তোদে যাত্রা

শেষ পর্ব

ফাল্গুনী পান

প্রকাশিত : এপ্রিল ২২, ২০১৮

তোদে যখন পৌঁছলাম তখন সূর্য প্রায় ডুবুডুবু। চারদিকে বেশ ভিড়। কী হলো ব্যাপারটা! আমরা তো এই জেনে গেছিলাম যে, তোদে প্রচণ্ড শান্ত একটি জায়গা, যেখানে চিৎকার নেই, কোলাহল নেই। কিন্তু এখানে তো বেশ সরগরম। একটু পরেই জানলাম, আসলে সেদিন ছিল হাটবার; ফলে দূর-দূরান্তের পাহাড়ি গ্রাম থেকে সবাই এসেছে হাটে, তাদের সাপ্তাহিক জিনিসপত্র কিনতে। তাই এত জমায়েত।

পাহাড়ের অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই হাটগুলির গুরুত্ব খুব বেশি। গোটা পাহাড়জুড়েই চাষবাস বিশেষ কিছুই হয় না। হয় বলতে বড় এলাচ বা মশলার চাষ। ফলে সমতলের বাজার থেকে চাল বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় জীনিসপত্র কিনে এনে বিক্রি হয় এখানে। আবার পাহাড়ের গ্রামগুলি আকারেও ছোট। ফলে সব গ্রামে হাটও হয় না। দশ-পনেরোটা গ্রাম মিলে হয়তো একটা হাট বসে। ফলে এই হাটগুলি একপ্রকার মেলার চেহারা নেয়।

আমরা ওই হাটের কাছেই একটা হোম-স্টেতে উঠলাম। অবশ্য ওই গ্রামে একটা মাত্রই হোম-স্টে। আগে আরও একটা ছিল, কিন্তু এখন সেটা বন্ধ। পেট ভরে মোমো খেলাম আমরা, সঙ্গে চা। তারপর রুমে গিয়ে একটু গা এলিয়েছি, এমন সময় হোম-স্টের দাদা হাঁকডাক করে আমাদের নিচে ডেকে নিয়ে এলেন। আমরাও তড়িঘড়ি নিচে নেমে এলুম। এসে তো পু্রো হুব্বা। তখন সবে চাঁদ উঠেছে। পূর্ণিমার পরের দিন। পূব আকাশে একটু উত্তর ঘেঁষে একখান বিশাল বড় চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরে পড়ছে চাঁদের তরল আলো। তার মধ্যে আবার মাঝে মাঝে এক টুকরো মেঘ ঝপাঝপ করে গিলে ফেলছে চাঁদটাকে, আবার পরক্ষণেই উগড়ে বের করে দিচ্ছে। আমার চোখের পলক যেন ভুল মেরে দিয়েছে, একটানা তাকিয়ে থেকেও তার কোনো বিকার নেই। অনেক্ষণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে সময় কাটানোর পর আমরা হোম-স্টের দোকানে এলাম। সেখানে একটু খাওয়া-দাওয়া করে হাঁটতে বেরোলাম। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে ব্যালকনিতে বসে আড্ডা। তারপর ডিনার। তারপর আবার আড্ডা। আমরা দুটো রুম ভাড়া নিয়েছিলাম। একটা রুমে আমরা তিনজন ছিলাম, সেটা ধারের দিকে, পূ-পশ্চিম ঘেঁষে দু’দিকে দুটো জানলা।

পাহাড়ে রাত নামে খুব দ্রুত। আমাদের আটটার মধ্যেই খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়ে গেছিল। আর সারা পাহাড়ও নিশ্চুপ হয়ে পড়ে ছিল তখন। আমরা ব্যালকনিতে বসে গল্প করছি, সেই সময় খেয়াল করলাম, এই নিস্তব্ধতার মধ্যেও প্রকৃতি কিন্তু চুপ নেই। দূরে কোথাও একটা নদী বয়ে যাচ্ছে। আর সেই স্রোতের শব্দ পৌঁছাচ্ছে আমাদের কানে। খুবই মোনোটোনাস শব্দ, কিন্তু তবুও তার প্রত্যেকটি তরঙ্গে যেন একটা আলাদা মাধুর্য রয়েছে।

আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ১২টার দিকে। আমাদের মধ্যে ঐশী একটা খাটে একা ছিল। যখন ভোর হচ্ছে তখন সে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পায়। আগেই বলেছি, আমরা যে রুমে ছিলাম তার পূব আর পশ্চিম ঘেঁষে দুটো জানলা। ঐশী হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে একটা জানলা দিয়ে সবে ওঠা সূর্য আর একটা জানলা দিয়ে ক্রমশ অস্ত যাওয়া চাঁদকে দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়। অবশ্য সেই ভয় পাওয়াটার মধ্যে আবেগ ছিল, বিস্ময় ছিল; ভীতি ছিল না।

