দিন যায় কথা থাকে

পর্ব ৫

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৪, ২০১৮

তারা কেউ গান শুনিয়েছেন। কেউ লিখেছেন হিরন্ময় কবিতা। কেউ আবার গল্প-উপন্যাসের মালা গেঁথে সাজিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ঢালি। কেউ বা নিরলস জ্ঞানচর্চায় যোগ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন মাত্রা। তাদের সেই দিন আজ আর নেই, কেউ হারিয়ে গেছেন মহাকালে, কেউ বা এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন সেই পথে। তবে তাদের কথা আছে; তাদের কর্মে আর সৃজনশীলতায় তো বটেই, আমার কাছেও— কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, শব্দগুচ্ছের আড়ালে, বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে। হয়তো সেই কথাগুলো আবারো জেগে ওঠতে পারে আপনার মননস্পর্শ পেলে। চলুন পাঠ নেয়া যাক।

শেখ লুৎফর রহমানও আজ বিস্মৃতপ্রায়। অথচ একসময় গণসঙ্গীত-শিল্পী হিসেবে উজ্জ্বীবিত করেছেন একুশে থেকে ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের প্রতিটি মুহূর্ত। সুরারোপ করেছেন অসংখ্য গান। একুশের প্রথম গানটিরও সুর দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর গাওয়া ও সুর দেয়া সিকানদার আবু জাফরের লেখা জনতার সংগ্রাম চলবেই গানটি এদেশের মুক্তি-সংগ্রামের এক অনন্য প্রেরণা। ১৯৯৩ সালে  ঢাকার পাতলা খাঁ লেনের একটি বাড়িতে শেখ লুৎফুর রহমানের হুইল চেয়ারে বসে দেওয়া কথা বলার ভঙ্গিটা আজো কত স্পষ্ট কত এবং কাছের! চলুন, তাঁর সাক্ষাৎকারটি পাঠ করা যাক।

‘দারিদ্রের কারণে বারবার গান শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটেছে। আমি গানের জ্ঞান সঞ্চয় করেছি অতি সামান্য। তবু ফাঁকি দিয়ে কখনো গান গাই না, এটাই আমার সান্ত্বনা।’
                                                                                                                                                                                শেখ লুৎফর রহমান

সাত-আট মাস বয়সে দুরারোগ্যে পা হারালেও অসীম মনোবল ও গভীর সাধনার জোরে সফলভাবেই জীবনের পথ পরিভ্রমণ করে দেশ ও মানুষের শিল্পী শেখ লুৎফর রহমান প্রায় সত্তর বয়সের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছেন। কিন্তু এখনো সদাহাস্য তিনি। তার চোখেমুখে তারুণ্যের উদ্ভাস। ঋজু ও ভরাট গলায় এখনো তিনি গান গেয়ে থাকেন, গান গাওয়া শেখানও। অসম্ভব জীবনমুখী এই মানুষটি শিল্পী জীবনের সেই লগ্নকাল থেকে আজ অবধি সমাজ ও সাধারণ মানুষের জন্য গান গেয়েছেন। এদেশের প্রতিটি আন্দোলন তার ‘গণসঙ্গীতের’ ছোঁয়ায় হিরণ্ময়তা পেয়েছে। ভাষা আন্দোলন, ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেই কেবল নয়, দেশের প্রতিটি সংকটকালে তার দৃঢ় ভূমিকা সমসাময়িক শিল্পীদের থেকে তাকে যেমন ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তেমনি নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের কাছে তিনি আদর্শস্থানীয়। গানের জন্য, শিল্পের জন্য জীবনে অনেককিছুই ছাড় দিয়েছেন, অর্জনও করেছেন মানুষের ভালোবাসা-সম্মান। শরীর আজকাল ভালো যাচ্ছে না তার, চলাফেরার গ-ি কমে আসছে, তবু এখনো মিছিলে যাবার স্বপ্ন দেখেন, কাজের ভেতর মগ্ন থেকেই আনন্দ পান। এই মহাপ্রাণ মানুষটির সঙ্গে কথা হচ্ছিল তার পাতলা খান লেনস্থ বাসায় পহেলা ডিসেম্বর। এদেশের অতীত, বর্তমান সময়ের সঙ্গীতের প্রেক্ষাপট এবং জীবনের নানা অভিজ্ঞতার স্মৃতি বিষয়ে জবাব দিচ্ছিলেন তিনি। নিম্নে আলাপচারিতা তুলে ধরা হলো।

