অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

তৃষ্ণাকুমারী

উপন্যাস (পর্ব ৬)

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২০, ২০১৭

দিন যায়। মাস যায়। নানা রঙের ফুলে রাজপ্রাসাদের বাগান ওঠে ভরে। গাছে গাছে সবুজ পাতা ঝিরঝির হাওয়ায় ঢেউ তুলে যায়। কচি কচি সবুজ কিশলয়ে প্রকৃতি হেসে ওঠে। হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় নানা ফুলের গন্ধ। প্রজাপতি ওড়ে ফুলে ফুলে। লাল নীল শাদা বেগুনি নানা রঙে রাঙানো প্রজাপতির ডানা। ভোমরের গান শোনা যায় ফুলের বাগানে। রোদ ওঠে সোনার মতো চকচকে। আবার সিঁদুররঙা আলো পৃথিবীর মাঠে ছড়িয়ে দিয়ে ডুবেও যায়।
একদিন ভোর। পাখিরা নীড় ছেড়ে সবেমাত্র ওড়াউড়ি আরম্ভ করেছে। তাদের কিচিরমিচিরে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে গাছপালা। ঝিরঝির স্নিগ্ধ হাওয়া বইছে। চকচকে নরম রোদ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিক। বাইরে যখন আনন্দের এই আয়োজন প্রাসাদের অন্দরমহলে তখন উৎকণ্ঠা। রাজা পায়চারি করছেন। পেছনে পেছনে উজির। পায়চারি করতে করতে রাজা চকিতে চোখ তুলে দেখে নিচ্ছেন দাসীদের ত্রস্ততা। আর বারবার ব্যগ্র চোখে তাকাচ্ছেন খাসমহলের দরজায়। কখন খুলবে এই দরজা, কে জানে।
সময় আর যেন ফুরোতে চায় না। রাজা পায়চারি করেন। উজির তার সঙ্গে সঙ্গে। হঠাৎ থমকে যান রাজা। স্তব্ধ হয়ে যান মুহূর্তের জন্যে। কেঁদে ওঠে একটি শিশু। স্তব্ধতা ভেঙে রাজার বুকের ভেতর ধকধক শব্দ ওঠে। ঝলমল আনন্দে হাসতে হাসতে দৌড়ে আসে বিমলা।
সুসংবাদ রাজামশাই, রানিমা একটি কন্যাসন্তান প্রসব করেছেন।
আনন্দে আর উত্তেজনায় চোখে পানি এসে যাচ্ছে রাজার। চোখের পানি আড়াল করে তিনি তার আঙুল থেকে হিরাখোচিত বহু মূল্যের আঙটি খুলে বিমলাকে উপহার দিলেন। বিমলা কুর্ণিশ করে চলে গেল। রাজা ডাকলেন, মন্ত্রীমশাই?
মন্ত্রী এগিয়ে এলেন, বলুন রাজামশাই।
মন্ত্রীর কাঁধে একটি হাত রাখলেন রাজা। আনন্দে তার কণ্ঠস্বর ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। কাঁপতে কাঁপতে তবু বললেন, মহোৎসব করুন মন্ত্রী। খুলে দিন রাজকোষ। যার যা ইচ্ছে নিয়ে যাক। আজ আনন্দ আমার রাজ্যে। যান যান, আর দাঁড়িয়ে থাকবেন না।
মন্ত্রী চলে গেলেন। রাজা গেলেন রাজকন্যার মুখ দর্শন করতে।
রাজ্যজুড়ে শুরু হয়ে গেল উৎসব আর উল্লাস। রাজপ্রাসাদ থেকে লোকজন ফিরছে নাচতে নাচতে। সকলেই পেয়েছে রাজকোষ থেকে উপঢৌকন। কৃষক আর সেদিন লাঙল নিয়ে মাঠে গেল না। মাঝি গেল না খেয়া নৌকো বাইতে। জেলে গেল না জাল ফেলতে নদীতে। হাটুরে গেল না আর হাটে। দোকানি খুলল না তার দোকান। আর খুলবেই বা কেন? এত বড় উৎসব কী আর এসেছে এ রাজ্যে কখনও? সকলেই উৎসব আনন্দে দিনটি কাটিয়ে দিল। যারা এতদিন আড়ালে রাজাকে আঁটকুড়া বলে নিন্দে করত, তারাও এসে যোগ দিল উৎসবে, জনতার ভিড়ে। তাদের জীবনে এত বড় উৎসব তো আর তারা দেখেনি।
ঝিলমিল আনন্দে রাত্রি যেন হেসে উঠল রাজপ্রাসাদে। এক লাখ প্রদীপ জ্বলল প্রাসাদের নানা স্থানে। কয়েকশো আতশবাজি পোড়ানো হলো প্রাসাদের সম্মুখে। হঠাৎ আলোর ঝলকানি রাত্রির অন্ধকার চিরে উঠে গেল ওপরে। রাজ্যের মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখল প্রাসাদের এই জ্বলজ্বলে আলো। যারা দূর থেকে দেখল তাদের মনে হলো, আজকের রাতের জন্যে যেন আকাশের সব তারা নেমে এসেছে তাদের রাজার প্রাসাদে।
