অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম

অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম

তৃষ্ণাকুমারী

উপন্যাস (পর্ব ৫)

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৯, ২০১৭

কয়েকদিন ধরেই মেঘে মেঘে আকাশ থমথমে। এই ছায়া ছায়া দিনের নরম রঙ, আবার হঠাৎ করেই দেখা যায় ঝমঝম বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেছে। এই রকমই তো প্রকৃতির লুকোচুরি খেলা। যে খেলা রানির মনেও কখনও কখনও নানা রঙ ছড়ায়। কখনও তন্ময় হয়ে কী যেন ভাবেন তিনি একা একা বসে। আনন্দের রঙ খেলে যায় তার চোখমুখে। কখনও বিমর্ষতার কালো ছায়া।
এইমাত্র বৃষ্টি থেমেছে। দুপুর বলে চেনাই যায় না বাইরের চেহারা দেখে। ছাইরঙা আলো কী রকম যেন নিথর হয়ে রয়েছে প্রকৃতির বুকে। নির্জীব আর মনমরা সবকিছু। প্রাণ নিয়ে কেবল দাঁড়িয়ে আছে গাছপালা। বৃষ্টির পর সবুজের অহংকার ছড়াচ্ছে। ভেজা ভেজা হাওয়া শরীরে শিরশির কাঁপুনি তুলে যাচ্ছে। পাতলা একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে রানি বসে আছেন টানা বারান্দায়।
বাগানের পাখিরা খুব ডাকাডাকি করছে। প্রকৃতির স্তব্ধতা যেন জাগিয়ে তুলছে তারা। বসে বসে রানি শুনছিলেন পাখির হইচই, আর ঝিরঝির আনন্দ টের পাচ্ছিলেন বুকের ভেতর। পায়ের শব্দ শুনে মুখ ফিরিয়ে দেখলেন, রাজামশাই। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে মুচকি হাসলেন রানি। বললেন, সভা থেকে আজকাল তাড়াতাড়ি ফিরছেন মনে হচ্ছে।
রাজাও হাসলেন রানির পাশে বসতে বসতে। বললেন, সভার কাজকর্মের চেয়ে আমার রানির সঙ্গে থাকতেই বেশি আনন্দ পাচ্ছি আজকাল। কিন্তু তোমাকে যেন কেমন মন খারাপ দেখাচ্ছে রানি। কী হয়েছে বলো তো।
রানি হাসবার চেষ্টা করলেন। বললেন, কিছুই হয়নি। আপনি শুধু শুধু উদ্বিগ্ন হবেন না।
রাজার তবু প্রশ্ন, শরীর খারাপ লাগছে?
মাথা নেড়ে রানি জবাব দিলেন, না তো। আমার কিছুই হয়নি।
রাজা বললেন, এই সময়টা অবশ্যি শরীর খারাপ লাগতেই পারে। আরেক শরীর বেড়ে উঠছে যে তোমার শরীরের মধ্যে।
রানি কথা বললেন না। চুপচাপ হাসলেন কেবল।
রাজা বললেন, ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। এ সময়ে বাইরে এভাবে বসে থাকা কি ঠিক হচ্ছে রানি?
রানি বলল, ভালো লাগছে যে। দেখুন কী শান্ত প্রকৃতি। আর এরই মধ্যে পাখিরা আনন্দে মেতে উঠেছে। কত যে পাখি আমাদের বাগানে, আমি তাই বসে বসে দেখি। ভারি ভালো লাগে আমার এসব দেখতে।
রানির মুখের দিকে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রাজা। এরপর বললেন, আমারও ভালো লাগে রানি। ফুল পাখি গাছ মানুষ সবকিছু আমার ভালো লাগে। তবে এই ভালো লাগার মধ্যেও কোথায় যেন ভয়ের একটা কালো ছায়া দেখতে পাই আমি। বারবার মনে হয় অশুভ এক আশঙ্কার কথা।
রানি কোনও কথা না বলে মাথা নত করে বসে থাকেন। কেন এই আশঙ্কা রাজার তিনি সেটা জানেন। আর জানেন, কাজটা তিনি মোটেও ভালো করছেন না। কিন্তু কী রকম এক আকর্ষণ যেন ফুলটার প্রতি তার তৈরি হয়ে গেছে। কিছুতেই ত্যাগ করতে পারছেন না গর্ভকুসুমের মোহ।
