তৃষ্ণাকুমারী

উপন্যাস পর্ব ২২

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : মার্চ ২২, ২০১৮

কাঁদতে কাঁদতে রানি জবাব দিল, সব কিছুর জন্য আমিই দায়ী।
রাজা বললেন, না রানি, এভাবে বলো না। নিয়তির খেলা এরকমই। তুমি আমি আমরা কেবল খেলার পুতুল। যেমনি খেলায়, খেলি। শুধু শুধু নিজের ওপর দোষ চাপিয়ে দুঃখের ভার বাড়িয়ে তুলো না।
রানি তবু কাঁদেন। যেন কান্না ছাড়া মানুষের আর ভাষা নেই। রাজা কী-ই বা করেন। বসে থাকেন। রাত এখন কত, বোঝার উপায় নেই।  বদ্ধ এই কয়েদখানায় দিনরাত ঠাউর করা যায় না। কেবল নিঃসাড় পড়ে থাকতে হয়। প্রাণ থাকতেও যেন প্রাণহীন।
রানির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে রাজা বললেন, এবার একটু ঘুমোতে চেষ্টা করো রানি।
রানির কান্না একটু থেমেছে। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে তিনি বললেন, ঘুম যে আসে না। কী করব আমি?
রাজার তবু সান্ত¡না, চেষ্টা করো ঘুমোতে। এভাবে না ঘুমিয়ে থাকতে থাকতে তুমি তো পাগল হয়ে যাবে।
ফ্যাসফেসে স্বরে রানি বললেন, এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে পাগল হয়ে যাওয়া অনেক ভালো। পাগলের হাজার কষ্ট থাকতে পারে, কিন্তু কোনও চিন্তা থাকে না। ঘুম এলেই অনায়াসে ঘুমিয়ে পড়তে পারে।  
রাজার মুখে কথা নেই। রানিকে আর কী বলবেন! কতদিন হয়ে গেল, তিনিও নিশ্চিন্ত হয়ে একটু ঘুমোতে পারেননি। অবসন্ন লাগে দেহ। আর ভারি। এইটুকু এক ঘর, নড়াচড়ারও তেমন জায়গা নেই। দিন আর রাতের আবর্তন কিছুই তারা জানতে পারেন না। যখন প্রহরী এসে মাটির প্রদীপটা জ্বেলে দিয়ে যায়, শুধু তখন বোঝা যায় বাইরে এখন রাত নেমে এসেছে। প্রদীপ জ্বেলে দরজা লাগিয়ে দিয়ে প্রহরী চলে যায়।
রাজা-রানি কাঠ হয়ে পড়ে থাকেন মেঝেতে। হঠাৎ হঠাৎ যদিও ঘুমের ঘোরে রাজা ঢলে পড়েন, পরমুহূর্তে জেগে ওঠেন আতঙ্ক নিয়ে। ঘুমের ভেতরও দুশ্চিন্তা তাড়া করে ফেরে। আর যতক্ষণ জেগে থাকেন, নানা ভাবনার এলোমেলো ঢেউ ভাঙতে থাকে মাথার ভেতর।
রাত বাড়তে থাকে। একসময় নিভে যায় প্রদীপ। একটু ঢুলুনির মতো এসেছিল রাজার। কী যেন শব্দে তা ভেঙে গেল। তিনি ডাকলেন, রানি?
জবাব নেই।
রানি কি ঘুমিয়েছ?
এবারও জবাব নেই। ঘরের কোথায় যেন অন্ধকারে খুট করে একটু শব্দ হলো। আরও একবার। কেউ যেন কাশছে। খুট খুট শব্দ এবার একটু জোরে হলো। মনে হলো, লাঠি ঠোকার শব্দ।
রাজা জিগেশ করলেন, কে, কে ওখানে?
অন্ধকারের ভেতর কেউ একজন কথা বলে উঠল, আমি সন্যাসী। চিনতে পেরেছো আমাকে?
রাজা অবাক হলেন। এবং মুষড়ে পড়লেন। পাপভার বোধ করলেন বুকের ভেতর। এখন কি মুখে তিনি সন্যাসীর মুখোমুখি হবেন?
