দিন যায় কথা থাকে

পর্ব ২

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৮

তারা কেউ গান শুনিয়েছেন। কেউ লিখেছেন হিরন্ময় কবিতা। কেউ আবার গল্প-উপন্যাসের মালা গেঁথে সাজিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ঢালি। কেউ বা নিরলস জ্ঞানচর্চায় যোগ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন মাত্রা। তাদের সেই দিন আজ আর নেই, কেউ হারিয়ে গেছেন মহাকালে, কেউ বা এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন সেই পথে। তবে তাদের কথা আছে; তাদের কর্মে আর সৃজনশীলতায় তো বটেই, আমার কাছেও— কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, শব্দগুচ্ছের আড়ালে, বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে। হয়তো সেই কথাগুলো আবারো জেগে ওঠতে পারে আপনার মননস্পর্শ পেলে। চলুন পাঠ নেয়া যাক।

সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানী পর্ব
প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট সার্থকভাবে প্রকাশ পেল সচিত্র সন্ধানীতে। এরপর নানা বিষয়ের ওপরই অ্যাসাইনমেন্ট আসতে লাগলো। কিন্তু সাক্ষাৎকার আর কারো নিতে হলো না। সে সুযোগ এলো প্রায় এক বছর পর ১৯৯১ সালে। ততদিনে সচিত্র সন্ধানীর অবস্থা মুমূর্ষু পর্যায়ে। মফিদুল হক, আবুল হাসনাত ভাইরা চলে গেছেন অনেক আগেই। সৈয়দ শহীদ, আহমেদ ফারুক হাসানরাও নেই। একমাত্র ছিলেন স্বদেশ রায়। তিনিও হঠাৎ দীর্ঘ সময়ের জন্য জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে পড়লেন। সব ভার এসে পড়ল একা আমার ওপর। আমিই ঢাকা ডায়েরী লিখি, আমাকেই মূল প্রতিবেদন তৈরি করতে হয়, বিভাগীয় লেখাগুলোও লিখতে হয় আমাকে— প্রতি সংখ্যায় একহাতে পাঁচ ছয়টি লেখা লিখতে হতো বিভিন্ন বিষয়ে। সেই সঙ্গে সম্পাদনার দায়িত্ব তো ছিল-ই। সে-তুলনায় মাইনে প্রায় পেতাম না বললেই চলে! গাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদ নামকা ওয়াস্তে যৎসামান্য টাকা ধরিয়ে দিতেন হাতে, তার পরিমাণ উল্লেখ করার মতোও নয়।

অন্যদিকে, সহ্য করতে হতো কিছু কাপুরুষের গোপন টেলিফোন আক্রমণ। নাম-পরিচয় লুকিয়ে সচিত্র সন্ধানী অফিসে ফোন করে যারা আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতেন, তারা ভেবেছিলেন, আমি বুঝি সচিত্র সন্ধানীর সর্বেসর্বা বনে দুনিয়া মুঠো করে বসে রয়েছি! কিন্তু আমি তো টের পাচ্ছিলাম, যে সচিত্র সন্ধানীর জন্য তারা এতটা লালায়িত, নিজেদেরকে পরিণত করেছে কাপুরুষে, সে সন্ধানী চিরকালের মতোই হারিয়ে যেতে বসেছে! সন্ধানীর সেই বিছানায় শায়িতকালীন সময়েই এক দুপুরবেলা, দিন-মাস সময়ের কথা একদমই মনে নেই, সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ ডেকে পাঠালেন আমাকে তার রুমে।