জয় জয় ধ্বনি কেবল চারদিকে।
মুখরতা। আনন্দের ঢেউ। মানুষের ঢেউ। আর নানা রঙের আগুনের হঠাৎ ঝলকানি প্রাসাদ ঘিরে। বাইরের এই আনন্দের ঢেউ হাওয়ায় ভেসে ভেসে চলে এলো অন্দরমহলে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে শুয়ে আছেন রানি। বুকের কাছে নবজাতক। দুধ খাচ্ছে। রাজা বসে আছেন শিয়রে। কথা বলছেন।
আচ্ছা রানি বলো তো, কী পেলে তুমি সবচেয়ে বেশি খুশি হবে। আমি ঠিক ভেবে পাচ্ছি না।
ক্লান্ত মুখে একটু যেন হাসলেন রানি। তারপর বললেন, ঠিকাছে ভেবে বলছি।
রাজাও হাসলেন, আচ্ছা বলো।
একটু ভেবে রানি বললেন, ভেবে তো কিছুই পেলাম না। আচ্ছা, আপনিই বলে দেন না।
আহা, আমি কীভাবে বলব কী পেলে তুমি সবচেয়ে খুশি।
এত বছর একসঙ্গে কাটালাম আমরা। এরপরও জানলেন না, কী পেলে আমি খুশি?
রাজা নির্বাক।
রানি বললেন, আপনাকে। এই যে আমার বুকের ভেতর সপ্তরাজার যে মানিক, তাকে। কথা বলতে বলতে রানির ক্লান্ত দুই চোখে জল গড়িয়ে নামে। চোখ বন্ধ করে ফেললেন রানি।
আর রাজা বসে আছেন গভীর আনন্দে আচ্ছন্ন হয়ে। রাজ্যে আজ আনন্দের ডামাডোল। প্রজারা আজ খুশি। এতদিনের নিন্দুকের মুখেও আজ তার জয় জয়...। এই দিনটি, আহা কী কপাল তার, এসেছে তার জীবনে। ঠাকুরের কৃপার পরশে এতদিনে শুষ্ক মরুদ্যানে চারাগাছ গজালো। এখন দরকার কেবল পরিচর্যা। আর দরকার সুন্দর দেখে একটা নাম, রাজকন্যার জন্যে। কিন্তু কী নাম রাখা যায়? রাজা ডাকলেন, রানি?
চোখের পাতা বুজেই রানি জবাব দিলেন, উুঁ?
আচ্ছা বলো তো, রাজকন্যার কী নাম রাখা যায়? কি নাম তোমার পছন্দ?
চোখ খুললেন রানি। রাজার মুখের দিকে চেয়ে, ক্লান্ত মুখেও হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে বললেন, বাহ রে, আমাকেই কেন নাম রাখতে হবে? আপনিই রাখুন না।
সে নাম যদি আমার রানির মনে না ধরে? তাই তার পছন্দ জানতে চাইছিলাম। হেপি টেপি যা হোক কিছু একটা নাম তো আর রেখে দেয়া যায় না। বলেই রাজা মুচকি হাসলেন। আর রানি কপট অভিমানে মুখ ভেংচি দিলেন।  রাজকন্যার মুখের দিকে একটু সময় চেয়ে থেকে রাজা বললেন, অনেক তৃষ্ণার পর এই শিশুকে আমরা পেয়েছি রানি। আর তাই এই কন্যার নাম রাখলাম, তৃষ্ণা।
বাহ, সুন্দর তো নাম। একেবারে আমার মনের কথাটিই আপনি বলে দিলেন।
রাজা জিগেশ করলেন, তার মানে তৃষ্ণা নামটি তোমার পছন্দ হয়েছে?
হ্যাঁ, খুবই পছন্দ হয়েছে। বলেই, মাথাটা একটু কাত করে রানি রাজকন্যার ঘুমন্ত কপালে চুমু খেলেন। এরপর বললেন, আজ থেকে রাজকন্যার নাম তৃষ্ণা কুমারী।
উঠে এলেন রাজা। রানির কপালে চুমু খেয়ে বললেন, আমি ধন্য রানি, আমি পূর্ণ। আজ আমার ভেতর কোনও ভার নেই। দুঃসময়ের কালো মেঘ কেটে গিয়ে এখন হাসছে উজ্জ্বল ভোর। আমাদের নতুন জীবনের যাত্রা শুরু হলো।
পরম মমতায় রানি চেয়ে আছেন রাজার মুখের দিকে। তার একটা হাত রাজার হাতে ধরা। শিথানে দাঁড়িয়ে আছেন রাজা। রাজার এই মুখ নতুন যেন। রাজাকে এত প্রাণবন্ত এর আগে কখনও তিনি দ্যাখেননি।  বাইরে তখনও উল্লাসধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
রাজা বললেন, তুমি ঘুমিয়ে পরো রানি। আমি একটু ঠাকুরঘরে যাচ্ছি। আজ আমার এই পূর্ণতার আনন্দ তো তারই দান। তিনিই তো কাঙালের ঝোলা পূর্ণ করে দ্যান।
রানির হাত ছেড়ে রাজা নেমে গেলেন নিচে।
চলবে...