তৃষ্ণাকুমারী

পর্ব ১৮

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : মার্চ ১৮, ২০১৮

শুরু হলো আলোকচন্দ্রের নদীপথের জীবন। সে বসে থাকে বজরার ছাদে। চোখ রাখে চারদিকে। মাঝেমাঝে নিচে নেমে আসে। একটু তদারকি করে। কখনও খাওয়া-দাওয়া করে। এরপর আবার উঠে যায় ছাদে। টলটলে নদীর জল। এই জলের ওপর ভাসমান জীবন ভালোই লাগে তার। থেকে থেকে মনে পড়ে ভানুর মুখ। কী স্নিগ্ধতা ওই মুখে। হাসির ঝিলিকে যেন রাতের আকাশ থেকে তারা  খসে পড়ে। কখনও মনে পড়ে সন্যাসীর নির্দেশ। আর তখন আনমনা হয়ে যায় আলোকচন্দ্র।   

একটি সওদাগরি নৌকা যাচ্ছে। আলোকচন্দ্র মাঝিকে নির্দেশ দিল নৌকাটিকে ধরতে। বজরা ছুটল। আটকালো নৌকাটাকে। আলোকচন্দ্র লাফ দিয়ে নেমে পড়ল নৌকাটার পাটাতনে। সওদাগরকে বলল, এ রাজ্যের নদীপথ ব্যবহার করছ, অথচ খাজনা না দিয়ে চলে যাচ্ছ, এটা কি ভালো হচ্ছে? সওদাগর জবাব দিল, নদীপথে আবার খাজনা কি? পথ ছাড়ো। আলোকচন্দ্র বলল, এ রাজ্যের রাজা শৈবালচন্দ্র। তাকে খাজনা না দিয়ে এ নৌকা এখান থেকে যেতে পারবে না।

সওদাগর বলল, সে তো এর আগেও কতবার রাজার লোক এসে বলেছে। আবার কতবার এ পথ দিয়ে গেছি। এসব আমার সওয়া আছে বাপু। মিছেমিছি আর কেন পথ আটকানো? আলোকচন্দ্রের দৃঢ় স্বর, খাজনা না দিলে তোমাকে বন্দি করা হবে। এরপর রাজার সামনে নিয়ে যাওয়া হবে। যা করার, তিনি করবেন। এরচে খাজনা দিয়ে দেয়া কী ভালো নই? শুধু শুধু কেন হেনস্তা হতে যাবে বাপু? সওদাগর আর কিছু বলল না। খাজনা মিটিয়ে দিল। ছেড়ে দেয়া হলো নৌকাটিকে।

নদীর ওইপাড়ে ঘন বন। জলদস্যুদের ডেরা ওই বনে। জলের ওপর দিয়ে সাই সাই ছোটে ওদের নৌকাগুলো। প্রায়-প্রায়ই আলোকচন্দ্রের সঙ্গে তাদের লড়াই বাঁধে। যখন লড়াই হয়, তার বিক্রম দেখে সবাই থরে কম্প। এক দস্যুর পর আরেক দস্যুর মাথা কাটা পড়ে তার তলোয়ারের নিচে। আলোকনাথের তলোয়ারের সামনে খুব বেশি সময় কেউ টিকতে পারে না। যারা বেঁচে থাকে, প্রাণ নিয়ে তারা পালায়। ভুলেও আর এদিকটায় আসার নাম করে না।

দুপুর। নরম রোদের দিন। বজরার ছাদে শুয়ে মেঘ মেঘ আকাশের দিকে চেয়ে আছে আলোকচন্দ্র। নদীর কাতল মাছ আর শিম-আলুর তরকারি দিয়ে একটু আগেই তারা খেয়ে উঠেছে। সঙ্গে ছিল ধনেপাতার চাটনি। সৈন্যেরা কেউ কেউ ঝিমোচ্ছে। কেউ কেউ গল্প-চাটাম করছে। ওপরে মুখ তুলে আলোকচন্দ্র দেখল, নীল আকাশে মেঘগুলো ভেলার মতো কী রকম ভেসে ভেসে চলেছে। উদার আকাশের নিচে তাদের বজরাটিও নদীর জলে ভাসতে ভাসতে চলেছে। একটু ঝিমুনির মতো এসেছিল আলোকচন্দ্রের। হঠাৎ শুনল এক মাঝির কণ্ঠস্বর। তারই উদ্দেশে চ্যাঁচাচ্ছে, দূরে একখান নাও দ্যাখা যায়। মনে হতেছে সদাগরি নাও।

উঠে বসল আলোকচন্দ্র। দেখল, হ্যাঁ, ওই তো। সেও চেঁচালো, বৈঠা টানো। আটকাও ওটাকে।  
বজরা ছুটল। আটকানো হলো সওদাগরি নৌকা। সওদাগর মানুষটি বৃদ্ধ। আর সঙ্গেও খুব বেশি পণ্যসামগ্রী নেই। আলোকচন্দ্র খাজনা চাইলে সে বলল, আমরা খাজনা দিয়েই চলাচল করি বাপু। তা কত তোমার খাজনা? আলোকচন্দ্র বলল, দুই আনা। সওদাগর তাকে দুই আনা দিলেন। এরপর বললেন, মাসে দুই দুই চারবার আমি এপথে চলাচল করি। তোমাকে এই নতুন দেখছি যেন? আলোকচন্দ্র বলল, হ্যাঁ। শ্রীরাজ্যের নদীপথ ব্যবহার করলেও লোকজন রাজা শৈবালচন্দ্রকে খাজনা দেয় না। কিন্তু এবার থেকে আর সেটা আমি হতে দেব না। রাজার আইন সবার জন্যে সমান।  বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, কিন্তু বাবা, আইন যখন উল্টে যায়?

আলোকচন্দ্র বলল, তখন রাজ্যের ক্ষতি। আর রাজ্যের ক্ষতি হলে প্রজা সাধারণের ক্ষতি। বৃদ্ধ বললেন, সেই ক্ষতির মধ্যে দিয়েই এখন আমাদের যেতে হচ্ছে বাবা। আলোকচন্দ্র ঠিক বুঝল না বৃদ্ধের কথা। জিগেশ করল, মানে? বৃদ্ধ বললেন, মানে আর কী বলব! খাগড়া মুল্লুকের নাম শুনেছো গো? চমকে উঠল আলোকচন্দ্র। বৃদ্ধের চোখের দিকে চেয়ে জবাব দিল, হ্যাঁ শুনেছি। কী হয়েছে সে রাজ্যের? বৃদ্ধ বললেন, রাজা তেপই ছিলেন খাগড়া মুল্লুকের রাজা। তাকে বন্দি করে তার মন্ত্রী এখন সিংহাসনে বসেছেন। এদিকে রানিমা কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে গেছেন। রাজা-রানিকে বন্দি করে রেখেছে পাষ- মন্ত্রী। প্রজাদের কিছুই করার নেই। রাজসৈন্য এখন মন্ত্রীর নির্দেশে চলছে। রাজ্যজুড়ে শুরু হয়েছে অনাচার। ব্যবসা-বাণিজ্য করে আমরা খাই। খাজনা দিতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু রাজার আইন বলে অকারণ নিপীড়ন আমরা কেন সইবো? আলোকনাথ জিগেশ করল, তাই বুঝি শুরু হয়েছে সেই রাজ্যে?

চলবে...