তৃষ্ণাকুমারী

পর্ব ১৭

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : মার্চ ১৭, ২০১৮

আলোকচন্দ্র এসে দাঁড়ালো রাজার সামনে। রাজা জিগেশ করলেন, কে তুমি যুবক? এখানে কি চাও?
সে জবাব দিল, আমার নাম আলোকচন্দ্র। আমি একজন রাখালছেলে, আবার একইসঙ্গে রাজপুত্র।
আমোদ পেলেন মন্ত্রী, আহা বেশ বেশ। রাজপুত্র আর রাখালছেলে! তা তোমার আগমনের হেতু কি?
রাজাও জিগেশ করলেন, হ্যাঁ, বলো হেতু কি?
আলোকনাথ বলল, আমি রাজকুমারী ভানুকে বিবাহ করতে চাই।
থমথমে হয়ে গেল রাজার মুখ। মন্ত্রীও থ।
কিছু সময় পর রাজা বললেন, দ্যাখো ছেলে। রাজরক্ত ছাড়া রাজরক্তের বিবাহ হয় না। তুমি যে সত্যি সত্যি রাজরক্ত, এর প্রমাণ কি?

আলোকচন্দ্র দৃঢ় স্বরে বলল, খাগড়া মুল্লুকের রাজা তেপই আমার নানা। আমার মায়ের নাম তৃষ্ণা। এক সদাগর তাকে বন্দী করে রেখেছে। আমি তারই সন্ধানে বেরিয়েছিলাম। শ্রী রাজ্যে এসে দ্যাখা হলো রাজকুমারী ভানুর সঙ্গে। তাকে দেখে আমি মুগ্ধ।

ছেলেটির ভেতর কোনও রাখঢাক নেই। যা বলার, সে সরাসরি বলে দিচ্ছে। এই ভঙ্গি ভালো লাগল রাজার। হাত তুলে তিনি বললেন, তা বেশ বেশ। তুমি এখন অতিথিশালায় গিয়ে বিশ্রাম করো। এ বিষয়ে পরে আমাদের কথা হবে। দেখে মনে হচ্ছে তুমি ক্লান্ত। অনেক দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এসেছো।

আলোকচন্দ্র বলল, আমার আরও কিছু কথা বলার আছে। আপনাকে আমার যে পরিচয় দিয়েছি, এক সন্যাসী আমাকে একথা জানিয়েছে। এতদিন আমি ছিলাম কিনু গোয়ালা আর খেদির সন্তান। মাঠে মাঠে আমি গরু চড়াতাম।

আবারও আমোদ পেলেন মন্ত্রী। বললেন, মহারাজ, ব্যাটা দেখি উল্টাপাল্টা বলতিছে। এর আগামাথা কিছু নাই। কী যেন ভাবলেন রাজা। এরপর বললেন, কিন্তু আমরা তো বাবা সন্যাসীর কথা শুনিনি। তোমার কথার বিশ্বাস কি? তুমিই বলছ রাখালি করতে। আবার বলছ সন্যাসী বলেছে, তুমি খাগড়া মুল্লুকের রাজা তেপইয়ের নাতি। রাখালছেলের সঙ্গে রাজপুত্রের মিল কোথায় এখানে? আর সেই খাগড়া মুল্লুকই বা কোথায়? তা সে এখন কে খুঁজে বের করবে?

আলোকচন্দ্র চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। চট করে কোনও কথা জুটল না মুখে। একটু সময় পরে বলল, বেশ, তবে আমার পরীক্ষা নিন। প্রমাণ করে দেখুন আমার শরীরে রাজরক্ত বইছে কীনা।

রাজা বললেন, বেশ। তবে দাও প্রমাণ। আমার রাজ্যের নদীপথ দিয়ে প্রায়ই জলদস্যু এসে রাজ্যের ক্ষতিসাধন করে যায়। এছাড়া ভিনদেশি সদাগরেরা খাজনা না দিয়েই আমার রাজ্যের নদীপথ পেরিয়ে যায়। আমার সৈন্যবাহিনী তাদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে অনেকবার ব্যর্থ হয়েছে। তুমি বুঝতে পারছ আমি কি বলছি?

আলোকচন্দ্র ঘাড় নাড়ল, আমি বুঝতে পারছি। আপনি বলুন। রাজা বললেন, এখন তুমি যদি তাদের প্রতিরোধ করতে পারো, আর সদাগরদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতে পারো, তবেই বুঝব, তোমার দেহে রাজরক্ত  বইছে। এমন ছেলের সঙ্গেই রাজকুমারী ভানুর বিয়ে সম্ভব। আলোকনাথের স্বরে রাজোচিত উচ্চারণ, আপনি ব্যবস্থা করুন। আজ থেকেই আমি শ্রীরাজ্যের নদীপথ পাহারা দেব।

ছেলেটির দৃঢ়তা দেখে খুশি হলেন রাজা। মন্ত্রীকে নির্দেশ দিলেন, বড় একটি বজরার সঙ্গে পঞ্চাশজন সৈন্য দিয়ে এই যুবককে পাঠিয়ে দিন নদীপথে। সঙ্গে পর্যাপ্ত অস্ত্রসস্ত্র আর খাবার। মন্ত্রী মাথা একটু হেলিয়ে বললেন, আমি এখুনই সব ব্যবস্থা করছি রাজামশাই। সে আপনি ভাববেন না। এরপর আলোকচন্দ্রের উদ্দেশে বললেন, চলো হে যুবক। তোমার যুদ্ধতরী সাজিয়ে দিই।

মন্ত্রীর সঙ্গে আলোকচন্দ্র যখন রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে, তখন আলোকচন্দ্র দেখতে পেল, ফুলবাগানে দাঁড়িয়ে আছে ভানু আর সোনালি। তার দিকে ওরা এগিয়ে এলো। ভানু এসেই বলল, মন্ত্রীমশাই, কিছু মনে করবেন না। ওর সঙ্গে আমি একটু কথা বলব। মন্ত্রী বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। এই আমি একটু হেঁটে আসছি। মন্ত্রী একটু দূরে গেলে ভানু জিগেশ করল, কী বললেন বাবা? আলোকচন্দ্র জবাব দিল, আমাকে প্রমাণ দিতে হবে।
কী প্রমাণ?
এ রাজ্যের নদীপথ থেকে খাজনা আদায় করে দিতে হবে। সফল হলেই প্রমাণ হবে, আমার দেহে রাজরক্ত। তুমি ভেবো না ভানু। আমি জানি, একাজ সহজেই আমি করে দিতে পারব। এখন শুধু ধৈর্য ধরতে হবে। তোমাকে। আমাকেও।

সোনালি বলল, হ্যাঁ। এটাই বেশ হয়েছে। তুমি প্রমাণ দিতে পারলে রাজকুমারীকে পেতে আর কোনও বাধা তোমার রইল না। আলোকচন্দ্র ভানুর থরো থরো দু’চোখের দিকে চেয়ে বলল, হাতলে চলি রাজকুমারী। আবার আমাদের দ্যাখা হবে। চলি সোনালি, সখিটির কাছাকাছি থেকো।

চলবে...