গাজী ভাইয়ের রুমটি সব সময়ই ধোঁয়াশা আর অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকত। বদ্ধ রুমে তেমন আলোবাতাস খেলত না আর তিনি একটার পর একটা সিগারেট জ্বালাতেন অব্যাহতভাবে— সম্ভবত ডানহিল। রুমে প্রবেশ করতেই গাজী ভাই ফোনের রিসিভারটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘খালাম্মা লাইনে আছেন। কথা বলো।’ কে খালাম্মা কোন খালাম্মা কিচ্ছু জানি না। রিসিভারটা কানে আসতেই ওপাশ থেকে এক ভদ্রমহিলার সুললিত কণ্ঠ ভেসে এলো। ‘শুনো আমি জাহানারা ইমাম। তোমার লেখা আমি পড়েছি। তোমাকে একটা ইন্টারভিউ নিতে হবে। গৌরী আইয়ুব ঢাকায় এসেছেন, আমার বাসায়ই উঠেছেন, তুমি চলে এসো।’ খালাম্মার কথাগুলো কেমন জড়িয়ে যাচ্ছিল। সব কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। পরে শুনেছি, তিনি তখন মুখগহ্বরের ক্যান্সারে ভুগছিলেন। আমি কথা বুঝতে না পারায় উনি খুব বিরক্ত হচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত বললেন, ‘তুমি আমার বাসায় চলে এসো। সামনাসামনি কথা বলি।’

২৭ ফেব্রুয়ারি, বুধবার খালাম্মার এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় গেলাম। গিয়েই তার শান্তস্নিগ্ধ স্নেহের ছায়াশীতলতা পেলাম। যেন কতদিনের পরিচিত। পাশে বসেই কোনো কুশলবার্তা বা ট্র্যাডিশনাল কথাবার্তা না বলে জানালেন, ‘দুঃখ রয়ে গেল স্বৈরাচারমুক্ত পরিবেশে ভোট দিতে পারলাম না। ভোটার তালিকায় আমার নাম নেই।’ এরশাদ পতনের পর বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের তত্ত্বাবধানে হওয়া নির্বাচনের কথা বলছিলেন খালাম্মা। গৌরী আইয়ুব সেদিন সেখানে ছিলেন না। খালাম্মার সঙ্গে কথা বলে ঠিক হলো যে, আমাকে টেলিফোনে যখনই তিনি আসতে বলবেন, আমি তখনই এসে গৌরী আইয়ুবের ইন্টারভিউ নেব।

২ মার্চ শনিবার সচিত্র সন্ধানীতে খালাম্মার টেলিফোন পেয়ে সাড়ে বারোটার মধ্যেই তার এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় পৌঁছালাম। সেখান থেকে প্রাইভেট কারে খালাম্মা আমাকে নিয়ে গেলেন মহাখালি ডিওএইচএস নাকি বনানী ডিওএইচএস আজ ঠিক মনে নেই কোথায় সেটা— শহীদুল্লাহ খান বাদলের বাসায়। বিশাল সেই বাড়িতে উপস্থিত আছেন গৌরী আইয়ুব, তার তিনচার জন সফর সঙ্গীসহ। শুধু তাই নয়, বিরাট সাইজের ড্রয়িং রুমটি নানা অতিথির কলকাকলি মুখরতায় ভরপুর। সেদিন কার জন্মদিন উপলক্ষে বাসায় পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার একটা হেভি ব্যবস্থা। আনন্দময় পরিবেশ। এই কোলাহলময় পরিবেশেই আমি প্রখ্যাত ভারতীয় বুদ্ধিজীবী আবু সয়ীদ আইয়ুবের স্ত্রী, যিনি নিজেই এখন একজন স্বনামখ্যাত মানুষ, ঢাকায় এসেছেন সম্প্রতি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে— সেই গৌরী আইয়ুবের সাক্ষাৎকার নেয়া শুরু করলাম। এর মধ্যেই ডাক এলো খাওয়ার। তখনই টের পেলাম জাহানারা ইমামের ব্যক্তিত্বের অনন্যসুন্দর দিক। এতো ভিড়ের ভেতরেও তিনি খোঁজ রাখছেন আমি ঠিকমতো খাচ্ছি কিনা, খেতে সংকোচ বোধ করছি কিনা, কোন রকম অসুবিধে হচ্ছে কিনা, ঠিক তখন থেকেই মনে হলো তিনি তো আসলে খালাম্মা নন, মায়ের মতো। লাঞ্চের পর আরো দু’ঘণ্টা গৌরী আইয়ুবের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে পথে নেমে আসার পর মনে হলো, সাক্ষাৎকার গ্রহণের মধ্য দিয়েও অনেক কিছু অর্জন করা যায়, পাওয়া যায় একজন জাহানারা ইমামের মাতৃত্বের স্পর্শ। এরই সূত্র ধরে ঢাকা শহরের এলিফ্যান্ট রোডের ছোট্ট দ্বিতল শাদা বাড়িটায় আমি পেয়ে যাই নতুন এক স্নিগ্ধ ছায়া বিস্তৃত দিগন্তের মাঠ। আমি নতুন সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য মুখিয়ে থাকি।
     