হামিদ কায়সার: গানের জগতে এলেন কিভাবে?
শেখ লুৎফর রহমান: শৈশবের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং পারিপার্শ্বিক     অবস্থা আমাকে গান চর্চায় প্রাণিত করে। সাতক্ষীরা শহর থেকে মাত্র দেড় মাইল দূরে আমরা যে গ্রামে থাকতাম সেই কুখরালি ছিল বর্ধিষ্ণু হিন্দু পল্লী। শিক্ষিতদের সংখ্যা বেশি থাকায় সাংস্কৃতিকচর্চা ব্যাপকভাবে গড়ে উঠেছিল। গ্রাম থেকে দেড় ডজন উকিল-মোক্তার পায়ে হেঁটে রোজ কোর্ট-কাছারিতে যেতো-আসতো। ‘কুখরালি ইউপি স্কুল’-এ একটি সংস্কৃতি সংস্থা গড়ে উঠেছিল ‘কুখরালি দি বান্ধব নাট্য সমাজ’ নামে। পূজার দীর্ঘ ছুটিতে কোলকাতার আপন কর্মস্থল থেকে শিক্ষিত যুবকরা ফিরে এসে ঐ নাট্য সংস্থার মাধ্যমে নাটক করতো। দুর্গাপূজা উপলক্ষে বেশ কয়েকদিন ধরে যাত্রা হতো, খেলাধুলা হতো। প্রতি শীতকালে কোলকাতা থেকে নামী কীর্তনিয়াদের এনে পদাবলী কীর্তনের আসর বসানো হতো। রোজ রাতে চলে যেতাম কীর্তন শুনতে, কী যে ভালো লাগতো। তাছাড়া ঘরে ঘরেও ছিল গান-বাজনার চর্চা। আজ যে যতো বড়োই গায়ক হোন না কেনো তার শিল্পী সত্তাটি জেগে ওঠে রেকর্ডের গান, ফিল্মের গান শুনে এবং সে গান গাইতে গাইতেই সে গান গাওয়ার প্রথম হাতেখড়ি হয়। আমার বেলায় এমনটিই ঘটেছিল। তখন গ্রামে অনেক বাড়িতে ‘কলের গান’ ছিল। আমি যেখানে যেখানে গিয়ে কলের গান শুনতাম, শুনতে শুনতেই শিখে ফেলেছিলাম বেশ কয়েকটি ফিল্মের গান।  