সন্যাসী বললেন, প্রতিটি মানুষ আসলে নিয়তিতাড়িত। আগে থেকে লেখা একটি নাটকে সে অভিনয় করে যাচ্ছে। এরপরও ভগবানের অলৌকিকত্বের নিদর্শন কারও কারও হাতে এসে পড়ে। যখন পড়ে, তখন এর খেসারতও কিছু তাকে দিতে হয়। আগুনে না পোড়ালে সোনা খাঁটি হয় না, জানো তো? সে যাক, অনেক কষ্ট ভোগ হয়েছে তোমাদের। এবার আমি তোমাদের সুখের বার্তা নিয়ে এসেছি। তেপই অধৈর্য স্বরে জিগেশ করলেন, কী বার্তা বলুন সন্যাসী।
সন্যাসী বললেন, তোমাদের সুদিন আসছে। খুব শিগগিরই তৃষ্ণা আর তার পুত্র মগধ এসে উদ্ধার করবে তোমাদের। এ রাজ্যে আবার বইবে শান্তির হাওয়া।  
ঝরঝর কেঁদে ফেললেন রাজা। ওরা বেঁচে আছে সন্যাসী? ওরা সবাই বেঁচে আছে?
সন্যাসী বললেন, হ্যাঁ। ওরা বেঁচে আছে। এবং বীরের বেশে এসে তোমাদের উদ্ধার করবে। অতএব, আর কয়েকটি দিন ধৈর্য ধরো। এখন আমি যাচ্ছি। রাজা দুহাত এক করে বললেন, আপনার চরণে আমার প্রণাম হে সন্যাসী। তবে একটি প্রশ্ন ছিল।
সন্যাসী জিগেশ করলেন, কী প্রশ্ন?
রাজা জিগেশ করলেন, আপনি আসলে কে?
ও, এই কথা! এতদিনেও তুমি বুঝতে পারোনি আমার চরিত্র কি?
রাজা সরলভাবেই স্বীকার করলেন, সত্যিই বুঝিনি। দয়া করে আপনার পরিচয়টা একটু দেবেন?
সন্যাসী বললেন, আমি নিয়তি। কোনও মানুষই দু’বার আমার সাক্ষাৎ পায় না। যেখানে একবার পাওয়াই দুর্লভ। তুমি ভাগ্যবান হে রাজা তেপই। সুখি হও তোমরা, ওম!
রাজা ডাকলেন, সন্যাসী? সন্যাসী?
সাড়া নেই।
কী হলো? কী হলো? ঘুম ভেঙে জিগেশ করলেন রানি।
রাজা বললেন, রানি, তুমি উঠেছে? শোনও, আমাদের দুখের দিন ঘুচে গেছে। খুব শীগগিরই আমাদের তৃষ্ণা তার পুত্রকে নিয়ে আমাদের উদ্ধার করতে আসবে।
রানির স্বরে দরিয়ার উথালপাথাল ঢেউ, কী বলছেন এসব আপনি? সত্যি নাকি? স্বপ্নে দেখেছেন বুঝি?
রাজা বললেন, না রানি। স্বপ্ন নয়। আমি যা বলছি, সব সত্যি। একটু আগে সন্যাসী এসছিলেন আমার কাছে। তিনিই বলে গেলেন এসব কথা।  
আর কী বলেছেন গো?
আর বলেছেন, আমি খুবই ভাগ্যবান। তার দ্যাখা নাকি কোনও মানুষ দু’বার পায় না। আমি পেয়েছি।
তাই বলেছেন বুঝি?
হ্যাঁ। আর বললেন, তিনিই নিয়তি। এবার দেখো রানি, আমাদের খুব সুখ হবে। এক্কেবারে সেই আগের জীবনের মতো।
রানি বললেন, আপনি আবার ঠাকুরঘরে বসবেন। ফুলবাগানে হেঁটে বেড়াবেন। এবার আপনার সঙ্গে থাকবে আপনার নাতি। আমাদের উত্তরাধিকার। আমার সঙ্গে থাকবে আমার তৃষ্ণা। বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন রানি। তার কাঁধে হাত রাখলেন রাজা। বলে উঠলেন, এই রে, আবার কাঁদতে আরম্ভ করলে? আর তো ক’টা দিন। সুদিনের আনন্দে চোখের জল যে বড্ড বেমানান রানি। হাসো। অন্ধকার এ কারাকক্ষ আলো করে তুমি হেসে ওঠো। বিশ্বাসঘাতক মন্ত্রী এবার পাবে উচিত শাস্তি।
টিকটিকি ডেকে উঠল, টিকটিক টিকটিক।

চলবে...