জীবনের কাজ কখনো শেষ হয় না। শেষদিন পর্যন্ত যদি কাজ করে যেতে পারি, তবেই আমাদের সার্থকতা  

                                                                           গৌরী আইয়ুব

গৌরী আইয়ুব ঢাকায় এসেছেন ১৭ ফেব্রুয়ারি। অনেকের কাছে তিনি অপরিচিত হলেও, তাঁর স্বামী আবু সয়ীদ আইয়ুবের নাম এদেশের শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক মহলে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী আবু সয়ীদ আইয়ুব বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের ইতিহাসে একজন রূপকথার নায়ক। উর্দুভাষী হয়েও উর্দুতে ও পরে ইংরেজিতে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি পড়ে বাংলা ভাষার প্রেমে পড়ে যান। এরপর বাংলা ভাষাকে আয়ত্ব করেন। এক সময় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন শান্তিনিকেতনে। কেবল রবীন্দ্র সমালোচনা সাহিত্যই নয়, সমগ্র বাংলা সমালোচনা সাহিত্যেও তাঁর প্রজ্ঞার দ্যুতি আর মননের ইন্দ্রজাল অসামান্য নৈপুণ্যে ভাস্বর এবং স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল।

আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ, পথের শেষ কোথায়, পান্থজনের সখা— গ্রন্থসমূহ এদেশের বিদগ্ধ পাঠক মহলে বহুধন্য। তাঁর সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতা আজও বাংলা কবিতার শুধু শ্রেষ্ঠ সংকলন নয়, আধুনিক কবিতার দিগদর্শন-স্বরূপ, এ গ্রন্থের ভূমিকাটিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কর্মের মধ্যে হলো শেষ বয়সের অনুদিত গ্রন্থ ‘গালিবের গজল থেকে’। এ গ্রন্থটিতে গালিবের জীবনী মনোজ্ঞ ভাষায় লিখেছেন গৌরী আইয়ুব। আবু সয়ীদ আইয়ুব জীবনের কিছু মূল্যবান সময় অসুস্থতায় আক্রান্ত ছিলেন। গৌরী আইয়ুব তাঁর প্রজ্ঞা, মনন এবং ভালোবাসার গভীর সাহচর্যে এই মহৎ সাহিত্য-শিল্পীকে প্রেরণা জুগিয়েছেন, শক্তি দিয়েছেন। আবু সয়ীদ আইয়ুবের সঙ্গে তাই তাঁর নামটিও উচ্চারিত হয় পরম শ্রদ্ধায়। তিনি নিজেও নিরলসভাবে সাহিত্য ও জ্ঞান-চর্চায় আত্মোৎসর্গীকৃত। তাঁর বেশ কিছু প্রবন্ধ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ছোটগল্পের সার্থক রচয়িতা। একটি মাত্র ছোটগল্প গ্রন্থ ‘তুচ্ছ কিছু দুঃখ’তেই তাঁর প্রতিভা পরিস্ফুট। এছাড়াও সম্প্রতি এক জাপানী ছাত্রীর সঙ্গে যৌথভাবে অনুবাদ করেছেন প্রখ্যাত জাপানী হাইকু কবি বাশো-র কাব্যিক ভ্রমণ কাহিনী ‘দূর প্রদেশের সংকীর্ণ পথ’। অধ্যাপনা জীবন থেকে অবসর পেয়ে গৌরী আইয়ুব এখন জীবনকে নতুনভাবে সাজিয়েছেন। অনেক দিনের ইচ্ছে বাংলাদেশকে গভীরভাবে দেখার। সে আকাঙ্ক্ষার কারণেই এবার ঢাকায় এসেছেন। তাঁর সফর শুধু ঢাকাতেই কেন্দ্রায়িত নয়, ইতিমধ্যে ঘুরে এসেছেন চট্টগ্রাম থেকে, ময়মনসিংহে যাবার ইচ্ছে আছে।

