অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরিন

অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরিন

তীরন্দাজ

পাপিয়া জেরিন

প্রকাশিত : মার্চ ০১, ২০১৮

আপনাদের এলাকার নাম নগরকোণ্ডা, তাই না? বড় অদ্ভুত নাম!
হুম, নগরকোণ্ডা। অ্যানাকোণ্ডা সাপের আধিক্যের জন্য এমন নাম।
আনিস চমকায়া ওঠে। লোকটা কি মশকরা করতেছে? এমন একটা গম্ভীর মুখ নিয়া মশকরা করার কথা না। লিণ্ডা আগেই আনিসরে জানাইছে, তার বন্ধু সবুজ একটু রহস্য করে। আসলে আনিসের সাথে লিণ্ডার কথার আশিভাগই এই সবুজরে নিয়া। সবুজ সারারাইত না ঘুমায়ে কি কি অদ্ভুত কাজ করে। সবুজের মন খারাপ হইলে সে ঘুঙুর পইরা বনে বনে ঘোরে। সবুজের কাছে কয় ধরণের পিস্তল আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। মাঝে মাঝে মনে হয়, লিণ্ডা আসলে তার প্রেমিকা না, বরং সবুজের প্রেমেই মনে মনে হাবুডুবু খাইতেছে।

আনিসের কিছুতেই মাথায় আসতেছে না, তারা কেন পাকা রাস্তা রাইখা এই জঙ্গল দিয়া যাইতেছে। সাভারের মতো এমন একটা উন্নত জায়গায় জঙ্গলের পর জঙ্গল পার হইয়া নগরকোণ্ডায় যাইতে হইতেছে ক্যান। আরও আজব লাগতেছে যে, একই জঙ্গলের মইধ্যে তারা তিনবার পাক দিছে। সবুজ লোকটা কি আসলেই সুস্থ কীনা তা নিয়া তার সন্দেহ হইতেছে। সবুজের বেশভূষাও অদ্ভুত, প্রচণ্ড গরমের মইধ্যে সে গলায় একটা পশমি চাদর প্যাঁচ দিয়া আছে। ডানপায়ে একটা বিশাল ব্যান্ডেজ, প্লাস্টার টাইপ উঁচা ব্যান্ডেজ। আনিসের আর সহ্য হইতেছে না। সারাটা শরীর ঘাইমা চুলকাইতেছে।
সে ডাক দিল, সবুজ ভাই, ও ভাই... আর কতক্ষণ লাগবে?
এই তো ভাই, আর দুই মিনিট। আপনি একটু সাবধানে পা ফেইলেন। আসলে আমাদের এলাকায় এনাকণ্ডা না, গোখরা সাপের আধিক্য। এই যে আমার পায়ে যে ব্যান্ডেজ দেখতেছেন... এটার নিচে আমি ঘুঙুর পরছি। ঘুঙুরের উপরে কাপড় বানলে আওয়াজটা অল্প শুনা যায়, তবে সাপ ঠিকই এই ফ্রিকোয়েন্সি ধরতে পারে। বুঝলেন?
বলেন কী!
এই তো আমার বাড়ি। আসেন আসেন আনিস।
সবুজ ভাই, আমরা এত ঘুরপাক খায়া পেছন দিয়া আসলাম। অথচ আপনার বাসার সামনে পাকা রাস্তা ওই যে মেইন রোডে মনেহয় মিশা গেছে। ভুল বলছি?
না, ভুল বলেন নাই। আমি আসলে রাতের বেলা সোজা রাস্তায় চলি না। আসেন, ওয়াশরুমে যান। ফ্রেশ হন। আমি খাবার নিয়া আসি।

