অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরিন

অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরিন

তৃষ্ণাকুমারী

পর্ব ৭

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৫, ২০১৮

রাজবাড়িতে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে থাকে তৃষ্ণাকুমারী। দারুণ ফুটফুটে হয়েছে সে দেখতে। যে-ই দ্যাখে, একটিবার কোলে নিতে চায়। যেন চাঁদের একটি টুকরো। কোনও দৈব ঘটনায় চাঁদ থেকে খসে পড়ে পৃথিবীতে এসে পড়েছে। সারাক্ষণ তাকে চোখে চোখে রাখেন রানি। কেননা, তৃষ্ণার স্বভাব হলো দুরন্ত। খালি ছটফট করে। ফুল বাগানের ফুল ছিঁড়ে ফেলে। বিমলার নিষেধ শোনে না। খিলখিল হেসে বিমলার চুলে টান দিয়ে দৌড়ে পালায়। পূজোর ফুল ছড়িয়ে দ্যায়। গোয়ালিনী দুধ দিতে এলে দুধের বাটি উলটে ফেলে। আর এইসব নিত্যকার ঘটনা নিয়ে রানির কাছ থেকে বিমলাকে শুনতে হয় বকাঝকা। বিমলা আর কতদিকে সামলাতে পারে। সে হলো রাজবাড়ির বহু পুরনো দাসি। রাজা-রানির আস্থা তাই তার ওপর সবার থেকে বেশি। আর তাছাড়া, বয়স হচ্ছে বিমলারও। আগের চেয়ে একটু মুটিয়েও গেছে সে। সময় কী কারও জন্যে থেমে ছিল কখনও?
দিন যেন সময়ের ঝরাপতা। সময়ের ডালপালা থেকে ঝরে পড়ছে তো, পড়ছেই। আর রাত যেন সময়ের ফুল। মহাবিশ্বের নিঝ্ঝুম নীরবতা নিয়ে মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে দ্যায়।
সময়ের এই চক্রে পেরিয়ে যায় অনেক অনেক দিন।
এরপর নিথর রাত। ঝুম নীরবতায় রাজ্যের ঘরে ঘরে শোনা যায় ক্লান্ত মানুষগুলোর ঘুমন্ত নিশ্বাসের শব্দ। কোনও কোনও ঘরে শিশুর কেঁদে ওঠা।  রাতপোকাদের শব্দ। আর দূরে, জঙ্গলের দিক থেকে ভেসে আসে শিয়াল আর হিংস্র জন্তুদের ডাকচিৎকার। এ ডাক ঘুমন্ত মানুষগুলোর ঘুমন্ত মনে ভয়ের শিরশিরানি তুললেও, তারা ঘুমিয়েই থাকে, প্রতিদিন যেভাবে ঘুমোয়।  
আধখানা চাঁদ ঝুলছে আকাশের গায়ে। শাদা আর ছাইরঙা মেঘের ভেলায় যেন দুলছে। কখনও ঝকঝকে, কখনও ম্লান নরম আলো পৃথিবীকে ধুয়ে দিচ্ছে। নিঝ্ঝুম রাত ঝিমোতে থাকে খাগড়া মুল্লুকের ঘুমন্ত বাসিন্দাদের নিয়ে। রাজবাড়ির সামনের ফটকে দুই দুই চারজন প্রহরী হাতের বল্লমে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমিয়ে নিচ্ছে। ঝিমন্ত প্রহরীদের সামনে দুটো কুকুর পেছনে পেছন লাগিয়ে আটকে আছে। একটা আবার সামনের দুটো পা দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। সুনসান চারদিক। কুকুর দুটোও শব্দ করছে না। মেঘের লুকোচুরি খেলায় আজ যেন তাদের উৎসাহ নেই। রাজবাড়ির বাগানের ওদিক থেকে হঠাৎ হঠাৎ ডেকে যাচ্ছে রাতজাগা কোনও পাখি। আর ফিনফিন হাওয়া দিচ্ছে।
গভীর রাত। রাজবাড়ির সামনের মাঠের অন্ধকার ফুঁড়ে যেন উদয় হলেন সন্যাসী। জটাধারী। নিম্নাঙ্গে গেরুয়া বসন, উর্ধ্বাঙ্গ খালি। বা হাতে তামা-রুপোর মোটা মোটা বালা। ডান হাতে কী এক গাছের প্যাঁচানো একখানা ডাল। এই হচ্ছে তার লাঠি। লাঠির সঙ্গে বাঁধা একটি নরশিশুর ছোট্ট করোটি। সন্যাসীর গলায় বড় বড় রুদ্রাক্ষের মালা। চোখ শীতল। মুখভঙ্গি শান্ত, সৌম্য। বড় বড় দাড়ি- গোফ। ধীর পায়ে তিনি এসে দাঁড়ালেন রাজবাড়ির