ঢাকায় অবস্থানকালে সচিত্র সন্ধানীর প্রতিবেদক হামিদ কায়সার গৌরী আইয়ুব-এর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এই সাক্ষাৎকারে গৌরী আইয়ুব নিজের জীবন এবং আবু সয়ীদ আইয়ুব সম্পর্কে অনেক স্মৃতিচারণ করেন। ষাট উত্তীর্ণ অথচ প্রাণচঞ্চল তারুণ্যে উদ্ভাসিত গৌরী আইয়ুবের সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো—

হামিদ কায়সার: বাংলাদেশে এ নিয়ে ক’বার এলেন?
গৌরী আইয়ুব: বাংলাদেশে এই প্রথমবার এলাম। ১৯৪৪ সালে একবার এসেছিলাম ময়মনসিংহে, ওখানে আমার মা-বাবার দেশ, আমার জন্ম অবশ্য পাটনা বিহারে। বাংলাদেশে এবারই প্রথম। এবারই বোধ হয় শেষ আসা। বারবার আসার সামর্থ আমার নেই। আপনাদের আদর-যতœ আতিথ্যে অভিভূত। ওখানকার তুলনায় এখানকার রাজনৈতিক পরিবেশকে অনেক ভালো মনে হচ্ছে। বাংলাদেশের নির্বাচনের পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলার অবস্থা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমাদের ওখানে নির্বাচনের সময় খুব হাঙ্গামা হয়। অস্থায়ী সরকার এ ব্যাপারে যে ভূমিকা রেখেছে তা প্রশংসনীয়। নির্বাচনের দিন ঘুরে ঘুরে সব দেখেছি।
হামিদ কায়সার: বাংলাদেশের সাহিত্য কেমন লাগে, এখানকার লেখা পড়ার সুযোগ পান কি?
গৌরী আইয়ুব: লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করছি, আগ্রহ থাকলেও বাংলাদেশের সাহিত্য পড়ার সুযোগ হয়নি। যতদিন আমার স্বামী জীবিত ছিল ততদিন সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরক্ত ছিলাম। ওর মৃত্যুর পর ও জগতটার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। এবার বাংলাদেশের বই যত্ন করে পড়ব। সত্যি কথা অকপটে স্বীকার করলাম, এতদিন বাংলাদেশের বই না পড়ে যে অপরাধ করেছি, এবার পড়ে সে অপরাধবোধ থেকে মুক্ত হব। তবে জাহানারা ইমামের কিছু বই পড়েছি।

