুলে সেটার বহুমাত্রিক রূপকে কল্পনায় প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা, তার সাথে জীবনবোধ আর প্রকৃতির একাত্মতাকে মিলিয়ে নেয়া, এখানেই বোধহয় হাইকু পাঠ আর স্থাপত্যের মধ্যে বসবাসের অনুভূতি একসুরে, ছন্দে ও ভাবে অনুরণনিত হয়। স্থপতি তাদাও আনদোর রচিত খালি পরিসরের আপাত শূন্যতার অন্তরালে সেই পরিসর যাপিত জীবনাচারের যে ভাব, ভাষা, দুঃখ, আনন্দের অনুভূতিকে ধারণ করে থাকে এবং দিনের নানা সময়ে, ঋতুর নানা বদলে আলো, আঁধার আর চৌহদ্দির মহিমায় তাই প্রকাশ করে, সেটাই আসলে আনদোর স্থাপত্য।

মানুষের জীবন ও প্রকৃতিতে বিরাজমান আধ্যাত্মিক ভাব ও সংবেদনশীলতাকে স্থাপত্যের নানা পরিকাঠামো রচনার মধ্য দিয়ে যুগপৎ ধারণ ও সম্পর্কিত করার মাধ্যমে কোনো ভবন বা স্থাপনাকে সেটার ব্যবহারিক উপযোগিতার সাথে সাথে একটা দার্শনিক ও আদর্শিক মাত্রা দেয়ায় আনদোর যে মুন্সীয়ানা তার জন্য তিনি স্মরণীয় এবং অনুকরণীয় হয়ে থাকবেন নিশ্চিতভাবেই। তার এই দক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে এরই মধ্যে প্রিটজকারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।

টোকিওতে আমিসহ আমাদের অনেক স্থপতি ছিলেন নিউ ওটানি হোটেলে। কংগ্রেস চলাকালীন সময়ে জাপান স্থপতি ইন্সটিটিউটের অফিসিয়াল হোটেল ছিল সেটা। আবার অনেকেই ছিলেন অনুষ্ঠান কেন্দ্রের আশপাশের হোটেলে। কিন্তু যেই হোটেলটা একসময় আনদোর জীবনটাকেই পালটে দিয়ে আজকের স্থপতি তাদাও আনদোর জন্ম দিল, স্থপতি ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইটের সেই পেনিনসুলা হোটেল আমরা কেউ দেখতে গিয়েছি বলে জানা নাই। হয়ত এই তথ্যটাই জাপান অবস্থানকালে আমাদের অজানা ছিল। তবে হাইকু কবিতা নিয়ে যে উৎসাহ জাপান ঘুরে আসার পর নিজের মধ্যে অনুভব করছি, কবিতাগুলো পড়ে হাইকুর রসাস্বাদনের সাথে সাথে আনদোর স্থাপত্যগুলো ঘুরে দেখবার সেই মুহূর্তের যে অনুভূতি, এই দুইয়ের মধ্যে দেখি মিল খুঁজে পাই কীনা।

আপাতত এই শরতে সবচে` পুরনো ও সেরা হাইকু কবি বাশোর (১৬৪৪-৯৪) একটা কবিতার সাথে নিজের দেখা ফুজি পাহাড়ের অভিজ্ঞতা যে দারুণভাবে মিলে যাচ্ছে, সেটা বেশ বুঝতে পারছি!

শরতের হিমেল বৃষ্টি
ফুজি পাহাড়ের পর্দা করে
তাই তাকে আরো সুন্দর দেখায়।

গুরুদেব যথার্থই বলেছেন, `এ ছবি দেখার কবিতা, গান গাওয়ার কবিতা নয়!`