সামনে। চাঁদের বিপরীতে তার ছায়া দীর্ঘ হয়ে রাজবাড়ির ওপর আছড়ে পড়ল। তার আগমন প্রথমে কুকুর দুটো দ্যাখে। আর যখন দ্যাখে, কুঁইকুঁই করতে থাকে তারা। এরপর ছায়ার মানুষটি যখন আরও এগিয়ে এলো, একে অন্যের কাছ থেকে ছুটে গিয়ে কুকুর দুটো ভয়াল স্বরে ডাকতে ডাকতে দুদিকে ছুট লাগালো। ধরফর করে গাঝাড়া দিয়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়ল চার প্রহরী। যেন তারা দেখল মাত্র, একজন মানুষ আর তার দীর্ঘ ছাইরঙা ছায়া। তবে মানুষটার বেশভূষা বিচিত্র। এরপর নেই। একদম হাওয়া।
চার প্রহরী আশপাশ একটু ঘুরে এসে পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। কিন্তু কেউ কিছুই বলতে পারল না। বাকি রাত বেশ সাবধানে তক্কেতক্কে কাটালো তারা। একটু পরপর দুজন আশপাশটা একটু ঘুরে দেখে আসছে। রাজবাড়িতে আজ উৎসব। রাজকন্যা তৃষ্ণাকুমারীর আজ সাত বছর পূর্ণ হবে। ভোর থেকেই রাজফটকে জুটতে শুরু করবে প্রজার দল। সরগরম হয়ে উঠবে রাজবাড়ি। উৎসবে হুল্লোরে মাতবেন রাজা-রানিসহ প্রজারা। এ-ই হচ্ছে এ রাজ্যের প্রতি বছরের নিয়ম। একটু সেজেগুজে আসে তারা। তাদেরকে ভোজন করানো হয়। ভোজন শেষে প্রজারা দেখতে আসে রাজকুমারী তৃষ্ণাকে। তৃষ্ণাকুমারী তখন নানা দ্যুতি ছড়ানো অলঙ্কারে সজ্জিত হয়ে বসে আছে রাজকীয় হাতির পিঠে। এ হাতির পিঠে বসেই রাজপরিবারের সদস্যরা প্রজাসাধারণের সামনে উপস্থিত হন। এ উপলক্ষ্যে হাতিকে সাজানো হয় জৌলুশপূর্ণ সাজে। প্রজারা তাক লেগে দ্যাখে এই রাজকীয় সজ্জা। হাতিকে ঘিরে প্রজাদের জয় জয় ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে আকাশে-বাতাসে।  
এ রকমই যখন প্রতিবছর হয়ে আসছে, হঠাৎ এ বছরই বা এ রকম অশুভ ইঙ্গিত কেন দ্যাখা দেবে, তা মাথায় ঢুকল না চার প্রহরীর। কীভাবে রাজার কানে এই অমঙ্গল সংবাদ দেয়া যায়, তাও তারা ভেবে বের করতে পারল না। আর বিষয়টা যে অমঙ্গল, তা-ই বা নিশ্চিত তারা কীভাবে?
সুতরাং কাউকে কিছু না জানিয়ে খুব সতর্কতার সাথে তারা রাত পার করল। ভোর হচ্ছে। পাতার আড়ার ছেড়ে পাখিরা বেরিয়ে পড়ে। শুরু হলো ঝলমলে আরও একটি দিন। নতুন চারজন প্রহরী এলো। রাতজাগা প্রহরীরা ফিরে গেল যার যার ঘরে। বেশ বেলা করে ঘুমোবে। এরপর উঠে রাজবাড়ির উৎসবে যোগ দেবে।
এক-দুজন করে প্রজার ভিড় বাড়তে থাকল। জেগে উঠলেন রাজা-রানি। আর নিজের ঘরে জেগে উঠল তৃষ্ণাকুমারী। তার সাথে ঘুমোয় বিমলা। বিমলা আগেই উঠে গেছে। রাজবাড়িতে দাসদাসিদের হাঁকডাক শুরু হয়ে গেছে। ঘুম ভাঙতেই তৃষ্ণা উঠে বসল বিছানায়। টলটলে মুখে সদ্য ঘুমভাঙা স্নিগ্ধতা। ঠিক আজকের রবির মতো। যার কিরণচ্ছটায় ঝলমল রঙে হেসে উঠছে প্রকৃতি। বাগান থেকে নানা জাতের ফুলের ভুরভুর ঘ্রাণ বাতাস বয়ে এনে ঘরটা যেন ভরিয়ে দিয়েছে।
তৃষ্ণার বিছানার কাছেই মোটা মোটা গরাদ দেয়া জানালা। জানালা দিয়ে প্রধান ফটকটা দেখা যায়। পটলচেরা টানা টানা চোখ মেলে সে দেখতে পেল, ফটকের সামনে প্রজাদের ছোট-ছোট জটলা। নারী-শিশু কেউই বাদ নেই। তৃষ্ণার মুখেও ছড়িয়ে পড়ল সে খুশির ঢেউ। তাই তো, আজ যে তার জন্মদিন!