হামিদ কায়সার: জাহানারা ইমামের লেখা সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
গৌরী আইয়ুব: উনার বই সম্পর্কে ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছি। এ সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করছি না।
হামিদ কায়সার: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আপনার অনুভূতি কি?
গৌরী আইয়ুব: ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সকল মুক্তিযোদ্ধার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা। তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা স্মরণের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয়দের অবদানকেও যেন খাটো করে না দেখি। ইদানীং আপনাদের এবং আমাদের সম্পর্কের ভেতর একটি অবিশ্বাস জন্ম নিচ্ছে। এটা বেদনাদায়ক। আপনারা যেন আমাদেরকে বিশ্বাস করতে পারছেন না, ওদিকে পশ্চিম বাংলার ওরাও এখানকার সম্পর্কে উদাসীন। এখানকার শিল্প সাহিত্য রাজনীতি সম্পর্কে তারা কোন খোঁজ-খবরই রাখতে চান না। দুই বাংলার মধ্যে যে মানসিক দূরত্ব আছে তা দূর করার জন্য পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি ও আত্মসমালোচনার প্রয়োজন আছে।
হামিদ কায়সার: হিন্দীর প্রভাবে নাকি ওখানকার বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি স্বকীয়তা হারাতে বসেছে?
গৌরী আইয়ুব: অহিন্দি ভাষীরা হিন্দির পরিবর্তে ইংরেজিকে প্রধান ভাষা রাখার দাবি রাখছিল। পশ্চিম বাংলার ভেতর সরকারি কাজ-কর্মে হিন্দী ভাষা ব্যবহৃত হয় না। হিন্দী সম্পর্কে বরঞ্চ আমাদের মধ্যে একটা ঔদাসীন্যতা আছে। হিন্দী সাহিত্য বাংলা অনুবাদের চাইতে অনেক বেশি পরিমাণে বাংলা সাহিত্য হিন্দীতে অনুদিত হচ্ছে। এটা ঠিক, বাংলা চলচ্চিত্র হিন্দীর প্রভাবে স্বকীয়তা হারাতে বসেছে। কিন্তু সাহিত্যের ব্যাপারে আমাদের একটা অহংকার আছে।

হামিদ কায়সার: লেখালেখির জগতে কিভাবে জড়ালেন?
গৌরী আইয়ুব: লেখালেখি অল্প অল্প স্কুলের ম্যাগাজিন থেকেই শুরু করেছি। হাতে লেখা ম্যাগাজিনে। সিরিয়াসলি একটা গল্প লিখে ফেললাম পঁচিশ বছর বয়সে। অধুনালুপ্ত একটি ভালো পত্রিকায়। এ মুহূর্তে নামটি মনে করতে পারছি না। গল্পটি ছাপা হয়েছিল। আইয়ুব সেটির খুব প্রশংসা করেন। শান্তিনিকেতনের সাহিত্য সভায় নিয়মিত চর্চা করেছি। আমার লেখালেখির ব্যাপারে সয়ীদ খুব আগ্রহী ছিল। সৃষ্টিশীল কিছু লেখার জন্যে সয়ীদ খুব তাগিদ দিত আমাকে।
হামিদ কায়সার: আবু সয়ীদ আইয়ুবের সঙ্গে কখন কিভাবে পরিচয় হলো?
গৌরী আইয়ুব: ১৯৫০ সালে শান্তিনিকেতনে। আমি পাটনা থেকে এখানে পড়াশোনা করতে আসি। তার অল্প কদিন আগেই আইয়ুব চাকরি করতে শান্তিনিকেতনে যোগ দিয়েছে। ও অনেকদিন চাকরি করেনি অসুস্থ ছিল বলে। ১৯৪৯-এ একসময়ে ওর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে চাকুরির সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু উনি কোলকাতা ছাড়তে পারেননি। কোলকাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চলে আসতে চাননি। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, দেশ বিভাগ এবং পাকিস্তান সৃষ্টিতে যেসব মুসলিম চিন্তাশীল ব্যক্তিদের সমর্থন ছিল না তাদের মধ্যে আইয়ুবও একজন। কোলকাতায় সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে এক বাসায় থাকতেন। একদিন অনেক বন্ধু-বান্ধব মিলে ওরা গল্প করছিলেন। সেদিন মুজতবা আলী ওর ঢাকার চাকরির প্রসঙ্গ ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘মানুষ চাকুরি পেলে খুশি হয়, কিন্তু আবু সয়ীদ আইয়ুব চাকুরি পেয়ে খুশি নয়।’ বন্ধুরাও ওকে ঢাকায় আসতে দিতে রাজি  হলো না। বন্ধুদের অনুরোধে ও রবিঠাকুরের ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেষ্টায় শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীতে ১৯৫০ সালের মে মাসে ওর চাকুরি হলো। এর অল্প ক’দিন পরেই ওর সঙ্গে আমার পরিচয়। শান্তিনিকেতনে ও অসুস্থ হয়ে পড়ে একবার। অসুস্থ হয়ে চলে যায় কোলকাতায়। আমি কখনো কখনো কোলকাতায় এসে দেখা করতাম। আমাদের বিয়ে হয়েছে অবশ্য অনেক পরে ১৯৫৬ সালে।

