তৃষ্ণাকুমারী

পর্ব ১৯

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : মার্চ ১৯, ২০১৮

সওদাগর বললেন, তবে আর বলছি কী! রাজ্যজুড়ে এখন চলছে অনিয়ম। টাকা-পয়সা নিয়ে কারও নিরাপত্তা নেই। সৈন্যরা পীড়ন শুরু করেছে সাধারণ প্রজাদের ওপর। প্রজারা হাহাকার তুলছে।

আর কিছু কানে ঢুকল না আলোকচন্দ্রের। ছেড়ে দিল সে বৃদ্ধের নৌকাটি। চুপচাপ উঠে গেল বজার ছাদে। পরিষ্কার আকাশ। ঝকঝরে নরম রোদ ছড়ানো নদীর পানিতে। তাদের বজরা থেকে ঢেউয়ের দোলা ছড়িয়ে পড়ছে দূরে। বজরাটি যেন ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে লাগল নদীর বুকে।

মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে আলোকচন্দ্রের। হাতের পেশিগুলো ক্রোধে শক্ত হয়ে উঠছে। প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে চোখমুখে। বৃদ্ধ নানা তেপই আর রানির জন্যে তার বুক হাহাকারে ভরে উঠল। কিন্তু তাকে যে অপেক্ষা করতে হবে। খুঁজে পেতে হবে মাকে। এরপর ভানুকে বিয়ে করে শ্রীরাজ্যের রাজার সাহায্য নিয়ে সে অধিকার করবে খাগড়া মুল্লুক।
 
তবু, ধৈর্য মানে না তার। বারবার শুধু মনের ভেতরটা আনচান করে। এভাবে আর কতদিন তাকে কাটাতে হবে? সময় যেন সময় নয়, পাথর। দ্রুত সে পাথর আলোকচন্দ্র টলাতে পারে না। সে স্থির হতে পারে না। সারাক্ষণ কী এক ছটফটানি ভেতরে। রাত নামে। আধোঘুম আধোজাগরণে ভোর হয়। ভোরের পরশ পেয়ে ছইয়ের ভেতর ঘুম ভেঙে উঠে বসে আলোকচন্দ্র। আড়মোড়া ভেঙে জানলার পরদা সরিয়ে দ্যাখে, সূর্য ঝলমল করছে নদীর জলে। নতুন ভোর। জীবনের নতুন আরেকটি দিন। বাইরে বেরিয়ে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসল সে। হঠাৎ এক মাঝির চিৎকার শোনা গেল, দস্যু আসতিছে... দস্যু...

আর কীসের খাওয়া, উঠে পড়ল আরোকচন্দ্র। সৈন্যেরাও দ্রুত উঠে তৈরি হয়ে নিল। এতদিন তো জলদস্যুদের নাম-নিশানা ছিল না। হঠাৎ এলো কোত্থেকে? জলদস্যুদের নৌকাটা প্রায় তাদেরই সমান। তবে কোনও ছই নেই। একেবারে খোলা। প্রায় পঁচিশ-তিরিশজন জলদস্যু নৌকা ঠেকিয়েই ঝাপিয়ে পড়ল তাদের ওপর। আলোকচন্দ্র দেখল, তার দুজন সৈন্য কাটা পড়ে গেল এক জলদস্যুর তলোয়ারের নিচে। দস্যুদের আঘাত ঠেকাতে ঠেকাতে আলোকচন্দ্র বুঝে নিতে চাইল, দস্যুদলের সর্দার কে? সে দেখল, দুই সৈন্যের মাথা কেটে নেয়া লোকটি এবার তার দিকে আসছে। সে তৈরি হয়ে নিল। এই হচ্ছে জলদস্যুদের সর্দার। বেশ পেশিবহুল। চোখের দৃষ্টি কাটা কাটা। সিনা টানটান।  

