অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরিন

অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরিন

তৃষ্ণাকুমারী

উপন্যাস পর্ব ৮

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২২, ২০১৮

সব কৌটায় নামালেন রানিমা, কেবল তিনকোণা একটি নীল পাথরের কৌটা তিনি নামালেন না। ওটা কখনোই নামানো হয় না। তৃষ্ণা দেখেছে, রানিমা ওই কৌটাটি কখনোই নামান না। কী আছে ওতে? ওই কৌটায়?
গালিচার ওপর বসে রানিমা যখন একে একে অলঙ্কারের কৌটাগুলো খুলছে, তৃষ্ণা তখন আলমারির দিকে আঙুল তুলে রানিকে বলল, ওই যে আরেকটা কৌটা রয়ে গেছে রানিমা, ওটাও নামাও।
মুখ তুলে চমকে উঠলেন রানিমা। এরপরই বললেন, না রাজকুমারী। ওই কৌটা আমাদের খোলা নিষেধ। ওটা রাজপরিবারের সম্পত্তি।
তৃষ্ণা জিগেশ করল, কী আছে কৌটায়?
একটু সময় কী যেন ভাবলেন রানি, এরপর বললেন, আমি তা জানি না। ওটা যে খোলা নিষেধ রাজকুমারী। এখন চুপ করো। বিমলা, তুই একটু রাজকুমারীর মাথাটা ঠিক করে ধর, আমি এই টিকলিটা ওকে পরিয়ে দেই... যা ছটফটানি মেয়ে...।
বিমলা এক একটি কৌটার মুখ খুলে ধরছে, আর রানিমা কৌটার ভেতর থেকে অলঙ্কার বের করে নিখুঁত হাতে পরিয়ে দিচ্ছেন তুষ্ণাকুমারীর সর্বাঙ্গে।
রানিমা বলছেন, দেখেছিস বিমলা, আমাদের রাজকুমারীকে যেন চাঁদের দেশের রাজকুমারীর মতো দেখাচ্ছে। এই যে, এই টিপটা যেন দূর আকাশে জ্বলতে থাকা মিটিমিটি তারা...   
বিমলাও শুনে যাচ্ছে। আর মাঝেসাঝে হু-হা দিয়ে যাচ্ছে। তৃষ্ণা চুপচাপ চেয়ে ছিল তার সামনে শ্বেতপাথরে বাঁধানো আয়নায়। দেখছিল নিজেকে। আর ভাবছিল, কৌটার ভেতর কী এমন থাকতে পারে যে, খোলা নিষেধ। তা-ও আবার রাজপরিবারের সম্পত্তি। সে তো রাজকুমারী, রাজপরিবারের সম্পত্তি হলে তো সে-ও খুলতে পারে।
বাইরে থেকে হঠাৎ শোঁ শোঁ শব্দ ভেসে এলো। যেন ঝড় বইতে শুরু করেছে। সেইসাথে কোলাহল। হাঁকডাক। বিমলা উঠে জানলা দিয়ে উঁকি দিল বাইরে। রানি জিগেশ করলেন, কী হলো রে বিমলা? ঝড় বইছে নাকি? হইচই কীসের?
