দিন যায় কথা থাকে

পর্ব ৪

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৮

তারা কেউ গান শুনিয়েছেন। কেউ লিখেছেন হিরন্ময় কবিতা। কেউ আবার গল্প-উপন্যাসের মালা গেঁথে সাজিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ঢালি। কেউ বা নিরলস জ্ঞানচর্চায় যোগ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন মাত্রা। তাদের সেই দিন আজ আর নেই, কেউ হারিয়ে গেছেন মহাকালে, কেউ বা এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন সেই পথে। তবে তাদের কথা আছে; তাদের কর্মে আর সৃজনশীলতায় তো বটেই, আমার কাছেও— কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, শব্দগুচ্ছের আড়ালে, বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে। হয়তো সেই কথাগুলো আবারো জেগে ওঠতে পারে আপনার মননস্পর্শ পেলে। চলুন পাঠ নেয়া যাক।

ওস্তাদ ফজলুল হকের কথা কি কারো মনে আছে? এমন ভরাট আর প্রাণস্পর্শী গলা ক‘জন শিল্পীর থাকে? আমার কথাটা বিশ্বাস না হয়, এখনই ইউটিউব সার্চ করে একবার অনুগ্রহপূর্বক শুনে নিন ওস্তাদ ফজলুল হকের গাওয়া নজরুলগীতি বা ইসলামি সঙ্গীত বা দরদি গলায় গাওয়া উর্দু কাওয়ালি। বিমুগ্ধ হয়ে শুধু শুনে যেতেই হবে সে-গান। তিনি মূলত ছিলেন উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের শিল্পী। কিন্তু রাগপ্রধান গান গেয়েও পরে অন্যান্য গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন। এমনকি আধুনিক গান ও চলচ্চিত্রের গানও গেয়েছেন। বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে গানের শিক্ষকতা করেছেন। সেই শিক্ষকতা, রাগ সঙ্গীতের ওপর তার গভীর দখল এবং নিজস্ব গায়কির নিজস্ব শুদ্ধ সত্তার কারণে সঙ্গীতামোদীদের কাছ থেকে তিনি লাভ করেছিলেন ওস্তাদ খেতাব।

সংবাদ-এর শিল্প ও সংস্কৃতি পাতার তখনকার সম্পাদক আবুল হাসনাতের নির্দেশমতো একদিন শেষ বিকেলে মোহাম্মদপুরে পৌঁছে যাই ওস্তাদ ফজলুল হকের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে। অনেক খুঁজে খুঁজে নূরজাহান রোডেই বোধহয় পেয়েছিলাম ওস্তাদ ফজলুল হকের বাড়িটি। কিন্তু তাকে দেখার পর সাক্ষাৎকার নেয়ার সমস্ত উৎসাহ দপ করে নিভে গিয়েছিল। বিছানার সঙ্গে মিশে আছে শরীর। হাড্ডিচর্মসার দেহ! কথা বলেন ক্ষীণ স্বরে। বোঝা যায় কী যায় না। মৃত্যুর জন্য নিজেকে পুরো সমর্পিত করে রেখেছেন। কী এক গভীর আকুলতা নিয়ে আমার ডান হাতটা অনেক অনেকক্ষণ ধরে রেখেছিলেন তার দুহাতের মুঠোয়। সাক্ষাৎকার না নিয়ে ফিরে এসেছিলাম শূন্য হাতে, বদলে লিখেছিলাম তাকে চাক্ষুস করার অভিজ্ঞতা।

