তৃষ্ণাকুমারী

পর্ব ২০

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : মার্চ ২০, ২০১৮

আলোকচন্দ্র চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। ভাবছিল, তার বীরত্বের প্রমাণ সে দিতে পেরেছে। মন্ত্রী উচ্ছ্বসিত। রাজার মুখে তার বীরত্বের প্রশংসা। এবার সে জয় করবে ভানুকে। এরপর বের হবে মায়ের উদ্দেশে। রাজা শৈবালচন্দ্র বললেন, ঠিকাছে বাবা আলোক, তুমি এবার আসতে পারো। ঠিকঠাক নজর রেখো। এরপর আমিই তোমাকে খবর পাঠাবো। সেসময় পর্যন্ত ভালো থেকো।

রাজাকে কুর্নিশ করে আলোকচন্দ্র বেরিয়ে এলো। ঝরঝরে লাগছে ভেতরটা। বেশ ঝরঝরে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। এরপরই সুদিনের হাওয়া বইবে। কিন্তু দুখিনি মাকে সে কীভাবে খুঁজে পাবে? সন্যাসী তো এ ব্যাপারে কিছুই তাকে  বলেননি। কেবল বলেছেন, পথই তাকে পথ দেখাবে। আর এদিকে সে আটকে পড়েছে আরেক মানুষের খোঁজে। খুঁজে যদিও সে তাকে পেয়েছে, এখন কেবল মুখোমুখি বসে দুজন দুজনের দিকে চেয়ে থাকার অপেক্ষা।  

তার চোখ ভানুর খোঁজে এদিক-ওদিক ঘুরতে লাগল। হঠাৎ চোখে পড়ল, বাইরে ফুলবাগানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভানু। সঙ্গে সোনালি। সে এগিয়ে গেল। কেমন আছো ভানু? টলটলে সেই চোখ ভানুর। আর মুখশ্রী। তবে বিষণ্ন। কী রকম যেন ক্ষয়াটে দেখাচ্ছে তাকে। জবাব দিল না ভানু। চেয়ে রইল আলোকবচন্দ্রের মুখের দিকে। আলোকচন্দ্র হাত ধরল ভানুর।

সোনালি বলল, ভানু তোমার জন্যে সারাটাক্ষণ আনমনা থাকে। ঠিকমতো খায়দায় না। রাজা-রানিও এতদিনে বুঝে গেছেন, তোমাকে ছাড়া তাদের রাজকুমারী আর কারো গলায় মালা পরাবে না। সুতরাং উপায় কি? তা হে বীরপুরুষ, খাবারের এই ঝোলাটা নিয়ে যাও। খেও। আলোকনাথ জিগেশ করে, কি আছে এতে? সোনালি বলল, পিঠা। আজ তুমি রাজবাড়িতে আসবে, এটা রাজকুমারী গত রাতেই আমাকে বলেছিল। আমি জিগেশ করেছিলাম, নিশ্চিত হলি কীভাবে? ও বলল, স্বপ্নে দেখেছি। এখন বোঝো ঠেলা! কী সব ভুতুরে ব্যাপার। সে যাই হোক, নদীতে ঘুরে-ঘুরে কী খাও আর না-খাও, আমি আর ভানু মিলে তোমার জন্যে কয়েক পদের পিঠা বানিয়েছি। কয়েকদিন ধরে খেতে পারবে, নষ্ট হবে না।

আলোকচন্দ্র ভারি অবাক হলো সোনালির কথা শুনে। সে জিগেশ করল, রাজকুমারী, এসব কি সত্যি? আমি আসব, তুমি স্বপ্নে দেখেছিলে? মুখ খুলল ভানু, হ্যাঁ রাজকুমার। বটগাছের নিচে প্রথম যেদিন আমাদের দ্যাখা হয়, সেটাও আমি আগের রাতে স্বপ্নে দেখি। এরকম কেন হয়, আমি জানি না। আলোকচন্দ্র বুঝল, এ ঘটনার সাথে সন্যাসীর কোনও যোগাযোগ থাকতে পারে। আর যদি তাই হয়, তবে মাকে খুঁজে পেতে আর বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না। সে ঠিক পথেই এগোচ্ছে। আলোকচন্দ্র ডাকল, রাজকুমারী? ভানু জবাব দিল, উুঁ?

আলোকচন্দ্র পরম উচ্ছ্বাসে বলে উঠল, আর কয়েকটা দিন পরই আমাদের মিলন ঘটবে। আমি আমার রাজরক্তের প্রমাণ দিতে পেরেছি। রাজা বলেছেন, আর ক’টা দিন নদীপথে আমাকে বিশেষ প্রহরা দিতে হবে। এরপর তিনিই আমাকে খবর পাঠিয়ে ডেকে আনবেন। ভানু বলল, রাজকুমার, তোমার অনুপস্থিতি আমাকে নিঃসঙ্গ করে দ্যায়। তোমার ভাবনা আমাকে আনমনা করে ফ্যালে। আমি আমাদের মিলনমুহূর্তের অপেক্ষায় আছি। আলোকচন্দ্র বলল, আমি জানি রাজকুমারী। তোমার প্রেমের উত্তাপ জলের ওপর থেকেও আমি অনুভব করি। আর আমার কথাও শুনে রাখো, আমার থেকে বেশি ভালো এই পৃথিবীর কেউ তোমাকে বাসতে পারবে না।

কথা ফোটে না ভানুর ঠোঁটে। থরোথরো ঠোঁটে সে চেয়ে থাকে আলোকচন্দ্রের চোখে। সে জানে না, যুবকটির প্রতি কেন তার দুর্নিবার এই আকর্ষণ। তবে বুঝতে পারে, তার ভালোলাগার সব ছবি যুবকটিকে ঘিরে আছে। আরও বুঝতে পারে, যুবকটির জন্যে তার বুকে হাহাকার বেজে ওঠে।

আলোকচন্দ্র বলল, আমি এখন চললাম। ভালো থেকো ভানু। গেলাম সোনালি। এরপর সে বেরিয়ে এলো রাজবাড়ি থেকে।

চলবে...