হামিদ কায়সার: কার কাছ থেকে গান শিখেছেন? তখন গান শেখার পরিবেশ কেমন ছিল?
শেখ লুৎফর রহমান: গ্রামীণ পরিবেশে আপন খেয়ালে গাইতে গাইতেই গানের প্রতি কেমন ভালো লাগা শুরু হয়। ইতিমধ্যে স্কুলের ফাংশনে এক-আধটা গান গাইলে আমার নাম ছড়িয়ে পড়ে। ফলে গ্রামের দিদিমা, মাসিমারা আমায় ডেকে গান শুনতো। শহরেও ছড়িয়ে পড়েছিল সুখ্যাতি। হালখাতার সময় কোনো কোনো দোকানে নিমন্ত্রিত হয়ে আমাকে গান গাইতে হতো। নানা ধরনের উপস্থিত শ্রোতারা আমাকে আদর করতেন। কেউ কেউ উৎসাহ যোগাতেন এই বলে, এতো সুন্দর গলা তোমার। এখন থেকেই কোলকাতায় গিয়ে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম নিলে নামকরা শিল্পী হতে পারবে। কিন্তু আমার আত্মীয়-স্বজনের বাধার কারণে গান শিখতে কোলকাতা আমার যাওয়া হচ্ছিল না। একেতো ধর্মভীরু নানী গান শেখাকে মনে করতেন পাপ, অন্যদিকে আমি ছিলাম পঙ্গু। জন্মের সাত থেকে ন’মাসের মধ্যে প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয়ে স্বাভাবিক চলাচল ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। তখনকার কোলকাতার নামকরা নীলরতন হাসপাতালের চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ, পরবর্তীকালে বাবার উদ্ভাবিত এক পন্থায় দাঁড়াতে শেখা, তারপর এক পা দু’পা করে ক্রাচের সাহায্যে হাঁটতে চলতে অভ্যস্ত হই। পঙ্গুত্বের কারণে চলাফেরার অসুবিধার কথা ভেবে আত্মীয়স্বজন আমাকে কোলকাতায় যেতে দিতে রাজি ছিল না। শহরের কলের গানের দোকানে গান শুনে শিখে নিতাম। সেই গানের দোকানীর অনুপ্রেরণায় চব্বিশ পরগনার হাকিমপুরের অন্যতম জমিদার আবদুল ওয়াহিদ খানের সঙ্গে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলাম হাকিমপুরে। অহিদ খান আমাকে ‘হাকিমপুর হাইস্কুলে’ ভর্তি করিয়ে দেন (এ সময়ে সপ্তম শ্রেণীতে আমার সহপাঠী ছিলেন ‘দৈনিক সংবাদ’-এর এক সময়ের সাংবাদিক মোহাম্মদ তোহা খান)। আর গান শেখাতে পাঠিয়ে দেন পাশের গ্রামের ক্ষয়িষ্ণু জমিদার ডাক্তার শ্রী পশুপতিনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। তার কাছে আমি তিন থেকে সাড়ে তিন বছর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম নেই। এতোকাল পর বাবা-মা খোঁজ পেয়ে তারালি থেকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। কিন্তু বাড়িতে মন বসলো না, পঙ্গু হলেও মন ছিল পাহাড়ের মতো অটল। সুদূর সবসময় আমাকে ডাকতো। আবার বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে গেলাম চানপুরে মতি বাবু নামে এক জমিদারের সাথে। মতি বাবু আমাকে নবম শ্রেণীতে স্কুলে ভর্তি করালেন বটে, কিন্তু গান শেখার সুব্যবস্থা হলো না। তাই সেখান থেকে চলে যাই খুলনা জেলা শহরে। স্থির থাকিনি, কত জায়গায় যে ঘুরে বেড়িয়েছি। রেকর্ড শুনে নিজে নিজে গান শিখলেও সুরের ভাষা, ইতিহাস, গানের ব্যাকরণ এবং সঙ্গীতের উচ্চ অংশ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত যাদের কাছ থেকে শিখেছি এবং তালিম নিয়েছি তারা হলেন পশুপতিনাম চট্টোপাধ্যায়, খুলনার সীতানাথ প্রামাণিক, কলকাতার অনাথনাথ বোস, বিদ্যুৎ বিশ্বাস এবং দেশ বিভাগের পর করাচীতে ওস্তাদ ওমরাহ বন্ধু খান এবং হাবিব আলী খান সাহেব। দারিদ্রের কারণে বারবার গান শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটেছে। আমি গানের জ্ঞান সঞ্চয় করেছি অতি সামান্য। তবু ফাঁকি দিয়ে কখনো গান গাই না এটাই আমার সান্ত্বনা।

হামিদ কায়সার: আপনার যৌবনকাল কোথায় কেটেছে? কোলকাতা জীবনে তো আপনার অনেক স্মৃতি রয়েছে, সেসব আপনাকে আলোড়িত করে না?
শেখ লুৎফর রহমান: কৈশোরের শেষ এবং যৌবনের প্রথম লগ্নের কিছুটা সময় আমার কলকাতায় কেটেছে। পুরো যৌবনই কেটেছে ঢাকায়। তবে আমার চেতনার উন্মেষ এবং জীবনের পুঁথিপাঠ শুরু হয়েছিল কোলকাতাতেই। চল্লিশের দশক নানা কারণেই ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ, ২য় বিশ্বযুদ্ধ, ১৩৫০-এর মন্বত্বর, দেশ বিভাগকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ইত্যাদি নানা ঘটনায় তখনকার সময় ভারী অস্থির ছিল। এই সময় কমিউনিস্ট পার্টির সংস্কৃতি বিভাগ গণনাট্য সংঘ বা আই.পি.টি.এ নাচ-গান-নাটকের মাধ্যমে অন্যায় এবং অমানবিকতার প্রতিবাদ করছিল। এদের কিছু কিছু অনুষ্ঠান এবং কর্মকাণ্ডে আমি আই.পি.টি.এ-র অনুরক্ত হয়ে পড়ি। কমরেড আব্দুর রাজ্জাক খানের ছেলে তখনকার সময়ে একমাত্র মুসলিম নাট্যকর্মী মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ (মরহুম) আমাকে আই.পি.টি.এ অফিসে নিয়ে যান। এখানে এসেই উপলব্ধি করলাম দশটা বক্তৃতা দিয়ে একজন মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা না গেলেও একটি গণসঙ্গীত বা প্রতিবাদী গান দিয়ে সেটা সম্ভব। চাকরি ছেড়ে দিলাম, অল ইন্ডিয়া রেডিওর গান গাওয়া ছাড়লাম, সব ভুলে ছেড়ে দিয়ে আই.পি.টি.এ কালচারাল স্কোয়াডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করলাম কিছুকাল। এখানে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, হরিপদ কুমারী, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখদের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। গণসঙ্গীতের প্রতি প্রেম আমার এখান থেকেই।