মুখ না ফিরিয়েই বিমলা বলল, ঝড় উঠে এসেছে গো রানিমা। আকাশ ছেঁয়ে গেছে কালো মেঘে। প্রজারা হুড়োহুড়ি শুরু করেছে দিয়েছে। কী হবে এখন! বিমলার স্বরে আতঙ্ক। হাওয়ার দাপটে উড়ছে তার চুল। হু হু করে হাওয়া ঢুকে পড়ছে ঘরে।
রানির স্বরে উৎকণ্ঠা, শিগগির যা বিমলা, দ্যাখ, রাজামশাই কোথায় গেলেন। কী হবে এখন! উৎসব যে মাটি হয়ে গেল...। বলতে বলতে রানি উঠে গেলেন জানলার সামনে। বিমলা ছুটল রাজার সন্ধানে।
শ্বেতপাথরে বাঁধানো আয়নার সামনে বসে রাজকুমারী দেখতে লাগল নিজেকে। সারা দেহে দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে তার। কিন্তু তিনকোণা ওই কৌটাটিতে কী আছে? নতুন কোনও গয়না? রানিমা তবে কেন ওটা তাকে পরাননি? বাইরে ঝড় বইছে। হাওয়ার দাপট এই ঘরেও এসে পড়ছে। রানিমা চেয়ে আছেন বাইরে। তার চোখমুখে আতঙ্ক। তার ঘনকালো চুল উড়ছে হাওয়ার ঢেউয়ে। এই তো সুযোগ। তৃষ্ণা উঠল। তিনকোণা কৌটাটি হাতে নিয়ে আঙুল দিয়ে খুলে ফেলল ওপরের ঢাকনা। এরপরই অবাক হয়ে গেল। কী সুন্দর একটা ফুল! যেন এইমাত্র গাছ থেকে ছিঁড়ে নিয়ে আসা হয়েছে। আর এত ভুরভুর ঘ্রাণ যে, তৃষ্ণাকুমারী ফুলটি হাতে নিয়ে ঘ্রাণ শুঁকতে লাগল।
কী রকম ঝিমঝিম ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল রাজকুমারীর দেহে। একইসাথে চনমনে অনুভূতির একটি ঢেউ। ঝিমুনির মতো একটু তন্দ্রার ভাব এলো তার। আর ঠিক তখনই বিকট শব্দে কাছেপিঠে কোথাও বাজ পড়ার শব্দ হলো। কেঁপে উঠল মাটি। জানলার কাছ থেকে ছিটকে সরে এলেন রানি। কাঁপছিলেন তিনি থত্থর। চোখ পড়ল তৃষ্ণার দিকে। চোখ তার কপালে উঠে গেল। এ কী হলো, হা ভগবান! তীরের ফলার মতো ছুটে এসে রানিমা এক ঝটকায় কেড়ে নিলেন ফুলটি। এরপর তৃষ্ণাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, এ কী করলে রাজকুমারী! এ যে গর্ভকুসুম!
তৃষ্ণাকুমারী থ। কিছুই সে বুঝতে পারছে না। গর্ভকুসুম। কী দারুণ নাম! ভাল্লাগে রাজকুমারীর। একটি ফুলের নাম গর্ভকুসুম। ও আচ্ছা, এই ফুলটি তাহলে রাজপরিবারের সম্পদ। বেশ ফুল!
দূর থেকে পায়ের দপদম আওয়াজ ছুটে আসতে শোনা গেল। রানি দেখলেন, রাজা তেপই এসে ঢুকলেন ঘরে। তার চোখমুখে ছড়িয়ে পড়েছে উৎকণ্ঠা আর ভীতি। রানিকে দেখেই তিনি বলে উঠলেন, এ কী হলো রানি? এ যে ঘোরতর অমঙ্গলের সূচনা। বাজ পড়ে রাজবাড়ির সামনে পাঁচজন প্রজা মারা গেছে। প্রবল বৃষ্টি... কথা বলতে বলতে হঠাৎই থেমে গেলেন রাজা। চোখ পড়ল রানির হাতে। স্বরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল তার, একি, এ যে গর্ভকুসুম রানি! এ তোমার হাতে কেন রানি?
রানি নির্বাক। থত্থর কাঁপছেন।
ছুটে এসে রানিকে ঝড়িয়ে ধরলেন রাজা তেপই। রানি, একি, তুমি অমন করছ কেন?