ওস্তাদ ফজলুল হক সংকটাপন্ন জীবন
তিনি তার সমগ্র জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন সঙ্গীতে। জীবনের সাধারণ চাওয়া-পাওয়াকে উপেক্ষা করে সঙ্গীত-চর্চায় এমনি গভীর আত্মনিষ্ঠ ছিলেন যে, আজ তিনি কপর্দকশূন্য। বৈষয়িক, পারিবারিক দিকে কখনো মনোযোগী হননি, তার ভেতরের বাউল মানুষটি গানের মধ্যেই খুঁজে পেতো অমোঘ শান্তি। সেই সঙ্গীতে নিবেদিতপ্রাণ শিল্পী ওস্তাদ ফজলুল হক এখন কিডনি, ডায়াবেটিসসহ দূরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছেন। তার চিকিৎসার জন্যে সর্বমহলের সাহায্য প্রয়োজন। আজ থেকে ষাট বছর আগে ১৯৩০ সালে জামালপুর শহরের ব্রহ্মপুত্র নদের তীরের এক গ্রামে তার জন্ম। প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং অনন্ত রহস্যময়তা তার কৈশোর মনকে দিয়েছিল শিল্পের প্রথম মন্ত্র। স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি আপন খেয়ালেই গান গাইতেন। মা, খালা, মামারা প্রেরণা যোগাতেন। সঙ্গীত শিক্ষায় হাতেখড়ি হয় স্কুলের শিক্ষক সঙ্গীতজ্ঞ প্রাণেশ চন্দ্র মজুমদারের হাতে। পরবর্তী সময়ে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে প্রথমে তালিম নেন জামালপুরের প্রবীণ শিল্পী ধীরু সেন এবং পরে ময়মনসিংহের প্রখ্যাত ওস্তাদ বিজয়কৃষ্ণ ভট্টাচার্যের নিকট। লেখাপড়াতে কখনোই মন বসতো না তার। মনে তখন শিল্পী হওয়ার দুর্মর স্বপ্ন। গান শেখার তাগিদে মনের টানে চলে গেলেন ভারতের বিহারে। সেখানে ওস্তাদ নিহার হোসেন খান ও ওস্তাদ নূর মোহাম্মদ খানের নিকট দীর্ঘদিন তালিম নেন। বিহার থেকে ঢাকায় ফিরে এসেও নিজের সঙ্গীত শিক্ষা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি অতৃপ্ত শিল্পী। আবার দীক্ষা নিতে লাগলেন ওস্তাদ গুল মুহম্মদের কাছ থেকে। তাতেও পূর্ণতা পাননি, একসময় ছুটে গেছেন কলকাতায় ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলীর কাছে, তার কাছ থেকেও তালিম নিয়েছেন সঙ্গীতের। অথচ শেখার আকুতি তার ফুরাতো না। এখানেই তার শিল্পীসত্তার অমূল্য বৈশিষ্ট্যটি উন্মোচিত। এই প্রচারসর্বস্বতার যুগে যখন শিক্ষা-দীক্ষাহীন, বিনা সাধনায় রাতারাতি অধিকাংশ শিল্পীই নাম কামানোর জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন— সেই যুগে ওস্তাদ ফজলুল হক একজন ব্যতিক্রম এবং অনন্য চরিত্রের অধিকারী। একজন প্রাণখোলা, নিরহংকারী, আত্মভোলা মানুষ হিসেবে তিনি সবারই শ্রদ্ধার অধিকারী। খ্যাতি এবং প্রাচুর্যের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সঙ্গীতচর্চায় তিনি নিবিষ্ট থেকেছেন কেবল তার মনের তাগিদে, সৃষ্টির আনন্দে। গান শিক্ষা গ্রহণে যেমন তিনি উদ্যমী এবং নিরলস ছিলেন, পরবর্তী জীবনে গান শিক্ষা প্রদানেও ছিলেন আন্তরিক এবং দায়িত্ব-সচেতন। বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে গানের শিক্ষক হিসেবে যুক্ত ছিলেন একনাগাড়ে ৩০ বছর। এ দেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের অনেকেই তার কাছ থেকে সঙ্গীতে তালিম নিয়েছেন, ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ কেউ আজ খ্যাতির চূড়ান্ত চূড়াও করেছেন স্পর্শ। নিজের বিকাশের চেয়ে তিনি যত্নবান ছিলেন শিষ্যদেরকে উপযুক্ত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠায়— এ বিরল গুণের অধিকারী বলেই তার শিল্পীজীবন আজ সার্থক, ওস্তাদ হিসেবে তিনি সবার শ্রদ্ধার পাত্র। পরে তিনি ‘ওস্তাদ ফজলুল হক সঙ্গীত একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে উপযুক্ত সঙ্গীত শিল্পী তৈরির প্রচেষ্টায় মনোনিবেশ করেছিলেন— কিন্তু অসুস্থতা তার সেই উদ্যমে ভাটা এনেছে।

মূলত উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও, পরে তার প্রতিভা সঙ্গীতের বহু শাখায় বিস্তার পেয়েছিল— ইসলামি সঙ্গীত, হামদ, নাত ও গজল পরিবেশনায় তিনি যোগ করেছেন ভিন্ন মাত্রা। সুললিত এবং সঠিক গায়কিশৈলী তার পরিবেশিত গানকে দিয়েছে শুদ্ধতা। নজরুল সঙ্গীত, আধুনিক গান পরিবেশনাতেও তার গায়কি বৈশিষ্ট্য এবং ভিন্নতা শ্রোতাদের করেছে আকৃষ্ট। রাগপ্রধান গানের শিল্পী হয়েও তিনি গম্ভীর মেঘ থমথমে পাণ্ডিত্যের পরিমণ্ডলে নিজের জগৎকে শ্রোতার জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখেননি। বরঞ্চ পাণ্ডিত্যের সঙ্গে প্রয়োগের মনোহারিত্বে শ্রোতার সঙ্গে নিজের প্রাণের বন্ধনকে করেছেন নিবিড়— সঙ্গীতের গভীর জগতে এইভাবে তিনি নিয়তই ছিলেন পরিভ্রমণরত। সাংসারিক শত প্রতিকূলতা এবং জীবনের ঘোর দুর্যোগেও সঙ্গীতের এই ভুবন থেকে নিজেকে একতিলও করেননি বিচ্ছিন্ন। রেডিও চলচ্চিত্রে অসংখ্য বিচিত্রধর্মী গান পরিবেশন ছাড়াও তিনি আমজাদ হোসেনের ‘ধারাপাত’সহ আরো দুটি চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দিয়েছেন। এই সঙ্গীতপ্রেমী, সুরসাধক, শিল্পী মানুষটি আজ রোগে, অভাবে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে দিন কাটাচ্ছেন। আমাদের সঙ্গীত এবং শিল্পের জগৎকে শ্রদ্ধা জানানোর তাগিদেই ওস্তাদ ফজলুল হকের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণে কর্তৃপক্ষ এবং তার ভক্তদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

১৩ এপ্রিল ১৯৯৩, শিল্প ও সংস্কৃতি, দৈনিক সংবাদ