সর্দার এসেই তার দিকে তলোয়ার চালালো। আলোকচন্দ্র তার তলোয়ার দিয়ে আঘাত প্রতিহত করল। এরপর বলল, আত্মসমর্পণ করো সর্দার। নইলে তোমাদের প্রত্যেকের মাথাকাটা পড়বে। আবারও তলোয়ারের আঘাত হানলো সর্দার। বলল, এই নে আত্মসমর্পণ। এ আঘাতও প্রতিহত করল আলোকচন্দ্র। মুহূর্তে আবার সে পাল্টা আঘাত হানলো। আচমকা এ আঘাতের জন্য প্রস্তুতির কোনও সময় পায়নি সর্দার। তার ডান পাজর চিরে গেল। পিছিয়ে গেল সর্দার। এ সুযোগে আলোকচন্দ্রের দুই সৈন্য এসে আটকে ফেলল তাকে। আলোকচন্দ্র বীর-বিক্রমে ঝাপিয়ে পড়ল আর আর দস্যুর ওপর। হাতের কাছে যাকেই পেল, মাথা কেটে ফেলল। এ দৃশ্য দেখে বেশিরভাগ দস্যু নদীর জলে ঝাপ দিয়ে প্রাণ নিয়ে বাঁচল।

জলদস্যুদের নৌকাটিকে বজরার সঙ্গে বেঁধে নিল মাঝিরা। এরপর ডাঙার দিকে চলতে শুরু করল বজরাটি। আহত সৈন্যদের শুশ্রুষায় লেগে গেল আলোকচন্দ্র। বজরা তীরে ভিড়ল। মৃতদেহগুলো নামানো হলো তীরে। রাজার লোক এসে সেগুলো মাটিচাপা দিতে নিয়ে গেল। আহত সৈন্যরা ফিরে গেল বাড়ি। আলোকচন্দ্র গেল রাজবাড়িতে। দাঁড়ালো গিয়ে রাজার সামনে। রাজা শৈবালচন্দ্র তাকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন, বলো যুবক, কী তুমি বলতে এসেছো? আলোকচন্দ্র বলল, নদীপথে আর তেমন বিশৃঙ্খলা নেই। স্বেচ্ছায় সদাগরি নৌকাগুলো মহারাজাকে খাজনা দিয়ে যাচ্ছে। জলদস্যুরাও ভয়ে এদিকটায় আর আসছে না। তবে আজ একটি বাহিনীকে আমরা লড়াইতে হারিয়েছি। তাদের মৃতদেহগুলোও মহারাজার লোকেরা মাটিচাপা দিতে নিয়ে গেছে। আমার মনে হয়, এরপর আর কোনও দস্যুর সাহস হবে না আপনার নদীসীমায় পা দেয়ার।

রাজা হাত তুলে বললেন, সে খবর আমি আগেই পেয়েছি হে। তোমার বীরত্বে আমি গর্বিত। কিন্তু এখনই হুট করে প্রহরা বন্ধ করে দেয়া চলবে না। তাহলে পরিস্থিতি আবারও আগের মতো হয়ে যেতে পারে। তোমাকে আরও কয়েকটা দিন নদীপথে কাটাতে হবে। এরপর আমি প্রহরার অন্য ব্যবস্থা নেব। এরপরই তোমার হাতে তুলে দেয়া হবে রাজকুমারী ভানুকে। তোমার শরীরে যে রাজরক্ত বইছে, প্রমাণ আমি পেয়েছি। এই বলে রাজা উঠে এলেন সিংহাসন থেকে। নেমে এসে আলোকচন্দ্রকে জড়িয়ে ধরলেন। আলোকচন্দ্রের বুক ভরে গেল স্নেহের পরশে। মনে পড়ল ভানুর মুখ। টলটলে জলের মতো মায়াঘেরা একটি মুখ। ভানু কি জানে, সে এসেছে? তা তো আলোকচন্দ্র জানে না। আবার মুখ ফুটে কাউকে বলতেও পারছে না।

রাজা বললেন, তুমি ধন্য যুবক। তুমি সুপুরুষ। রাজকুমারী ভানু তোমারই যোগ্য বটে। নাকি মন্ত্রীমশাই? মন্ত্রী রাজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। বলে উঠলেন, সে আর বলতে। এ ছেলের বীরত্ব আছে, বলতেই হবে। রাজ্যের এতগুলো সৈন্য যেখানে কিছুই করতে পারেনি, এ ছেলে মাত্র ক’দিনেই তা করে দেখিয়ে দিলে।

চলবে...