হামিদ কায়সার: ভাষা আন্দোলনের সেই দিনগুলোর কথা ভাবতে আজ কেমন লাগে?
শেখ লুৎফর রহমান: ভাষা আন্দোলনের সময়কাল ধরা হয় বাহান্ন সালকে এটা ঠিক, কিন্তু এর শুরুটা আটচল্লিশ সালেই নয়? কারণ ঐ আটচল্লিশেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ঢাকায় প্রথম এসে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ধীরে ধীরে প্রতিবাদ জোরদার হতে থাকে। ৫২-তে আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয়। ঐ আটচল্লিশেই জিন্নাহ সাহেবের উক্তির পরে গান গেয়ে আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। পরবর্তীকালে তো জড়িত ছিলামই, ভাষা আন্দোলনে নানা ভাবেই জড়িয়ে ছিলাম। তৎকালীন সরকার একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন করতে দিত না, আমরা জোর করেই পালন করতাম।

হামিদ কায়সার: ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই/ জনতার সংগ্রাম চলবেই’ গানটির সঙ্গে কিভাবে যুক্ত হলেন কোন্ প্রেক্ষাপটে?
শেখ লুৎফর রহমান: ষাট দশকের কোনো এক সময়ে নির্বাচন দেয়া হলো। তখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন আইয়ুব খান। দ্বিতীয়বারের এ নির্বাচনে তাকে কোন ক্রমেই জয়ী হতে দেয়া হবে না সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক দৃঢ় ভূমিকা ও বিভিন্ন পন্থা গ্রহণ করলেও তার বিজয়কে ঠেকানো গেল না। কারণ, সে নির্বাচন তো আর শাহাবুদ্দিন আহমদের কেয়ারটেকার সরকারের আমলে বাংলাদেশের ইতিহাসে একমাত্র এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন ছিল না। দ্বিতীয়বারের মতো আইয়ুব খানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সংবাদটা ঘোষিত হলে সাহিত্যিক-সাংবাদিক সিকান্দার আবু জাফর সারারাত জেগে ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’ কবিতাটি লিখে দৈনিক ইত্তেফাকে পাঠিয়ে দেন। আইয়ুব খানের জয়ের সংবাদে যারা খুশি হয়েছিলেন, বাজনা বাজিয়েছিলেন, কিন্তু সে সংবাদে আঘাতপ্রাপ্তরা পরদিনের কাগজ, বিশেষ করে মানিক ভাইয়ের ইত্তেফাকের অপেক্ষায় ছিলেন। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে লুঙ্গি পড়ে দাঁত মাজতে মাজতে সদরঘাটে গিয়ে কাগজ খুঁজছি, হঠাৎ বন্ধুতুল্য ছোটভাই কামাল লোহানী ইত্তেফাকে প্রকাশিত কবিতাটি নিয়ে এলো আমার কাছে। সুর করে দিতে হবে কবিতাটিকে। সুর করে কামাল লোহানীকে শুনিয়ে দিলে ও খুশি হয়ে চলে গেলো। পরে আমি দীর্ঘ কবিতাটির আরো তিনটি স্তবক বেছে সুর করি। এই কবিতাটি সম্বন্ধেআমার মন্তব্য হলো, এ কবিতায় একটি আন্তর্জাতিক সুর পাওয়া যায়। এ গান শুধু বাংলা ভাষাভাষীর নয়। শোষণ জুলুম বঞ্চনা ছিলো, আছে, থাকবে। তাই জাফর ভাইয়ের এ কবিতাটি তথা এ গানটি সারা বিশ্বের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গাইবে।

হামিদ কায়সার: গণসঙ্গীত কি আজো ভূমিকা রাখতে পারে না? ইদানীং গণসঙ্গীত চর্চা সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?
শেখ লুৎফর রহমান: জাতীয় সংসদে বিরোধী পার্টি যে ভূমিকা রাখতে পারে, (অবশ্য নিয়মের দিকে তাকিয়ে বলছি) একটি গণসঙ্গীতেরও যথার্থ সেই ভূমিকা পালনের শক্তি থাকে। আর গণসঙ্গীত গাইতে গেলে গভীরভাবে দেশকে, দেশের মানুষকে সর্বোপরি জীবনকে ভালবাসতে শিখতে হয়। এসব বৈশিষ্ট্য ধারণ করে কেউ কি আজ গণসঙ্গীত গাইছে?

