তৃষ্ণাকুমারী

শেষপর্ব

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : মার্চ ২৩, ২০১৮

সূর্য ঝকঝক করছে নদীর জলের ওপর। বজরার ছাদে বসে পিঠে খাচ্ছে আলোকচন্দ্র, আর ভাবছিল। পিঠেয় ভানুর হাতের ছোঁয়া সে অনুভব করছিল। কী করছে এখন ভানু? সেও কি তারই মতো ভাবছে এখন তার কথা? পরমুহূর্তে মনে পড়ল কিনু গোয়ালা আর খেদিমাকে। আহা, কী শোক পেয়েছেন তারা! চোখ ভিজে উঠল আলোকচন্দ্রের। সুদিন এলেই তাদেরকে খাগড়া মুল্লুকে নিয়ে যেতে হবে। একইসাথে সবাই থাকবে।

মেঘ নেই আকাশে। রোদটা একটু চড়া। বেলা বাড়লে নিচে নামল সে। সৈন্যদের জটলায় গিয়ে বসল। সৈন্যেরাও তার সঙ্গে সহজেই মেশে। হরেন নামের এক সৈন্য আছে। গল্পের ভাণ্ডার। মাঝেমাঝে সে খুলে বসে তার ঝাঁপি। হামুখে তখন সবাই তার কথা শুনতে থাকে। সে বলছিল ছায়াবুড়ির গল্প। ভারি আজগুবি এই ছায়াবুড়ি। সন্ধে নামলে সে গ্রামে ঢোকে। এরপর কুমারী মেয়েদের ফুসলাতে থাকে, চল ওই জঙ্গলে যায়, চল ওই জঙ্গলে যাই। জঙ্গলে কী আছে? প্রশ্ন করে এক সৈন্য। হরেন বলল, ওই জঙ্গলেই তো ছায়াবুড়ির বাড়ি। যেখানে দিনের বেলা গেলে কেউ বাড়িটাড়ি কিছুই দেখতে পাবে না। কিন্তু বাড়ি ঠিকই আছে। রাতের বেলা গেলে দ্যাখা যায়। আমাদের গাঁয়ের অনেকে দেখেছে। এরপর কী হলো বলি... আর তখন শোনা গেল মাঝির চিৎকার, উত্তর দিক দিয়া সদাগরি নাও যায়...

উঠে পড়ল সবাই। আলোকচন্দ্র নির্দেশ দিল নৌকাটা ধরতে। বজরা ছুটল। অল্পক্ষণ পরই গিয়ে ঠেকল নৌকাটির সঙ্গে। লাফ দিয়ে নেমে এলো আলোকচন্দ্র। তিনজন লোক পাটাতনের ওপর বসে ছিল। তাকে দেখে হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আলোকচন্দ্র জিগেশ করল, তোমাদের মধ্যে সদাগর কে? তিনজনের একজন জবাব দিল, সদাগর ছইয়ের ভেতর। আমরা তার কর্মচারী। আলোকচন্দ্র নির্দেশ দিল, সদাগরকে ডাকো। লোকটি বলল, সে আমাদের সাধ্যি নেই গো মশাই। ছইয়ের মধ্যে তিনি সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। ডাকাডাকি করলে তিনি রেগে যান। আলোকচন্দ্র জিগেশ করল, কিসে এত ব্যস্ত থাকেন তিনি? লোকটি বলল, আজ্ঞে, তাও আমরা কইতে পারব না। সদাগর জানতে পারলে আমাদের জুতোবেন।

ঠিকাছে, তোমাদের কাউকে ডাকতে হবে না। আমিই দেখছি। এই বলে আলোকচন্দ্র ছইয়ের সামনে গিয়ে ডাক দিল, সওদাগর বেরিয়ে এসো। জবাব ভেসে এলো, কে ডাকে?
বেরিয়ে এসো সদাগর। আমি রাজা শৈবালচন্দ্রের লোক।
কিছু সময় কাটল। কেউ বেরিয়ে এলো না। আলোকচন্দ্র আবার ডাকল, কই হে, বেরিয়ে এসো সদাগর।
ঘ্যাড়ঘেড়ে স্বরে জবাব ভেসে এলো, আমাকে বিরক্ত করো না তো বাপু। ওসব রাজাফাজা আমাকে দেখিও না।
আলোকচন্দ্র এবার জ্বলে উঠল। পরদা সরিয়ে উঁকি দিল ভেতরে। লম্বা-চওড়া এক লোক বসে তাড়ি খাচ্ছে। গায়েগতরে বেশ হৃষ্টপুষ্ট। পরনে সিল্কের জামা। হাতে সোনার আংটি। সৌখিন বেশভূষা। তার কাছেই বসে আছে এক নারী। ধবধবে শাদা শাড়ি পরনে। তাকে দেখতে পেয়ে মাথায় আঁচল তুলে দিয়েছে। নারীটির মুখের দিকে চাইতেই আলোকচন্দ্রের হৃদপিণ্ডটা কী রকম যেন লাফিয়ে উঠল। নারীটিও এক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল। কী রকম কাঁপা কাঁপা চাউনি। শুকনো মুখ। চোখের নিচে কালি।