জবাব নেই।
রাজা চাইলেন রাজকুমারীর দিকে। থতমত মুখে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চোখমুখে আতঙ্ক। টলটলে দিঘির মতো স্নিগ্ধ দুই চোখে এখন কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। রানিকে ছেড়ে দিয়ে রাজা এবার দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন রাজকুমারীকে।  রানি, কী হয়েছে আমাকে বলো। আমি আর নিতে পারছি না এসব। তোমার হাতে গর্ভকুসুম কেন, আমাকে বলো রানি।
মুখ খুললেন রানি, রাজকুমারী গর্ভকুসুমের ঘ্রাণ নিয়েছে। এরপরই জ্ঞান হারালেন রানি। রাজা বিধ্বস্ত হয়ে ভেঙে পড়লেন মেঝেতে। রাজকুমারী তারস্বরে কেঁদে উঠল। ছুটে এলো বিমলা।

রাত এলো। বৃষ্টি থেমেছে। নীরবতা চারদিকে স্তব্ধ হয়ে আছে। কী রকম ভারি ভারি। ঠা-া হাওয়া বইছে। চারদিক ঝুম অন্ধকার। থমথমে রাজবাড়ি। দাসদাসীদের হাঁকডাক নেই। মন্ত্রী বিষণ্ন মুখে রাজবাড়িতে বসে আছেন। রানির জ্ঞান ফিরেছে। তিনি এখন ঘুমোচ্ছেন। রাজবৈদ্য হরিচরণও রয়ে গেছেন রাজবাড়িতে। বিমলা তৃষ্ণাকুমারীকে নিয়ে ঘুমোতে চলে গেছে। রাজা বসে আছেন বারান্দায়। সারাদিনের ছবিগুলো একটার পর একটা ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। এরপর সংঘর্ষ বাঁধিয়ে ফেলল। ঘুমোতে চেষ্টা করছেন রাজা, পারছেন না। ঘুম তার আসছে না। একটি আতঙ্ক কেবলই তাকে তাড়া করে ফিরছে। যেন চাবুক মারছে পিঠে। থেকে থেকে তাই পিঠ টানটান করে, জেগে উঠতে হচ্ছে তাকে।  
বাগানের গাছপালার ওপর ঝিম অন্ধকার। শব্দ নেই। রাতপোকাদের ডাকাডাকি নেই। রাতজাগা কোনো পাখিও ডাকছে না। যেন তারা ডাকতে ভুলে গেছে। স্মরণকালে এমন ঘটনা এ রাজ্যে আর ঘটেনি। রাজউৎসবে যোগ দিতে এসে পাঁচজন প্রজা বাজ পড়ে মারা যাওয়ার ঘটনা. আর রাজকুমারীর গর্ভকুসুমের ঘ্রাণ নেয়ার ঘটনা, আসলে একই মানে প্রকাশ করে। ভবিতব্য কি, ভাবতে পারছেন না রাজা। রাত গভীর হলো। উঠে এলেন তিনি রানির কাছে। রানি ঘুমোচ্ছে। তিনিও শুয়ে পড়লেন তার পাশে। ক্লান্তি, বড্ড ক্লান্তি দেহে। ঘুমিয়ে পড়বার আগে রাজকুমারী তৃষ্ণার মুখটা একবার মনে ভেসে উঠল তার।
ঘাটে নৌকা বাঁধা। মাঝি নেই। রাজকুমারী দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধে হচ্ছে। গোধূলির রক্তাভা চারদিকে। কী উপায়! দূর থেকে একজনকে আসতে দ্যাখা গেল। কাছে এলে রাজকুমারী দেখল, বৈঠা হাতে মাঝি। মাঝিকে সে বলল, মাঝি, আমাকে পার করিয়ে দ্যাও।
মাঝি যেন শুনলোও না, এমনকি রাজকুমারীকে দেখলোও না, এমনভাবে নৌকায় উঠে বৈঠা ঠেলতে লাগল। তীরে দাঁড়িয়ে রাজকুমারী চ্যাঁচাতে থাকে, ও মাঝি, আমাকে নিয়ে যাও। আমি বাড়ি ফিরব। মাঝি তবু শোনে না। নৌকা বেয়ে সে চলে যায়। তীরে একা দাঁড়িয়ে থাকে রাজকুমারী।
অন্ধকার নেমে এলো। রাজকুমারী বসে বসে কাঁদছে। তার সামনে এসে দাঁড়ালেন সন্যাসী। চাঁদের আলোয় তাকে দেখতে পেয়ে চমকে উঠল রাজকুমারী। ভুলে গেল সে কাঁদতে। সন্যাসীর দিকে চেয়ে রইল অবাক চোখে।
সন্যাসী বললেন, ভয় পেয়ো না। আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি। তার আগে বলো, তুমি কাঁদছ কেন?