হামিদ কায়সার: উদীচীর সঙ্গেও তো আপনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন? উদীচী কি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারছে?
শেখ লুৎফর রহমান: উদীচীর জন্মলগ্ন থেকেই এর সাথে আমি এবং আরো অনেকেই জড়িত। সত্যেন দা, আলতাফকেও (আলতাফ মাহমুদ) টেনে এনেছিলেন এর জন্মলগ্নের প্রস্তুতিকালে। সত্যেন দা ছিলেন খাঁটি জীবন সৈনিক। নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে উপলব্ধি করলেন, ‘যে যুদ্ধ শুরু করেছিলাম সে যুদ্ধ যেদিন আমি বেঁচে থাকবো না সেদিনও চলতে থাকবে।’ তাই একদিন ঢাকার উত্তরপাড়ার কিছু ছেলে-মেয়ে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী। তিনি বিশ্বাস করতেন, অস্ত্র দিয়ে অস্ত্রকে পরাস্ত করা যায় কিন্তু মানুষের মন পাওয়া যায় না, মন গড়াও যায় না। তার গড়া উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী দিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন মানুষের চেতনা। তার জীবদ্দশায়ই বোধ হয় উদীচী ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল দেশ জুড়ে। দেশের অন্যান্য স্থানে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী শুনতে পাই ভালোই কাজ করছে, তবে ঢাকার উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী মনে হয় আগের সেই গতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। আমার এ মন্তব্য ঠিক হলো কি না জানি না। কারণ, অসুস্থ বলে সব সময় খোঁজও নিতে পারি না।

হামিদ কায়সার: আপনি রাজপথের শিল্পী এবং মানুষের একান্ত কাছের শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন, আজকের শিল্পীরা কি মানুষের সঙ্গে সংযোগ রাখতে পারছে?
শেখ লুৎফর রহমান: দেখো, শিল্পীদের সমাজের প্রতি একটা অঙ্গীকার থাকে। তবে শিল্পী বলতে তুমি কোন শিল্পীদের কথা বলছ, জানি না। কিন্তু আমি যে শিল্পীকে জানি তার অবশ্যই সমাজের প্রতি অঙ্গীকার থাকবে। আজকের শিল্পীরা সেই অঙ্গীকার সবসময় রাখতে পারছে বলে তো আমার মনে হয় না।

হামিদ কায়সার: রেডিও-টেলিভিশন কি সঙ্গীতের বিকাশে সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারছে?
শেখ লুৎফর রহমান: সঙ্গীত কথাটা অনেক ভারী। সে অর্থে রেডিও-টিভি সঙ্গীতের বিকাশে এক ধরনের চেষ্টা করেছে বলা যায়, তবে পুরোপুরি পারছে না।

হামিদ কায়সার: এ ব্যাপারে কি কোন ‘সাজেশন’ আছে আপনার?
শেখ লুৎফর রহমান: সঙ্গীতের মূল উৎস বা সঙ্গীতের প্রাণ হলো উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত- শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। ১৯৪৭-এ বেশ কিছু উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। দেশ বিভাগের পর তারা চলে গেলে শিল্পীর সংখ্যা কমে যায়। কিছু শিল্পী এর মধ্যে মারাও গেছেন। আমরা কড়ে গুণে ন’দশজন মুসলমান সঙ্গীত শিল্পীকে পেয়েছিলাম। দিনে দিনে কীভাবে শিল্পী গড়ে উঠলো, কীভাবে তাদের সংখ্যা বেড়ে গেল, সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। তবে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চা বেড়েছে এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ছাড়া গান শেখা উচিত নয় একথা সবাই মেনেও নিয়েছেন। দীর্ঘ কথার অবতারণা না করে এ প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য রেডিও-টিভি যে সময়টুকু দেয় তা যথেষ্ট নয়। এর সময় আরো বাড়াতে হবে।

হামিদ কায়সার: আগামী প্রজন্মের শিল্পীদের প্রতি আপনার কি পরামর্শ।
শেখ লুৎফর রহমান: আগামী প্রজন্মের শিল্পীদের প্রতি আমার একটাই কথা, (অবশ্য আমি যা ভাবি, বিশ্বাস করি) সবাই গান শেখো, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চা করো, এতে করে সবাই ভালো শিল্পী হিসেবে গড়ে না উঠলেও কেউ কেউ ভালো শিল্পীতো হবেই!

২৩ এপ্রিল ১৯৯৩, শিল্প ও সংস্কৃতি, দৈনিক সংবাদ