পরদিন সকালে উঠে আমরা রওনা দিলাম তাংতা বলে একটা গ্রামের উদ্দেশে। হাঁটা পথ। হোম-স্টে থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম আমরা। প্রায় দু’ঘণ্টা হাঁটার পর ওই যে নদীর স্রোতের শব্দের কথা বলেছিলাম, তার দেখা পেলাম। মাঝে একটা পাহাড়ি পরিবারে আমরা চা খেয়েছিলাম। তাদের সাথেও প্রচুর গল্প হলো। নদী যখন মাঝে পড়েছে তখন সেটাকে তো পেরোতেই হবে। নদীর উপর যাতায়াতের জন্য একটা ব্রিজ। অবশ্য সেটাকে ব্রিজ বলব কীনা, তা ভাবার বিষয়। ব্রিজ বলতে প্রচুর বাঁশের টুকরো একসাথে জোড়া করে দড়ি দিয়ে বেঁধে সে ব্রিজ তৈরি করা হয়েছে। আর তার নিচে সাপোর্ট বলতে গোটা আরো কিছু বাঁশ লাগানো। যেগুলোর অধিকাংশই আর অক্ষত নেই। ব্রিজে পা দিলেই সেটা দুলতে শুরু করে। আমরা পড়লাম মহাচিন্তায়। ব্রিজটা নদী থেকে প্রায় ২৫ ফুট উপরে। নদীর স্রোত ভয়ংকর, পড়লে আর বাঁচার আশা নেই। তার উপর এর মধ্যে আবার বিশাল বড় বড় পাথর আছে। কোনোক্রমে ব্রিজটা পেরোনো গেল।

ব্রিজ পেরিয়ে আমরা আবার হাঁটতে লাগলাম। এবার রাস্তা বেশ খাড়াই। ওই খাড়াই পথ পেরোতে দম প্রায় ফুরিয়েই এসেছিল। পৌঁছলাম তাংতা, সেখানে একটা বৌদ্ধ মন্দির দেখে আবার ফেরা শুরু।

পাহাড়ের রাজনীতি সমতলের থেকে ঢের ভিন্ন। তোদের দেয়ালে স্বাধীন গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে প্রচুর স্লোগান দেখেছি আমরা। আমাদের রাজ্য সরকার যে পাহাড়বাসীর সুখ-সুবিধা প্রদানে চূড়ান্ত ব্যর্থ, তা বোঝা গেল। আর তাই গ্রামে কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। একটা স্কুল আছে বটে কিন্তু সেটি রাজ্য সরকার পরিচালিত নয়। খ্রিস্টান মিশনারির একটি স্কুল। যেখানে পড়তে গেলে পয়সা দিতে হয়। প্রায় আট-দশটা গ্রামের জন্য বরাদ্দ হয়তো একটি স্কুল, তাও সেখানে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো একদমই নেই, শিক্ষক-শিক্ষিকা নেই পর্যাপ্ত। ন্যূনতম চিকিৎসার জন্য তাদের ছুটতে হয় চালসা বাজার কিংবা শিলিগুড়ি শহরে। আমরা যখন তাংতা গেলাম সেখানে জানলাম ওই গ্রামে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। পাহাড়ের এই ছোট ছোট গ্রামগুলির মানুষ প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সেখানকার পর্যটন ব্যবসাকে উন্নত করতে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও কোনো সরাকারি সাহায্য তারা পায় না।

যাই হোক, আমরা সন্ধের দিকে ফিরে এলাম আবার আমাদের হোম-স্টেতে। তারপর একটু খাওয়া-দাওয়া করে রেস্ট-গল্প-গান। পরদিন সকাল দিকে আমরা তোদে গ্রামটাই ঘুরে দেখলাম। বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বললাম, গল্প করলাম, শিখলাম। তারপর দুপুর দিকে আবার সুমোই চেপে সমতলের জন্য রওনা।

পাহাড় এবং পাহাড়ের মানুষ সবাই খুবই অদ্ভুত। তারা অন্যকে সহজে বিশ্বাস করতে দ্বিধা করে না। হয়তো তার জন্য সমস্যাতেও পড়ে তারা কখনও কখনও। আর এই পাহাড়ের প্রকৃতি আমাদের প্রতিদিনের দুরন্ত সময়সূচি থেকে একদম আলাদা। সেখানে আমাদের ছুটতে হয় না বরং আমরা অনুভব করতে পারি, প্রত্যেকটা মুহূর্তের আবহন আর বিসর্জন।

লেখক: ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মী, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়