প্রকৃতির নির্জীব আলোর দিকে চেয়ে রাজা বললেন, তুমি এমন কেন করছ রানি, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে বুঝতে পারছি, যে জিনিস তুমি... কথা শেষ করলেন না তিনি, গাছাপালার দিকে উদাস দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইলেন। হঠাৎ যেন নীরবতা ঘিরে ফেলল তাদের। পাখিদের কিচিরমিচির কেবল ছিঁড়ে দিয়ে যাচ্ছে নীরবতার জাল। রানির মুখ মেঘ মেঘ আকাশের মতোই থমথমে। রাজার কপালে চিন্তার ভাঁজ।
কিছু সময় পর নীরবতা ভাঙলেন রাজা। রানির একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে বললেন, দৈবের ওপর কারও হাত নেই রানি। স্বপ্নে সন্যাসী আমাকে বলেছিলেন গর্ভকুসুম ফেলে দিতে। কিন্তু তুমি সেটা যত্ন করে তুলে রেখেছো পাথরের কৌটোয়। সন্যাসীর কথা অমান্য করে যদি অনিষ্ট ঘটে যায় কিছু, তখন কী হবে রানি? উদ্বেগে কেঁপে উঠল রাজার স্বর। দৃষ্টি ফেরালেন তিনি রানির মুখের দিকে।
রানি চেয়ে আছেন রাজার মুখের দিকে। কাঁপা কাঁপা দৃষ্টি। কিছু সময় এভাবে কাটল। কথা ফুটল না রানির ঠোঁটে। থত্থর কাঁপতে থাকে তার পাতলা দুটো ঠোঁট। দৃষ্টি নামিয়ে একসময় তিনি বললেন, এই গর্ভকুসুম পৃথিবীর আর কোথাও নেই। ফেলে দিলে আর কী পাওয়া যাবে দুর্লভ এই ফুল? একবার ভেবে দেখুন রাজা, যা পৃথিবীর কারও কাছে নেই, তা আমাদের আছে।
রাজা বললেন, এসব তুমি আগেও বলেছ রানি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, অদৃশ্য জগতে এমন কিছু আছে, যা দৃশ্য জগতে থাকতে নেই। ঠাকুরের আশির্বাদে এসবের দু’একটা কেউ কেউ পায়, কিন্তু দরকার ফুরোলে বিসর্জন দিতে হয়। দুর্গা মাকে কি প্রতি বছর আমরা বিসর্জন দেই না? কেউ তাকে তুলে রাখে নিজের ঘরে?
রানির মুখে কথা নেই। রাজার কথা শুনে ভয়ের শিরশির স্রোত বইছে তার ভেতর। হাতের আঙুল অন্যমনস্কভাবে ঘুরছে রাজার হাতের ওপর। একটু একটু কাঁপছে সেই আঙুল। কাঁপছে রানির চোখের পাতা। কী যেন অব্যক্ত এক কথা তার বুকের ভেতর ঢেউ তুলে যাচ্ছে। ভাষা পাচ্ছে না কিছুতেই।
রাজা ডাকলেন, রানি।
গভীর তন্ময়তার মধ্যে থেকে জেগে ওঠে রানির স্বর, উঁ।
আমাকে দিয়ে দাও গর্ভকুসুমের কৌটো। আজই আমি বিসর্জনের ব্যবস্থা করি।
ফ্যাকাসে হয়ে যায় রানির মুখ। চোখ না তুলেই বাষ্পরুদ্ধ স্বরে তিনি বললেন, থাক না আমার কাছে। মনে মনে ঠাকুরকে আমি বলেছি, দেখবেন, ঠাকুর আমাদের কোনও অনিষ্ট করবেন না।
রাজা বললেন, কিন্তু সন্যাসীর নির্দেশ ছিল ফেলে দেবার।
রানির স্বরে অনুযোগ, আমরা তো আর কাউকে বলছি না এই গর্ভকুসুমের কথা।
রাজার স্বরে কঠোরতা, এই মনোভাব ধিকৃত রানি। প্রবঞ্চককে ঠাকুর কখনও ক্ষমা করেন না। একটি সন্তানের জন্যে আমাদের যে তৃষ্ণা ছিল, ঠাকুরের অনুগ্রহে তা পূরণ হতে চলেছে। আমাদের আর তো কোনও তৃষ্ণা থাকার কথা নয়।
রানির বুকের ভেতর গর্ভকুসুমের ঝিরঝির সৌরভ। ঝিরঝির মৌতাত ছড়াচ্ছে রানির অনুভূতির গভীরে। অদ্ভুত এক আচ্ছন্নতায় তলিয়ে যেতে যেতে চকিত মুহূর্তের মতো রানির চোখের সামনে ভেসে উঠল অন্ধকার এক কুঠুরি। অন্ধকারে তিনি দেখতে পেলেন নিজেকে। আর গন্ধ পেলেন আশ্চর্য এক ফুলের। স্পর্শ পেলেন ভেজা পাপড়ির। রোমাঞ্চকর এক ঢেউ তিরতির বয়ে গেল তার শরীরে। কেঁপে উঠলেন তিনি। এই তো গর্ভকুসুম। আচ্ছন্নতা ভেঙে জেগে উঠলেন রানি। না, কিছুতেই তিনি হারাবেন না এই ফুল।      
শিরশির হাওয়া ছুটে এলো এক ঝলক। আর তার পরপরই ঝমঝম বৃষ্টি। থেমে গেল পাখির কিচিরমিচির। হুটহাট কোথায় যে তারা লুকিয়ে পড়ল, কে জানে।
