তারা ভাষার খোলস চেনে, ভেতরটা জানে না

মৃদুল মাহবুব

প্রকাশিত : মে ১৩, ২০১৮

সরল ভাষায় লিখতে পারার মধ্যে একটা সাহসের ব্যাপার আছে। মাছ বাজারের ভাষায় আমরা লিখি না কেন? মুখের ভাষার ফর্ম আর লেখার ভাষার ফর্ম আলাদা বলে? লিখিত ভাষাকে আমরা জটিল ও আলাদা করে তুলতে চাই কেন? ভাষাকে অলংকার দিয়ে সাজিয়ে তোলার ব্যাপকতর প্রচেষ্টা কেন? অতীতে গড়ে ওঠা ফ্রেজের বাইরে আমরা যাই না কেন?

একাডেমিকভাবে স্বীকৃত ভাষা ও পদ্ধতি, রূপকেই দুনিয়ার বেশির ভাগ সাহিত্য লেখা হয়। লক্ষ্য করে দেখবেন, সাহিত্যের ভাষা বলতে আমরা যা বুঝি তা তৈরিকৃত একটা ব্যাপার। আলো-আঁধারি ধোঁয়াশাপূর্ণ ভাষা দিয়ে কবিতা আগাতে চায়। অধিকাংশ কবিতা শব্দের নন্দন তৈরির জন্য লেখা হয়। কেন? আমরা যে বলি কবিতার নিচ থেকে নাম বাদ দিলে সবার কবিতাই এক হয়ে যাবে, কথাটা বহুলাংশে সত্য। নিজের ভাষার কাঠামো দিয়ে পৃথক হয়ে যাওয়া কবি সাহিত্যিকের সংখ্যা অপ্রতুল। সেজন্য শুধু মাত্র ভাষার দ্বারা সাহিত্যে আলাদা হয়ে যাওয়া কোনও এক্সামপল না, এক্সপ্রেশন। এ কারণে জীবনানন্দ, উৎপল, রবীন্দ্রনাথসহ আরও অনেকেই উদাহরণ বাংলা সাহিত্যে।

সে হিসাবে ভাষাকে সাহিত্যের প্রধানতম আকর্ষণ বলা যাচ্ছে না, যেহেতু তার উদাহরণ কম। আপনি ভাষায় আলাদা হতে চাইতেই পারেন, তবে তা অবধারিত নয়। যেহেতু কবির উদাহরণ হিসাবে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সিকদার আমিনুল হক, আবিদ আজাদ, মাসুদ খান, ব্রাত্য রাইসু, মজনু শাহসহ আরও অনেকেই আছেন। সামান্য উদাহরণ হিসাবে অল্প কিছু নাম দিলাম। বাংলা ভাষার জীবিত আরও অনেকেই আছেন, যারা কবিতাকে শুধুমাত্র ভাষার বাইরে নিয়ে এসেছেন। ভাষা দিয়ে এদের বিচার করা যাচ্ছে না আর। জীবনানন্দ পরবর্তী ইমেজ নির্ভর বিশেষণ থেকে তারা নতুন নতুন বিশেষ্যের ব্যবহারে তুখোড়। নাগরিক বহু নামমূলক শব্দ, অনুসঙ্গ তাদের কবিতায় পাওয়া যায়।

খুব খেয়াল করে এসব কবিতা পড়লে ব্যাপারটি বোঝা যায়। এটাই তাদের শক্তি। জীবনানন্দীয় ও উৎপলী ভাষানির্ভর বাংলার বিপরীতে হয় তারা লিরিসিস্ট কেউ কেউ, না হয় রক অ্যান্ড রোল হাই ভোকাল, বাদ্যযন্ত্রের কর্কশ ঝনঝনানিমুখর। এদের কারোরই জীবনানন্দ বা উৎপলের মতো খুব প্রবলতর ভিন্ন বাংলা ভাষা নাই। লিখিত বা মৌখিক কোথাও আপনি জীবনানন্দের বা উৎপলের ভাষাটাকে পাবেন না। এটাই এই ভাষার প্রধানতম দুর্বলতা। অনেকে হয়তো বলবেন লেখার ভাষা ও ব্যবহারিক ভাষা আলাদা। কিন্তু লেখার ভাষা সময়ে ব্যবহারের ভাষা হয়ে ওঠে। মুখের ভাষাও শিল্পের ভাষা হয়ে ওঠে। লালন বা শাহ আব্দুল করিমের গান মুখের ভাষাই। যেমন রবীন্দ্রনাথের বাংলায় সুমন বা অর্ণবরা এখনো গান গায়।