রাত দুইটা বাজে। সবুজের কোনো খবর নাই। খিদায় আনিসের মাথা ধইরা গেছে। ঘুমও আসতেছে না। পাশের রুমে একটা বাচ্চা কিছুক্ষণ পরপর কাইন্দা উঠতেছে, মনে হয় সবুজের ভাইয়ের বাচ্চা। বিছানায় হেলান দিতেই বালিশের তল থিকা একটা পিস্তল বাইর হইয়া আসে... নিশ্চয়ই জিনিসটা লোড করা! ঘরের অর্ধেকটাই এক বিশাল বুকশেলফ্। অদ্ভুত সব বইয়ের কালেকশন। গ্রাম্য ডাকিনীবিদ্যা থিকা শুরু কইরা ফ্রয়েডের ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস সবই আছে। রুমের এককোণায় স্ট্যান্ডে দাঁড় করানো একটা অসম্পূর্ণ পেইন্টিং। নিচের কার্টিজ পেপার তিনটাতেও একই স্কেচ... ঠিক একই জায়গায় অসম্পূর্ণ।
আনিস, ছবিতে হাত দিয়েন না।
ও ভাই! আসছেন? এতক্ষণ লাগলো যে!
হুম। আপনে তো ভালোই কৌতূহলী। আবার খাটের নিচে উঁকি দেন নাই তো!
ক্যান সবুজ ভাই? খাটের নিচে কি?
ভাই, খাটের নিচে ডিমদিয়া মুরগি বসানো হইছে। আমার আম্মার কাম। আর ওই কোণায় ডুলার মইধ্যে গোখরা সাপ।
কী বলেন!
আরে আর্টিফিশিয়াল। গতমাসে ইন্ডিয়া গেছিলাম। একশো ডলার নিছে জিনিসটা... দেখেন। আরে ডরান ক্যান! হাত দিয়া দেখেন। আমার এক বন্ধুর শুটিংয়ের কাজের জন্য আনা এইটা। হা হা হা।
সবুজ ভাই, আপনে এমন ক্যান?
ধুর মিয়া, আগে খান। পরোটা-মাংস আনছি। খাওয়া শেষে লিকারের ব্যবস্থাও করা আছে। আপনে মিয়া আমার একমাত্র বান্ধবীর হবু স্বামী। একটু খাতির যত্ন না করলে হয়?
ওইসব খাই না আমি। মায়ের নিষেধ। আমি পাঁচ বইনের পর এক ভাই। বুঝেনই তো!
ও, এই খবর? লিণ্ডারে কি ফোনে জানাইছেন যে, আপনে সহিসলামত আমার বাসায়?
না, রাত বারোটার পর ওরে ফোন বা ম্যাসেঞ্জারে নক্ করা নিষেধ। ওর স্বামীর কাছে ফোন জমা থাকে।
এইসব কথা লিণ্ডা আপনেরে বলছে? আজব! আপনেরে তো দেইখা তো বুদ্ধিঅলা লোকই মনে হয়। আইচ্ছা, দিনাজপুরে আপনে কোন কলেজে পড়ান?
সবুজ ভাই, আমার কলেজের নাম সংগীত মহাবিদ্যালয়।
ও, আপনি মিউজিক টিচার?
না, আমি তো বাংলা পড়াই সেখানে। সংগীত মহাবিদ্যালয় নাম হইলেও এটা একটা বেসরকারি কলেজ।
ও আচ্ছা আচ্ছা! আপনার কথায় তো দিনাজপুরের টান নাই। বিষয় কি?
ভাই, আমার দাদাবাড়ি দিনাজপুর। কিন্তু আমরা মানুষ হইছি শ্রীনগরে, নাবিবাড়িতে। দাদির সাথে ঝামেলা কইরা আমার মা তার বাপের বাড়ি আইসা পড়ছিল। সে এক বিশাল হিস্ট্রি। কিন্তু, সবুজ ভাই... কথা সেইটা না। আপনে মনে হয় লিণ্ডার বিষয়ে কিছু কইতে চাইলেন।
কই! না তো!
ওই যে বললেন, আমারে তো বুদ্ধিমানই মনে হয়।
আনিস, আপনে আগে হাত ধুয়া আসেন। পরে বলি।

