দহন

আত্মদীপ

প্রকাশিত : মার্চ ২০, ২০১৮

হাজার বছরের ভগ্নস্তূপের সামনে এসে সময় যেন এক তীব্র কৌতুকে মেতেছে আজ। তার অতীত বর্তমান মশিঢালা আগামী, সব কেমন যেন সেই কৌতুকে নৃত্য করতে থাকে। কেশাগ্রে রক্তের বিষে মাথা বুঝি যন্ত্রণাতে স্তব্ধ হয়ে যায়। কোনো এক সুকান্তি ছায়া বারবার মুখ বিকৃত করে ধিক্কার দিতে থাকে। প্রেমহীনতার স্পর্শে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে চোখ। বোঝা না, না বোঝা যায় না। যে রমণীর যোনিরেখা রক্তপাত সমগ্র দ্যুতসভা উপভোগ করেছে, এই অতি সামান্যে তার আতঙ্ক  বোঝা যায় না। কই সেদিন তো সে একবারও বলেনি, ‘ওগো আমি পঞ্চ সন্তানের মাতা। আমায় তোমরা রেহাই  দাও।’ আর আজ, কোথায় তার সেই সন্তানেরা?

ফাল্গুনী, ভালবেসেছি তোমায়। কই, আজ এই অন্ধকারগ্রস্ত মৃত্যুর স্তূপে তুমি আমায় গ্রহণ করছো না তো!  সেদিনও, হ্যাঁ, সেদিনও যখন দুঃশাসন প্রায় নগ্ন করে ফেলেছে আমায়, মধ্যম পাণ্ডব, তুমিও  উপভোগ করোনি তো? মহারাজ যুধিষ্ঠির আমায় ভোগ করছে কোনো রাতে। সেই ভাবনায় কখনো রোমাঞ্চ হয়নি তো? মনের মধ্যে তোলপাড় করে চলে চিন্তার ঢেউ। এটুকুতেও আজ আতঙ্ক হয়। কেবল বোঝা যায় না। সমগ্র অন্তর বুঝি ডুকরে ওঠে, সখা কৃষ্ণ, তুমি থাকতে আমার এত কিছু হারানোর ছিল? আমার সন্তান আমায় ফিরিয়ে দাও সখা। ইশ্বর আমার, আমার শেষ অহংকারটুকু ফিরিয়ে দাও। নত হয়ে ভিক্ষা মাগি, আমার সম্বল, আমার সন্তানদের ফিরিয়ে দাও! তুমি কী শুনতে পাচ্ছ না? তবে তোমার ওই এক নামই কী সার্থক? পার্থসারথি তুমি... কেবল পার্থসারথি।

বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ভাবনার স্রোত। চির অবহেলিত ভিমসেনের বুকে মাথা রেখে অন্তিম বিষটুকু পান করতে ইচ্ছা করে। সহদেবকে বিদ্রুপ করে নকুল ক্ষত বিক্ষত করতে চায় প্রাণ। কিন্তু ও কী, ভিমসেনের মুখমণ্ডল মনে আসছে না কেন? কেমন অন্ধকার জমাট বেঁধে থাকে। কেবল মনে হয়, আহা সেদিনও তো সে ছিল, দাসি সম্বোধন করে দ্যুতসভায় পান করেছিল অশ্লীলতার ভাণ্ড। তবু আজ, আজ তাকে কেন বারবার মনে পড়ে। সূর্যপ্রতিম সে। সূর্য পুত্র সে। আলোয় অসহায় বোধ হয়। কিন্তু হায় ফাল্গুনী, অজান্তেই শেষে তুমি, মহারাজ যুধিষ্ঠিরের একনিষ্ঠ ভ্রাতা, সেই তুমি, তোমরা সবাই ভাতৃত্বে আঘাত হানলে!

হাসো কৃষ্ণ। সময়ের কৌতুকে তাল মিলিয়ে হাসো। আমার কেবল চিৎকার করতে প্রাণ চায়। মাতা কুন্তী, সেই প্রথম দিন তুমি না বুঝে, এমন কী দর্শনটুকুও না করে তোমার পঞ্চ কামাতুর পুত্রবর্গকে একসূত্রে বেঁধে রাখার জন্য আমায় বিলিয়ে দিলে। আজ তোমার জ্যেষ্ঠ পুত্র স্বর্গলাভ করেছে। ভাতৃত্বের বিষাক্ত তীরে স্বেচ্ছায় প্রাণত্যাগ করেছে সে। তবে আজও কেন আমি এমন বিবাহের রঙে রাঙা? আজও কী ভাতৃত্বের জয়? তবে কী আমি বিধবা... ভগিনী পদ্মাবতীর ন্যায় সতিব্রত পালনে রত হব? হায়, কিচ্ছু বলা হয় না। অন্তরদহনে হাজার বার সতি হয় সম্রাজ্ঞী দৌপ্রদী! কেবল মনে মনে হাহাকার করে ওঠে, হায়, হাসো কৃষ্ণ। সময়ের কৌতুকে উন্মাদ হয়ে হাসো। তুমি তো জানো, আমি যজ্ঞাগ্নীভূতা... বহ্নির গ্রাস আমায় স্পর্শ  করবে না। হায় সখা... অসতি কী তবে... হায়! আমারও কী তবে একটাই পরিচয়? লাস্যে দগ্ধ, ভোগ্য বস্তু কেবল... যজ্ঞাগ্নীভূতা যাজ্ঞসেনী! কেবলই  যাজ্ঞসেনী?