আমি রাজবাড়িতে ফিরব। কিন্তু নদী পেরোতে পারছি না। নৌকার মাঝিও আমাকে নিল না। আমি এখন কীভাবে ফিরব?
ও আচ্ছা, এই জন্যে তুমি বসে বসে কাঁদছ। এবার আমায় বলো তো, কেঁদে কি তুমি নদী পেরোতে পারবে?
কথা বলে না তৃষ্ণা। চেয়ে থাকে সন্যাসীর মুখের দিকে।
সন্যাসী জিগেশ করলেন, কী হলো! জবাব দিচ্ছ না কেন?
রাজকুমারী বলল, তা তো জানি না। আমার যে কান্না পাচ্ছে। আর ভয় করছে।
সন্যাসী বললেন, এই ভয় হচ্ছে তোমার নিজেকে নিয়ে। আচ্ছা আমায় বলো তো, তুমি কে? তুমি তো একজন মানুষ, তাই না?
হ্যাঁ, আমি তো মানুষই। ঘাড় নাড়ে রাজকুমারী।
দ্যাখো, তুমি তোমাকে রক্ষা করতে পারছ না, তাই ভয় পাচ্ছ, আর কাঁদছ। অথচ কেঁদেও লাভ হচ্ছে না। তাহলে কাঁদার কী দরকার?
রাজকুমারীও জিগেশ করল, তাই তো? তবে আর কাঁদছি কেন?
সন্যাসী বললন, হ্যাঁ রাজকুমারী, কেঁদো না। যা হবার তাই হবে। তুমি শুধু তা হতে দেয়ার সময় পর্যন্ত ধৈর্য ধরে একটু অপেক্ষা করো। এই বলে সন্যাসী মিলিয়ে গেলেন অন্ধকারে।
তৃষ্ণা বসে রইল নদীতীরে, একা।
ভোর হলো। ঘুম ভাঙল রাজার। ঘুম ভাঙল রানির। জেগে উঠল রাজবাড়ি। তবে বিষণ্ন। দাসদাসিদের ব্যস্ততা নেই। সারাবাড়ি নিঝ্ঝুম। রাজা বললেন, রানি, যা ঘটে গেছে, ভুলে যাও। আমি তুমি চাইলেই তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। যেহেতু পারি না, সেহেতু প্রতিদিনকার কাজকর্ম স্বাভাবিকভাবেই চালিয়ে যাওয়া উচিত।
এরপর রাজা তেপই ডেকে পাঠালেন মন্ত্রী বিশ্বনাথকে। তিনি গিয়ে দাঁড়ালেন বারান্দায়। মন্ত্রী এলেন। মহারাজের জয় হোক। রাতে ঘুম হয়েছে তো আপনার?
রাজা বললেন, ঘুমিয়েছি মন্ত্রীমশাই। ভাববেন না। আপনি সভার আয়োজন করুন। আমি একটু পরেই আসছি। যে কোনও দুর্ঘটনাই আকস্মিক। ভেঙে পড়লে চলবে না। প্রজাদের মনেও এ নিয়ে যেন কোনও শঙ্কা না থাকে, তা-ও আমাদের দেখতে হবে।
চলবে...