তোমারে দেব না ভুলিতে

শামীমা জামান

প্রকাশিত : জুন ২৭, ২০১৮

বদিকে কেন গ্রেফতার করা হবে না? হ্যাঁ, এমনকি এই রিটটিও আপনি এখন করতেই পারেন। ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ না হয়েও নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে আদালতে যে প্রতিকার চাওয়া যায়, সেই বিষয়টিই জনসমক্ষে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। এখন প্রতি সপ্তাহেই জনস্বার্থে উচ্চ আদালতে রিট দায়ের হচ্ছে, রুল ইস্যুর পর সেই কাজ দ্রুত সমাধাও হচ্ছে। জনস্বার্থে দায়ের করা মামলা গুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু আমরা কজন চিনি সেই অগ্রপথিককে, যার কল্যাণে আজ জনগণ এমন কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে, যা আগে সম্ভব ছিল না। তিনি ড. মোহিউদ্দিন ফারুক।

একটি কোম্পানির উচ্চমাত্রায় তেজস্ক্রিয় গুড়াদুধ আমদানির বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে তিনি যে মামলা করেছিলেন, সে মামলার মাধ্যমে এ দেশের মানুষের জীবনের অধিকার, পরিবেশের অধিকারের অংশ হিসেবে আদালত কর্তৃক ঘোষিত যুগান্তকারী রায়ের মাধ্যমে স্বীকৃতি পায়। তার অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিষ্ঠার ফলস্বরূপ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এক কালজয়ী রায়ের মাধ্যমে সংবিধানের আলোকে ‘সংক্ষুব্ধ ‘ বা এর সংজ্ঞা সংক্রান্ত প্রশ্নের সমাধান প্রদান করে প্রায় সিকি শতাব্দীর বিদ্যমান জটিলতা ও বাধানিষেধ দূর করেন। এ রায়ের ফলে জনস্বার্থে মামলা করার অধিকার অর্জন করে আজ এ দেশের মানুষ।

মোহিউদ্দিন ফারুক ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ, গবেষক, পরিবেশকর্মী এবং আইনবিদ। সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী হওয়া সত্ত্বেও প্রথাগত পেশাকে বেছে না নিয়ে তিনি আইন পেশায় যোগ করেন এক নতুন মাত্রা। বাংলাদেশে তিনিই প্রথম পরিবেশ শব্দটি নিয়ে কাজ করেন। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে তিনি পরিবেশ সংক্রান্ত আইনকে জনস্বার্থে ব্যবহারের শপথ নিয়ে ১৯৯২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)।

১৯৯৪ সালের অক্টোবর মাসের ঘটনা। খুব তুচ্ছ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছু ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের জন্য দেশের সব চিকিৎসক একযোগে ধর্মঘট শুরু করেছিলেন। হাসপাতালগুলোতে শুরু হয়েছিল নারকীয় পরিস্থিতি। শত শত রোগী মারা গিয়েছিল বিনা চিকিৎসায়। প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগী, দুর্ঘটনা কবলিত মানুষ হাসপাতালে এসে আরো অসহায় ও নিরুপায় হয়ে পড়ছিল। চিকিৎসকেরা সেই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সেইসব ভাগ্যহত মানুষকে জিম্মি করে তাদের স্বার্থ উদ্ধারের ঘৃণ্যতম পথ বেছে নিয়েছিল। সেইসময় মোহিউদ্দিন ফারুক অসহায় মানুষগুলোর মর্মান্তিক অবস্থার কথা ভেবে সর্বাত্মক চিকিৎসক ধর্মঘট চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন। এ ধরনের ধর্মঘটকে অবৈধ বলে দাবি করেছিলেন।

হাইকোর্ট থেকে জনস্বার্থে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিঃশর্তভাবে চিকিৎসকদের অবৈধ ধর্মঘট প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল সেদিন। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল সেইসব ভুক্তভোগী মানুষ ও তাদের স্বজনেরা। হাইকোর্টের সেই নির্দেশের পর এ দেশের চিকিৎসকেরা আর কখনো এমন ঘৃণ্য পথে পা বাড়াতে সাহস করেনি।

বাংলাদেশ থেকে শিশু পাচার করে উটের জকি হিসেবে ব্যবহার করে একটা বর্বর উন্মত্ততায় মেতে ওঠে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। এই ছোট শিশুগুলোর ওজন কম, তাদের পিঠে ওঠালে হালকা বলে দৌড়াতে সুবিধা হয় এবং শিশু ভয়ে কাঁদতে থাকলে উট দ্রুত দৌড়াতে থাকে। মোহিউদ্দিন ফারুক মামলা করে জানতে চেয়েছিলেন, কতজন শিশুকে পাচার করা হয়েছে এবং তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য কী করা হয়েছে। তিনি ছিলেন একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। বহু পুরনো আইন সক্রিয় করার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগে পরিবেশ বিজ্ঞান কোর্স মাস্টার্স প্রবর্তন করা হয়েছে, এটা তার কাজের জন্যই সম্ভব হয়েছে।

১৯৫৪ সালের ২৫ জুন গোপালগঞ্জে জন্ম গ্রহন করেন ক্ষণজন্মা এই পুরুষ। বাবা মুক্তিযোদ্ধা ও সমাজসেবক হেমায়েত উদ্দিন আহমেদ। মা আনোয়ারা আহমেদ। ১৯৭৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ থেকে এল এল বি (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৯ সালে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থানসহ এলএলএম পাস করেন। নয়াদিল্লির ইন্সটিটিউট অব কনস্টিটিউশনাল অ্যান্ড পার্লামেন্টারি স্টাডিজ থেকে ১৯৮০ সালে প্রথম বিভাগে ডিপ্লোমা অর্জনের কৃতিত্ব লাভ করেন। এছাড়া তিনি ১৯৮১ সালে পার্লামেন্টারি ফেলোশিপ অর্জন করেন। ১৯৮৫ সালে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিপ্লোমা ইন ইন্টারন্যাশনাল ল’ ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮ সালে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

মোহিউদ্দিন ফারুক পরিবেশবাদী লেখক হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সাতটি গ্রন্থসহ ৬৯টি প্রকাশনা রয়েছে তার। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিদেশি পত্রপত্রিকায় তার বহু লেখা ছাপা হয়েছে। সেমিনার সিম্পোজিয়ামে উপস্থাপন করেছেন বহু নিবন্ধ। অল্প বয়সেই তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক পুরস্কার ও স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ফুসফুসে ভাইরাসের সংক্রমণে সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি নেই, কিন্তু রয়ে গেছে তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ‘বেলা’। মৃত্যুকালে তার প্রিয় ‘বেলা’র দায়িত্ব তিনি দিয়ে যান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে। ‘বেলা’র মহাসচিবের পদ অলংকৃত করে রিজওয়ানা হাসান ২০০৯ সালে জাতিসংঘ গোল্ডম্যান পুরস্কার ও ২০১২ সালে ম্যাগসাইসাই পুরস্কার গ্রহন করেন।

লেখক: কলামিস্ট ও কথাসাহিত্যিক