হামিদ কায়সার: আবু সায়ীদ আইয়ুবের সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে কিছু বলবেন?
গৌরী আইয়ুব: আধুনিক কবিতার সংকলন তিনিই প্রথম করেছিলেন। এ সংকলনের ভূমিকা এখনো আধুনিক কবিদের সম্পর্কে সমান গুরুত্বপূর্ণ। এ ভূমিকা পড়ে রবীন্দ্রনাথ তাকে ডেকে পাঠান। এর অনেক আগে থেকে অবশ্য রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। সে সময়ে তার বাংলা লেখাটা যতটা সাবলীল ছিল, বলাটা ততটা সাবলীল ছিল না। যখন তিনি অসুস্থতার কারণে চাকুরি ছেড়ে দেন তখন অ্যামেরিকান রকি ফেলার ফাউন্ডেশন ফেলোশীপে মার্কসীয় দর্শন সম্পর্কে গবেষণা করেন। শেষ বয়সে অসুস্থতার কারণে সিরিয়াস কোন কাজ করতে পারছিলেন না। এ বয়সে নিজের মাতৃভাষা উর্দুর প্রতি ওর ঝোঁক ছিল। ও ভাষাটি অবচেতনে গভীরভাবে তাঁর ভেতরে গাঁথা ছিল। ছেলেবেলায় গালিব, মীর যাদের কবিতা পড়েছিলেন— সেসব কবিতার প্রতি তার আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে শেষ বয়সে। সেই আগ্রহ থেকেই ‘গালিবের গজল থেকে’ বইটির সৃষ্টি। উনি খুব পরিশ্রমী লেখক ছিলেন। একবার লিখে সন্তুষ্ট হতেন না। বারবার লেখা ঠিক করতেন। শেষ দিকে নিজে লিখতে পারতেন না। ওর এবং আমার বন্ধুরা এ ব্যাপারে সাহায্য করেছে। ওর লেখার ব্যাপারে আমিও শারীরিকভাবে পরিশ্রম করেছি।
হামিদ কায়সার: শেষ বয়সে জীবন সম্পর্কে আপনার উপলব্ধি কি?
গৌরী আইয়ুব: জীবনের কাজ কখনো শেষ হয় না। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যদি কাজ করে যেতে পারি তবেই আমাদের সার্থকতা।

গৌরী আইয়ুবের সফরসঙ্গী হয়ে এসেছেন অধ্যাপিকা বন্দনা মুখোপাধ্যায়, মনীষা দত্ত, দুলাল বন্দোপাধ্যায় এবং আবদুস সামাদ গায়েন। তারা সবাই ঘুরেফিরে বাংলাদেশকে দেখছেন। সবাই এদেশের আতিথেয়তায় মুগ্ধ। বন্দনা মুখোপাধ্যায় কথায় কথায় বললেন— ‘এদেশের ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। সুযোগ পেলে মধুর ক্যান্টিনে যাব।’

সচিত্র সন্ধানী ৮ মার্চ ১৯৯১ সংখ্যা