চোখ নামিয়ে নিল আলোকচন্দ্র। নারীটিকে দেখে তো বিধবা বলে মনে হচ্ছে। সদাগরের সঙ্গে তবে তার সম্পর্ক কি?  হিসেব মেলাতে পারে না আলোকচন্দ্র। নদীপথে এ ক’দিনে তার অনেক কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। মানুষের কত রকমের যে চরিত্র, জানার কোনও শেষ নেই। সে জিগেশ করল, সদাগর আপনার কি হয়? জবাব নেই নারীটির মুখে। আলোকচন্দ্র বলল, তাকে বলুন দু’আনা খাজনা দিয়ে যেতে। এটা রাজার নির্দেশ। নারীটি মুখ নামিয়ে জবাব দিল, সে আমার কথা শুনবে না। যা বলার, আপনিই বলুন বাবা। আলোকচন্দ্র সদাগরকে বলল, এই যে মশাই, রাজার খাজনা ফেলুন। সওদাগর শুনল কী শুনল না, মুখ তুলে তাকালো একটু।

আলোকচন্দ্র নারীটির দিকে বলল, দেখে তো মনে হচ্ছে স্বাভাবিক হুঁশটুকু নেই। এই বলে সে সওদাগরের দিকে দু’পা এগিয়ে গেল। বলল, এই যে সদাগর, খাজনা দ্যাও। নয়তো এক্ষুণি তোমাকে বন্দি করা হবে। সওদাগর এবার তেড়ে উঠল, কে রে শালা তুই! বিছনার নিচ থেকে সে তুলে নিল বল্লম। এরপর উঠে দাঁড়ালো। টলছে তার পা। লোকটা তবু কোপ বসালো। ছিটকে সরে গেল আলোকচন্দ্র। সৈন্যদের ইশারা করতেই তারা ঝাপিয়ে পড়ল সওদাগরের ওপর। সওদাগর দু’চারটে কোপ এদিক-ওদিক মারলেও তা কারও গায়ে পড়ল না। সৈন্যেরা সহজেই তাকে বন্দি করে ফেলল। হাতপা বাঁধা অবস্থাতেও সওদাগর তড়পাতে লাগল। তাকে চিৎ করে রাখা হলো পাটাতনের ওপর। কর্মচারী তিনজন ঠকঠক কাঁপছে। বারবার তারা বলতে লাগল, আমাদের ছেড়ে দিন সেনাপতিমশাই। আমরা তো আপনার খাজনা দেয়ার মালিক নয়। গ্রামে বউবাচ্চা রয়েছে। পথ চেয়ে তারা বসে আছে।

আলোকচন্দ্র তাদের আশ্বস্ত করল, তোমাদের ভয় নেই। আগে রাজার কাছে চলো। আমি ছাড়ার কেউ নই। তবে আমি বলছি, রাজা তোমাদের ছেড়ে দেবেন।

বজরা তীরে ভিড়ছে।
নারীটি ছইয়ের ভেতর থেকে বের হয়নি। আলোকচন্দ্রের একবার ইচ্ছে হলো, উঁকি দিয়ে একটু দেখে আসতে। কিন্তু কী এক জড়তায় পা যেন নড়ল না। পাটাতনে দাঁড়িয়ে জলের দিকে সে চেয়ে রইল। বুকের ভেতর আকুলিবিকুলি করতে লাগল। কী এক টান সে টের পাচ্ছে নারীটির প্রতি, যেন কতদিনের চেনা। বজরা তীরে ভিড়লে বন্দিদের নিয়ে রাজবাড়ি এলো আলোকচন্দ্র। সওদাগর তখনও তাল মদিরার ঘোরে আছে। সারা পথ সে গজড়াতে লাগল। নারীটি চুপচাপ জড়োসরো ভঙ্গিতে হেঁটে এলো। কপাল পর্যন্ত ঘোমটা টানা। শাদা থান পরে আছে সে। ভালোভাবে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না।

রাজা শৈবালচন্দ্র শুনলেন সওদাগরের ধৃষ্টতার কথা। তাকে বন্দি করতে তিনি নির্দেশ দিলেন। নারীটি হেটমুণ্ডে দাঁড়িয়ে আছে। শৈবালচন্দ্র তাকে বললেন, মা, আপনি এবার যেতে পারেন। আপনি মুক্ত। নারীটি তবু দাঁড়িয়ে রইল। কিছু সময় পরে বলল, আমার তো কোথাও যাবার জায়গা নেই। এই লোকটিই ছিল আমার আশ্রয়। আলোকচন্দ্র বলল, কিন্তু আপনিই তো বললেন, সে আপনার স্বামী নয়। তাহলে আশ্রয় হলো কীভাবে? নারীটি কথা বলতে পারল না। রাজা বললেন, হ্যাঁ, বলো। তোমার পরিচয় বলো। কে তুমি?
নারীটি থরথর কাঁপতে লাগল।

