তৃষ্ণাকুমারী

উপন্যাস পর্ব ১৬

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : মার্চ ১৬, ২০১৮

ভানু বলল, হ্যাঁ। আর তাই ওকে দ্যাখার পর থেকেই আমার বুকেও তৃষ্ণা। কী এক অস্থিরতা আমাকে তাড়া করে ফিরছে। তোকে কী করে বোঝাবো সোনালি, যতবার ওর মুখটি মনে পড়ছে, ততবার আমার ভালো লাগছে। কেন লাগছে রে পোড়ামুখি?
ঠোঁট ওলটালো সোনালি, ওম্মা, এখন কীনা সব দোষ আমার! এরপর সোনালি একটু ফোড়ন কাটল, সব দোষ কার? ওই ব্যাটা নন্দ চামারের। জাতে চামার কীনা...
ভানু তেড়ে উঠল, ওই দ্যাখ, ঝগড়াটে বুড়ি আবার ঝগড়া করতে বেরিয়েছে। আমাকে দু’চারটে পরামর্শ দেবে, নয়...
সোনালি এবার শোলোক গাইল:

পিরিতি বান্ধিল বন্ধে কলিজারও খুন
জাতিকূলে সব হারাইলো, জ্বলিলো আগুন।

আগুনরঙা চাঁদ তখন টলটল করছে রাজবাড়ির আকাশে। পাল তুলে ভেসে যাচ্ছে শাদা মেঘ। রাজবাড়ি নির্জন হয়ে গেছে। ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই। তবু ওরা বসে রইল। সুনসান নীরবতা যেন আচ্ছন্ন করে ফেলেছে ওদের। পুকুরঘাটের পাশেই উঁচু লিচুগাছ। গাছটার কোনও এক ডালে ডেকে যাচ্ছে ডাহুক। এই সুর রাতের নির্জনতা ভেঙে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। পুকুরে পদ্মফুল। চাঁদের হিরকচ্ছটায় জ্বলজ্বল করছে ফুলের পাপড়ি। ঝিরঝির হাওয়া হিম হিম পরশ বুলিয়ে দ্যায় ভানু ও সোনালির দেহে। সোনালি বলে ওঠে, চলরে ভানু, এবার আমরা ঘুমোতে যাই। বেশ রাত হয়েছে।
ভানুরও মনে হলো, সকালে স্নানে যেতে হবে। আর তখন দ্যাখা হবে মানুষটার সঙ্গে। আর তাই, ঘুমিয়ে পড়তে হবে। সে বলল, চল তবে সোনালি, আমরা ঘরে যাই।
চল। বলল সোনালি। এরপর দুজন উঠল।

ঘুম এলো না ভানুর। নিথর রাতের প্রতিটি মুহূর্ত তার বুকে শিরশির ঢেউ তুলে যাচ্ছিল। ঝিরঝির ভালোলাগায় তার ঘোর এসে যাচ্ছিল। কিন্তু বাবা যদি জানতে পারেন? এক ধরনের শঙ্কাও মনে ভর করল তার। রাজা শৈবালচন্দ্র কোনোভাবেই চাইবেন না রাজপরিবারে কলঙ্কের দাগ লাগুক। যুবকটির পরিচয় কী, তা ভানু জানে না। রাজকুমারীর বিয়ে হবে রাজপুত্রের সঙ্গে। এই তো নিয়ম। সেখানে যুবকটি যদি ঘুটেকুড়ানির ছেলে হয়, তাহলে তো আর সম্ভব নয়। এসব ভাবনা ভানুকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। এবং সে ঘুমিয়ে পড়ল।

সিঁদুররাঙা সূর্য মুখে চুমু খেতেই ঘুম ভাঙল আলোকচন্দ্রের। সে উঠে বসল। নদীর জল ঝলমল করছে। পাখিরা কিচিরমিচির ডাকছে। হিম হিম সতেজ হাওয়া বইছে। বুক ভরে শ্বাস টেনে নিল আলোকচন্দ্র। একটি মুখ ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। কী মায়া ওই মুখটায়! গাঢ় বেদনার মতো প্রলেপ বুলিয়ে যায় তার হৃদয়ের ওপর। শিরশির কাঁপুনি ওঠে হৃদয়ে। কিছু সময় বসে রইল আলোকচন্দ্র। এসময় উঠল। নদীতে নেমে হাতমুখ ধুয়ে এলো। গোলাপ পাপড়ির মতো ভানুর মুখখানা ভাবতে ভাবতে আলোকচন্দ্রের ভাবনায় ঢুকে পড়ল মা। মুহূর্তে তার ভেতরটা আকুল হয়ে উঠল। মাকে কোথায় সে এখন খুঁজবে? মনে পড়ল কিনু গোয়ালা আর খেদির মুখ। চোখ ছলছল করে উঠল তার।

বসেই রইল আলোকচন্দ্র। একটু বেলা করেই এলো সোনালি আর ভানু। সঙ্গে আর কেউ নেই। সোনালি এসেই জিগেশ করল, তুমি কে গো যুবক? চিনপরিচয় কি?
ঘাবড়ে গেল আলোকচন্দ্র। কী পরিচয় সে দেবে? গোয়ালার ছেলে, নাকি রাজপুত্র? তার জীবনে তো আসলে দুটোই সত্যি। কিন্তু এ গল্প যদি ওরা বিশ্বাস না করে? থতমত খেয়ে যায় সে।  
ভানু বলল, বলো যুবক, তোমার পরিচয় বলো। আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমার পরিচয় তো তুমি জানোই।
ভাবনায় পড়ল আলোকচন্দ্র। শেষমেষ খুলে বলল পরিচয়। সোনালি বলল, আমিও তাই ভেবেছিলাম, তুমি কোনও রাজপুত্রই হবে। আর এদিকে কুট করে ভানুর গায়ে একটু চিমটি কেটে দিল।
ভানু বুঝল। কিছু বলল না।

আলোকচন্দ্রকে বলল, তবে চলো আমার বাবার কাছে। তাকে গিয়ে বলবে, তুমি রাজকুমারী ভানুকে বিবাহ করতে চাও।
তবে তাই হোক রাজকুমারী। সন্যাসীর নির্দেশমতো মায়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিলাম। দ্যাখা হলো তোমার সঙ্গে। আটকে গেলাম। কী জানি, নিয়তির কী লেখা। হয়তো এভাবেই মিলবে মায়ের সন্ধান।

রাজকুমারী ভানু আর সোনালির সঙ্গে রাজবাড়িতে এলো আলোকচন্দ্র। এরপর প্রহরীদের ডিঙিয়ে ঢুকে গেল রাজদরবারে। রাজা শৈবালচন্দ্র বসে ছিলেন সিংহাসনে। এ বছর ধানের ফলন নিয়ে কথা বলছিলেন মন্ত্রীর সঙ্গে। গতবছর এ রাজ্যে দারুণ খরা গেছে। এ বছর তা উঠল কীনা, এরই একটু তত্ত্ব-তালাশ। আলোকচন্দ্রকে আসতে দেখে প্রহরীরা হই হই করে উঠলে রাজা মুখ ফেরালেন। এরপর প্রহরীদের থামতে ইশারা করলেন।

চলবে...