রাত সাড়ে তিনটা বাজে। সবুজ একনাগাড়ে ৬টা সিগারেট শেষ করছে। সিগারেটের নতুন প্যকেট রুমের ভিতর, সেখানে এখন যাওয়া যাবে না। আনিসরে সি.সি. ক্যমেরার ফুটেজ দেখানো হইতেছে। লিণ্ডা ও তার প্রাক্তন প্রেমিক সুমনের অন্তরঙ্গ ভিডিও। আরও আছে ফেসবুক ফ্রেন্ড তুহিনের সাথে কিছু ক্লিপস্। লিণ্ডা এইসবের কিছুই জানে না। সবুজই লিণ্ডারে বলছিল, সে যাতে নানা কফিশপে না ঘুইরা এ বাসায় আইসা প্রেম করে। কোন কুক্ষণে যে এই কথা বলতে গেছিলো... তারপর একের পর এক লোক নিয়া বাসায় আসা শুরু হইলো। সবুজের বুকশেলফের ফাঁকেই সি.সি. ক্যমেরা। যে কোনও ছাগল অনায়াসে এই ক্যামেরা খুঁইজা বাইর করতে পারার কথা। কিন্তু যেমন বেকুব লিণ্ডা, তেমন বেকুব তার প্রেমিকেরা।

সবুজ ভাই! সবুজ ভাই!
বলেন। কি হইলো? বলেন এইবার।
ভাই, বুঝায়া বলেন এইসব কী!
আনিস, আপনে একটা খারাপ চক্রে পইড়া গেছেন। লিণ্ডা ফেসবুকে বইসা আপনের মতো কিছু বেকুব লোক জোগাড় করে, আর এইসব ভিডিও বানায়া বহুত পয়সা কামায়। ব্ল্যাকমেলিং বুঝেন তো! আমি ওর বন্ধুটন্ধু কিছুই না। নরমাল এজেন্ট। কিন্তু আপনেরে দেইখা আমার খুব মায়া হইলো, আপনে এক মায়ের একক পুত। আমার মা কয়... এক মায়ের এক পুত, মইরা গেলে টুক্কুরুত্। আপনে সকাল হওয়ার আগেই বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। সবচে ভালো হয় শ্রীনগর চইলা যান।
সবুজ ভাই! আল্লাহর রহমত আর পিরপয়গম্বরের দোয়া। আপনে একজন ফেরেশতা ভাই!
আমি কোনো ফেরেশতা না। আপনে আজাইরা প্যাঁচাল বেশি পারলে, বাইন্ধা থুমু... তারপর আপনারে নিয়া নতুন ভিডিও ক্লিপস্ হবে। ভালো কথা! আপনেরে যে সব কয়া দিলাম, আপনে তো মিয়া পুলিশরেও খবর দিতে পারেন।
ভাই এইসব কী কন! আপনে আমার কাছে একজন দেবতা। আমি ক্যান পুলিশি ঝামেলায় যামু। আমার বউ আছে, সংসার আছে।
আনিস, কন কী এইসব! আপনে বিবাহিত? আপনের রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস তো সিঙ্গেল।
ভাই, আমি বিবাহিত। দুই বছরের বাচ্চাও আছে আমার। আমারে আপনে একটু মেইন রাস্তায় দিয়া আসেন।
আনিস, আপনে নতুন সীম তুলেন। এই আইডি ডিএক্টিভেট কইরা নতুন আইডি খুলেন। লিণ্ডা আপনেরে ছাড়বো না। কন্ট্রাক্ট কিলার দিয়া আপনারে শেষ কইরা দেবে।
ভাই, আপনে যা বলবেন তাই করবো। জীবনেও ফেসবুক চালাবো না রে ভাই!
দ্যান, সীমটা খুইলা দেন। চলেন, বাসে তুইলা দেই আপনেরে। আবার সেই জঙ্গল দিয়াই যাইতে হইবো। আপত্তি নাই তো?