মানে সেই ভাষার একটা ব্যবহার রয়েই গিয়েছে। দিন দিন শিল্প সহজতর ভাষা দিকে যাবে। মনি কাউরের `হানি অ্যান্ড শিল্প` পড়লাম। তার ইংরেজি ভাষা শিল্প লেখার ভাষা না। ইমরুল হাসানের কবিতার বাংলা সরল বাংলা কবিতার ভাষাইতো। ভাষা কেমন সহজ হয়ে যাচ্ছে! এ ভাষার ট্রেন্ড আমি লক্ষ্য করি। অতি সরল ভাষায় কবিতা লেখা দরকার, যে ভাষায় আদালত সমন দেবে। কিন্তু লোপামুদ্রা যে কবিতাগুলো গান হিসাবে গেয়েছে, সেই সমস্ত সিডির উপর জীবনানন্দের ছবি না থাকলে কেউ এগুলো শুনতো না। বাংলা কবিতার ভাষাকে সহজ করে আনার জন্য এবং এই সহজতাকে কবিতার উদাহরণ তৈরি করার জন্য ৭০ পরবর্তী বহু কবির কবিতার উদাহরণ আছে। ভাষা কবিতা না, শিল্প না, সাহিত্যও না। ভাষা একালে একটা মাধ্যম মাত্র।

শিল্প বা সাহিত্যকে সরল হতে হয়। কিন্তু বহু অসরল কবিতাও আছে। থাকা দরকারও। তবে সরল হতে না পারার কারণটা ভেবে দেখা যায়। সরল আপনি হতে পারেন না অথরিটির কারণে। সরল লেখা অথরিটির কাছে থেকে কোনও স্বীকৃতি পাবে না। বিরাট একটা এনকাউন্টারে পড়ে যায় লেখাগুলো। স্বীকৃত সাহিত্যের ভাষা হলো জটিলতালা। একাডেমিক ব্যাপার। ভাষাকে সরল করার সাথে সাথে ভাষার যে অথরিটি থাকে তা ভেঙে পড়ে। সরল ভাষার পক্ষে দাঁড়ানো মানে একাডেমির ভাষার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।

ত্রিশের কবিরা রবীন্দ্র ভাষার বিরোধীতা করে যে ভাষা তৈরি করেছে বাংলা কবিতার তা জরাক্রান্ত, জটিলতার আরাধনাময়। এসব কমপ্লেক্সসিটির প্রতি হেলে থাকার যে অথরিটি তা ভাঙে দেয়া যায়। লেখক কোন ভাষায় লিখছে তা তার একটা রাজনীতি। অথরিটি ভাঙার উদ্দেশ্যে আপনি সাহিত্যের শব্দ পরিবর্তন করলেন কিন্তু ভাষাকে গুরুগম্ভীর করে রাখলেন, তবে যা তাই হলো। মান ভাষার বিপরীতে অপ্রমিতের সংগ্রাম ঠিক এমন। অপ্রমিতকরণের উদ্দেশ্য যদি ভাষাকে সরল করা না হয়, তবে এগুলোর কোনও দাম নাই। যারা করতেছি, খাইতেছি, যাইতেছি মূলক ক্রিয়ার পরিবর্তনকে সাহিত্য ভাষার পরিবর্তন বলে, তারা ভাষার খোলস চেনে, ভেতরটা জানে না।

প্রমিত ভাষার প্রতি আঘাত হলো তার অর্থ উৎপাদনের অসরলতাকে ভেঙে দেয়া। অপ্রমিতের আন্দোলনও হওয়া উচিত ভাষার সরলতা কেন্দ্রিক। এখন পর্যন্ত অপ্রমিতবাদী সাহিত্যিক ও শিল্পীদের চর্চা তেমন কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজ নাই। উদাহরণ নাই। অপ্রমিতের সরলতা কই? ওই হচ্ছে তো ত্রিশের ক্লিশে সাহিত্যের রিপ্রডাকশন। প্রমিত ও অপ্রমিত, সাধু ও চলিত সবই একটা শ্রেণির জন্য তৈরি হয়েছে। প্রমিতই শুধু না, অপ্রমিতও একাডেমির ভাষা হয়ে উঠতে পারে যদি ভাষার ঐতিহ্যটাকে না বদলান। যতদিন যাবে ভাষা ততই সরল অর্থপূর্ণ হবে।

লেখক: কবি ও গদ্যশিল্পী