ধীর গলায় রাজা বললেন, অন্দরে চলো রানি। এভাবে আর বসে থেকো না। ঠাণ্ডা লেগে শেষে আবার শরীর খারাপ করবে।
রাজা উঠলেন। চাদরটা গায়ে ঠিকঠাক জড়িয়ে রানিও উঠলেন। রাজার থমথমে মুখের দিকে চেয়ে বললেন, আমায় মার্জনা করবেন রাজা। সব জেনে সব বুঝেও বলছি, গর্ভকুসুম থাকুক আমার কাছে। আপনি অনুমতি দিন।
কিছু সময় রানির মুখের দিকে চেয়ে রইলেন রাজা। এরপর তার একটা হাত ধরে বললেন, কেন তুমি এমন করছ রানি, আমি বুঝতে পারছি না। তবে এত করেই বলছ যখন, তবে থাক। ঠাকুরের ইচ্ছাও হয়তো এরকম। কে জানে, কী আছে ঠাকুরের মনে। নতুন করে হয়তো কোনও পরীক্ষা শুরু হলো আমাদের জীবনে।
বিকেলবেলাতেই সন্ধের ছাইরঙা অন্ধকার নেমে এলো। বৃষ্টির আর বিরাম নেই। একটানা ঝমঝম ঝমঝম শব্দ প্রকৃতির বুকে। শীতের হাওয়াও ছুটতে লাগল ঝিরঝির দোলা দিয়ে। রাজা ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম এলো না রানির। পশমি কম্বলের নিচে শুয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন ভবিষ্যতের নানা কথা। অনাগত সন্তানের কথা। গর্ভকুসুম ঘিরে রাজার যে শঙ্কা, তাও ভাবনায় উঁকি দিল রানির। আর কেঁপে উঠলেন তিনি। রাজার শঙ্কা খুব যে অমূলক, তা তো নয়। আর গর্ভকুসুম, সেও যে দুর্লভ!
নানা ভাবনার মধ্যে একসময় রানি ঘুমিয়ে পড়লেন। বাইরে ঝরঝর একটানা বৃষ্টিপতনের শব্দ। আর যা, সবই নিঃসাড়। অদ্ভুত এক নৈঃশব্দ্য পৃথিবী ঘিরে। এই নৈঃশব্দ্যও একসময় শব্দে শব্দে মুখর হয়ে ওঠে। মুখরতা ছড়ায় মানুষের সংসারে। প্রকৃতিও মুখর হয়ে ওঠে। সূর্যদেব ওঠেন। আবার ডুবেও যান। তখন আবার নৈঃশব্দ্য। শব্দ আর নৈঃশব্দ্যের এই আবর্তনে শীত নেমে এলো প্রকৃতিরাজ্যে। রানির শরীরে দেখা গেল গর্ভবতীর লক্ষণ। ক্রমে ক্রমে স্ফিত হয়ে ওঠে তলপেট। রাজবৈদ্য আসেন। শুশ্রুষা চলতে থাকে রানির। সকাল-বিকেল দু’বেলা প্রাসাদের ছাদে রানিকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটেন রাজা। রানিকে দেখলেই বাকবাকুম ডাক ছেড়ে হুটোপুটি আরম্ভ করে দেয় কবুতরগুলো। কাণ্ড দেখে রাজা হাসেন। হাসেন রানিও। বিমলাকে ডেকে খোঁজখবর করেন, ঠিকমতো দেখাশুনো হচ্ছে কীনা প্রাণীগুলোর। নতুন বাচ্চা কটা দিয়েছে, মারা গেছে কয়টা। বিমলাও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব খবর জানায়।
সভা থেকে আগেভাগে ফিরে আসেন রাজা। রানিকে সঙ্গ দ্যান। ফুলবাগানে ঘুরতে যান। বাগানের সবচে বড় গোলাপটা পরিয়ে দ্যান রানির খোঁপায়। প্রশংসা ঝরে পড়ে তার মুখে। বাহ রানি, তোমাকে যা দেখাচ্ছে না, কী বলব!
রানি বলে ওঠেন, সে আপনি ভালোবাসার চোখে দ্যাখেন, তাই।
কপট রাগের ভঙ্গিতে রাজা বলেন, তাই মানে কি? জানো রানি, আমার মন বলছে তোমার গর্ভের সন্তানও তোমার মতো ফুটফুটে হবে দেখতে।
রানির মুখে সলজ্জ হাসি, ধূর ছাই! আমি আবার সুন্দর হলাম কবে? আমাদের নতুন অতিথি হবে আপনার মতো। সুপুরুষ। রূপবান।
হা হা হা। রাজা হেসে ওঠেন। জিগেশ করেন, তুমি কিভাবে জানলে রানি আমাদের পুত্র হবে?
রানি জবাব দিলেন, আমার মনে হয়েছে, তাই বলেছি। কেন, হবে না পুত্র?
রাজা বললেন, তা আমি কীভাবে বলব? পুত্রই হোক আর কন্যাই হোক, দুটোতেই আমরা খুশি, নাকি রানি?
রানির মুখে হাসি। জবাব দিলেন না তিনি।
চলবে...