লিণ্ডা বইসা আছে সবুজদের ড্রংইং রুমে। খালাম্মা আইসা মাথায় হাত বুলায়া এক কাপ চা আর চানাচুর দিয়া গেছে। লিণ্ডার মন অসম্ভব ভালো...আজকের হেয়ারকাটে তারে দারুণ মানাইছে।
লিণ্ডার চুল ছিল কোমর পর্যন্ত, অসম্ভব সিল্কি। সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত জামাই মাইর দিতে গিয়া সবার আগে তার চুলের মুঠি ধরে। চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে আজকে তার চুলের ভয়াবহ দশা। চুলের বেহাল অবস্থা ঢাকতে মাসে মাসে তারে নিউ হেয়ার কাট নিতে হয়। আজকে লিণ্ডার চোখে পানি আইসা যাইতেছে... আনিসের সাথে দেখা হইবো। দরকার হইলে আজকেই ওর সাথে বিয়ার কথা ফাইনাল কইরা আবুলরে নোটিশ দেয়ার ব্যবস্থা করবো। লিণ্ডার কাছে এই ঢাকাশহর অসহ্য লাগা শুরু হইছে। সে আনিসের হাত ধইরা চইলা যাবে দিনাজপুরের সুঁইহাড়ী গ্রামে।  সেখানেই স্বপ্নের সংসার পাতবো লিণ্ডা। আনিসের গ্রামেরবাড়ির একটা পুকুরের চারপাশে খালি হিজল গাছ। এমন একটা পুকুরের স্বপ্ন সে ছোটবেলা থিকাই দেখে। লিণ্ডার শুধু খারাপ লাগে সবুজের জন্যে। সবুজরে না দেখলে, মনের কথা না বললে ওর পেটের ভাত হজম হয় না। আর খালাম্মা তো খালাম্মাই। খালাম্মা চাইতো, এমনকি এখনও চায়... লিণ্ডা এই বাড়ির বউ হইয়া আসে। লিণ্ডার দাম্পত্য বিষয়ে সব জানে এই বাড়ির মানুষ।

কীরে কখন আইছোছ?
আধাঘণ্টা। আনিস এখনও ঘুমায়?
হ। যা গিয়া ঘুম থিকা তোল। ওরে নিয়া বিদায় হ। এইটা ভদ্রবাড়ি। মা, ভাই-ভাবি নিয়া থাকি। দুইদিন পরপর নতুন নতুন বয়ফ্রেন্ড নিয়া আসবি... এইটা কেমন কথা!
এই নিয়া তিনজনের সাথে ডেটিং। তুই এখানে না আসতে বললে তো বাইরে কফিশপেই বসতাম।
কফিশপে তো এমন বহাল তবিয়তে ইয়া করতে পারতা না।
মানে?
আমার ঘরে আয় তুই। সি. সি. ক্যমেরা দেখাই তোরে।
লিণ্ডা সবুজের গলা খাঁমচায়ে ধরে। টাইনা ঘরে নিয়া যায়। পাগলের মতো সব তছনছ করতে থাকে। সবুজ লিণ্ডার বুক বরারাবর পিস্তল ঠেকায়। বলে, লিণ্ডা, এই পিস্তলে সাইল্যান্সার লাগানি আছে। জিরো রেঞ্জে তোর বুকের লাল তিল বরাবর একটা গুল্লি করলে কেউ শুনবো না।
সবুজ, আনিস কই? ওরে কি করছস্ তুই?
তোর বাকি প্রেমিকগুলির মতোই উধাও কইরা দিছি। সুমনের ভিডিও দেইখা তুহিন পলাইছে। আর আনিসও একইভাবে। তুই ছাগল, তোর প্রেমিকরাও।
কিন্তু আমি তো কারো সাথেই আপত্তিকর কোনো কিছুই করি নাই। দেখি তোর ভিডিও ফুটেজ।
আরে, ভিডিও সব এডিট করাইছি মণিরে দিয়া, আমার সিনেমাঅলা সেই বন্ধু।
লিণ্ডা সবুজের উপরে বাঘিনীর মতো আছড়ায়া পড়ে। গোঙাইতে থাকে... তুই এত খারাপ! তুই ক্যান করতে গেলি এইসব... ক্যান!
তুই বুঝস না? লিণ্ডা তুই এখনও বুঝস না!
না বুঝি না! তুই আমারে ভালোবাসস্?
না কুত্তি, তোরে আমি ঘিন্না করি। এই পিস্তলের সব গুলি তোর খুলিতে ভরুম।
লিণ্ডা আহত বাঘিনীর মতো সবুজের উপর চইড়া বসে। সবুজ কিছু বোঝার আগেই লিপলক্। সবুজের চোখ গড়ায়া পানির বিন্দু... সারা শরীর কাঁপতেছে। ঠোঁটে অস্ফুট চাপা শব্দ... ভালোবাসি! ভালোবাসি!