আনন্দে দুলে উঠল রাজকুমারী। আজ যে সে হাতির পিঠে চাপবে! আর  সাজবে চোখ ঝলসানো বহুমূল্য অলঙ্কারে। এ রাজ্যে আজ উৎসব। এসব যখন ভাবছে তৃষ্ণা, বিমলা এলো ঘরে। হাতে গোলাপের তোড়া। পরম মমতা তার এই রাজকুমারীকে ঘিরে। সারাক্ষণ তার সঙ্গেই তো আছে। এই কোলে-বুকে বেড়ে উঠেই তো রাজকুমারী আজ দশ বছরে পড়ল।
ঘরে ঢুকেই একগাল হেসে বিমলা বলল, এই যে রাজকুমারী পরির ছা, উঠে পড়েছেন দেখছি। শুভ জন্মদিন।
ফুল নিতে নিতে তৃষ্ণা জিগেশ করল, রানিমা কোথায় বিমলা?
রানিমা তো স্নানে গেছেন। আমায় বললেন, তুমি ঘুমোচ্ছো, উঠলে যেন তাকে খবরটা দেয়া হয়।
তৃষ্ণাকুমারী এবার বিমলার মাথার চুল টেনে ধরে আদেশ করল, বেশ তো, তবে রানিমাকে এবার খবর দাও। এরপর চুল ছেড়ে দিলে বিমলা দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, আজ্ঞে রাজকুমারী। এরপর বেরিয়ে গেল বিমলা। গরাদ দেয়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো তৃষ্ণা। ভোরের নরম আলোয় আকাশ ঝকঝক করছে। মানুষের মতো গাছপালারও বুঝি এখন স্নানের সময়। কী রকম আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে গাছপালা। পাতার আশ্রয় ছেড়ে প্রাণের আনন্দে ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে আকাশের শূন্যতায়।
একটু পরই নরম আর শীতল হাতের স্পর্শে ঘাড় ফেরালো তৃষ্ণা। রানিমা! ভেজা চুল এখনও ছড়িয়ে আছে পিঠের ওপর। দু-একটা ফোঁটা জলও পড়ছে। রানিমার স্বরে স্নেহের ঢেউ আছড়ে পড়ল, শুভ জন্মদিন রাজকুমারী।
তৃষ্ণাকুমারী জড়িয়ে ধরল রানিমার গলা। এরপর ঝুলে পড়ল। রানিমার কানে কানে বলল, হাতি কি সাজানো হয়ে গেছে রানিমা?
হ্যাঁরে হ্যাঁ, হচ্ছে। রাজবাড়ির চত্বরে আরেকটু পরেই হাতিকে নিয়ে আসা হবে। এবার চলো তো রাজকুমারী, স্নানে যেতে হবে। এরপর রাজসাজে সাজতে হবে। দিতে হবে সোনার টিকলি, গলায় সাতনরী হার, আর পায়ে... এসব বলতে বলতে রাজকুমারীকে বুকের ভেতর নিয়ে স্নানঘরে এলেন রানিমা। বিমলাকে বললেন, গায়ে জল ঢালতে। আর তিনি চন্দনের সাবান ঘঁষে ঘঁষে তৃষ্ণার গা ঢলে দিতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্নান শেষ করে রানি তাকে নিয়ে এলেন সাজঘরে। এই সাজঘরটা বেশ পুরনো। সারা বছরই তালাবন্ধ থাকে। কেবল বিশেষ কোনো রাজকীয় উৎসবের দিন এলে এটি খোলা হয়। রানি আর রাজকুমারীর সজ্জার জন্য। এ ঘরের দুটো আলমারি। দুটোই পাথর কুঁদে বানানো। নিখুঁত এ কারুকাজ ধুলোর আস্তরণে প্রায় সারা বছরই ঢাকা থাকে। বিশেষ দিনের আগের দিন কেবল ঘরটি ঝেড়েপুছে পরিষ্কার করা হয়। ছেটানো হয় ধূপচন্দন।
বিমলা এরই মধ্যে নিয়ে এসেছে রাজকুমারীর বিশেষ দিনের পোশাক। জামায় ছোট ছোট হিরের ফুল বসানো। দ্যুতি ঠিকরে পড়ছে। এছাড়া সোনার চুমকি ঝুলছে জামার নিচে। রানিমা পরম যত্নে তৃষ্ণাকে রাজকুমারীর পোশা পরিয়ে দিলেন। এরপর তাকে সাজাতে বসলেন অলঙ্কারের পারিপাট্যে। পাথরের আলমারি থেকে একে একে নামিয়ে আনলেন নানা আকৃতি আর রঙের পাথরের কৌটা। রাখলেন পশমি গালিচার ওপর। নদীর তীরে বেড়ে ওঠা সবুজ ঘাসের মতো সবুজ রঙ এই গালিচার। এটাও সারা বছর গুটিয়ে থাকে কক্ষের এককোণে। ঢেকে থাকে ধুলোয়। কোনও মানুষের স্পর্শ পায় না। পড়ে থাকে অবহেলায়।

চলবে...