রাজা বললেন, ভয় পেয়ো না মা। নির্ভয়ে তুমি পরিচয় বলতে পারো। রাজা শৈবালচন্দ্র কখনও কারও ওপর অন্যায় করেছে, এমনটি হয়নি।
নারীটি বলল, আমার নাম তৃষ্ণাকুমারী। খাগড়া মুল্লুকের রাজা তেপই আমার বাবা। এই সদাগর এক নদীর ঘাট থেকে আমাকে ধরে নিয়ে আসে। ঘাটে ছুড়ে ফ্যালে আমার কোলের সন্তানকে। একটু থামলেন নারীটি। আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছলেন। বললেন, পনেরো বছর ধরে এই সদাগর আমাকে তার কাছে রেখেছে। আমি বিধবার বেশ নিয়েছি। চিরদিনের জন্যে আমি হারিয়েছি আমার সন্তানকে। খাগড়া মুল্লুকেও ফেরার পথ আমার নেই। আমি এক অভাগী মহারাজ।

আলোকচন্দ্রের বুকের ভেতর আত্মাটা যেন লাফাচ্ছে। এ কী শুনছে সে? দুঃস্বপ্নের মতো কতকিছুই যে নিয়তি ঘটিয়ে ফেলতে পারে। রাজা শৈবালচন্দ্রও চমকে উঠলেন। তিনি চাইলেন আলোকচন্দ্রের দিকে। ডাকলেন, আলোকচন্দ্র? তুমিই তো খাগড়া মুল্লুকের কথা বলছিলে। তৃষ্ণাকুমারীই কি তবে তোমার মা? জবাব নেই আলোকচন্দ্রের। সে লুটিয়ে পড়ল মায়ের পায়ের ওপর। আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, মা মাগো, আমিই তোমার সেই ছেলে। আমার নাম আলোকচন্দ্র। নদীর ঘাট থেকে আমাকে কুড়িয়ে নেন এক সন্যাসী। রেখে আসেন এক গোয়ালার বাড়ি। সেই বাড়িতে আমি বড় হই। গরুর রাখালি করতাম। একদিন সন্যাসী এসে আমার পরিচয় জানালেন। বললেন, মায়ের সন্ধানে পথে বেরিয়ে পড়।

খবর পেয়ে ছুটে এলো ভানু ও সোনালি। রানি সূর্যবানও এলেন। আনন্দের বান বয়ে গেল রাজবাড়িতে।

খাটে শুয়ে আছে তৃষ্ণা। শিয়রের কাছে বসে আছে আলোকচন্দ্র। মায়ের একটা হাত তার মুঠোয়। তৃষ্ণা এখন আর কাঁদছে না। কী এক দুঃসহ পাষাণ যেন নেমে গেছে তার বুকের ওপর থেকে। ক্লান্তিতে দু’চোখ বুজে আছে। আলোকচন্দ্র ডাকল, মা?
উুঁ? চোখ মেলল তৃষ্ণা।
মা, আগামিকাল ভোরেই আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে খাগড়া মুল্লুকের পথে। খবর পেয়েছি, নানা তেপই ও নানিকে বন্দি করে রেখেছে মন্ত্রী। সে এখন বসেছে রাজসিংহাসনে।
আতকে উঠল তৃষ্ণা, সেকি! এ যে ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ। রাজাকে বলে শিগগির তবে তৈরি হয়ে নাও বাবা আলোক। তোমার নানা-নানি জীবনে অনেক কষ্ট সয়েছেন। এবার ভগবান তাদের জীবনে শান্তি দিন।

ভানু আর সোনালি এলো। তৃষ্ণা হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকল ভানুকে। আয় তো মা, এদিকে আয়। বোস আমার কাছে। খাটের কাছে একটা চেয়ার টেনে ভানু বসল। আলোকচন্দ্রের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ভানুর হাত ধরল তৃষ্ণা। বলল, ইশ, কী নরম গো মা তোমার হাত। আমি সব জেনেছি ভানু। রাজা শৈবালচন্দ্রই আমাকে বলেছেন। আমার আলোকের পরির মতো এরকম রানি হবে, এ যে ভাবতেও আমার আনন্দ।
আলোকচন্দ্র খাট ছেড়ে নামল। বলল, মা, আমি রাজামশাইকে বলে সৈন্যের ব্যবস্থা করি। সে বেরিয়ে গেল।