দিন যায় কথা থাকে

পর্ব ৭

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : অক্টোবর ১৮, ২০১৮

তারা কেউ গান শুনিয়েছেন। কেউ লিখেছেন হিরন্ময় কবিতা। কেউ আবার গল্প-উপন্যাসের মালা গেঁথে সাজিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ঢালি। কেউ বা নিরলস জ্ঞানচর্চায় যোগ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন মাত্রা। তাদের সেই দিন আজ আর নেই, কেউ হারিয়ে গেছেন মহাকালে, কেউ বা এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন সেই পথে। তবে তাদের কথা আছে; তাদের কর্মে আর সৃজনশীলতায় তো বটেই, আমার কাছেও— কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, শব্দগুচ্ছের আড়ালে, বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে। হয়তো সেই কথাগুলো আবারো জেগে ওঠতে পারে আপনার মননস্পর্শ পেলে। চলুন পাঠ নেয়া যাক।

ফিরে দেখা: প্রিয় লেখক প্রিয় বই ২

‘প্রাদোষে প্রাকৃতজন’ বেশ ভালো লাগছিল। কিন্তু তখনি আমার দৃষ্টিশক্তি বিদ্রোহ করে বসলো। চোখ খুব ব্যথা করতে লাগলো। আমি শওকত আলীর বইটি আর শেষ করতে পারলাম না। -রশীদ করীম

না, পক্ষাঘাত কেড়ে নিতে পারেনি তার সৌম্যতাকে। তিনি এখনো সপ্রাণ, নতুন, আধুনিক এবং অভিজাত বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল এক কান্তিমান পুরুষ। প্রায় পাঁচবছর গৃহবন্দির মতো জীবন কাটালেও, বাইরের জগৎ থেকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন নন। তাই তার পাশের টেবিলে এক টুকরো হীরক খণ্ডের মতো শোভা পাচ্ছিল সম্প্রতি সারা বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে দেয়া বই, অরুন্ধুতি রায়ের ‘দি গড অফ স্মল থিংস’। সারা জীবনই যে তিনি বিশ্বের সর্বাধুনিক সাহিত্যকর্মটিকে সঙ্গে সঙ্গে লুফে নিয়েছেন পড়ার জন্য। তার প্রমাণ মেলে তার শয়নকক্ষের বিশাল বুকশেলফের উপর চোখ বুলালেই। এপিক সাহিত্যকর্মের সঙ্গে সব যুগে ঝড়-তোলা ইংরেজি বইয়ের এক বিপুল সমারোহ। লক্ষণীয় যে, বেশ কয়েকটি মহৎ উপন্যাসের জনক রশীদ করীম, নিজের কোনো বইকে এ শেলফে জায়গা দেননি। নিজের রচিত বইগুলো ড্রয়িংরুমের বুকশেলফটিকে আলোকিত করে সাজানো। এই বুকশেলফের সব বইগুলো বাংলা ভাষাভাষী। রশীদ করীম বললেন, ভেতরের ঘরেও বুকশেলফ আছে। তাতো থাকবেই। যার হৃদয়ের ভেতরটা ঋদ্ধ-সমৃদ্ধ, তার ঘর তো বইয়ে বইয়ে ঠাসা থাকবেই। কীভাবে কথোপকথন শুরু করবো, বুঝতে না পেরে জানতে চাইলাম, আপনি কেমন আছেন?
রশীদ করীম: এখন কেমন আছি, সে তো দেখতেই পাচ্ছ। এই নভেম্বরে আমার স্ট্রোকের পাঁচ বছর পূর্ণ হবে। স্ট্রোকের দরুণ আমার ডান হাত ও ডান পা পক্ষাঘাতগ্রস্ত। শুধু তাই নয়, চোখের দৃষ্টিও ধীরে ধীরে কমে আসছে। আমি এখন কিছু পড়তে পারি না। এমনকি, খবরের কাগজ পর্যন্ত না। আমার মাথার গ্রহণ ক্ষমতাও অত্যন্ত দুর্বল। বাড়ির বাইরে কোথাও যেতে পারি না। এক ‘বারডেম’ ছাড়া কোথাও যাওয়া হয়নি। পাঁচটি বছর আমি গৃহবন্দি। এই রকমই আছি।

হামিদ কায়সার: এই পাঁচ বছর কি কোনো বই পড়েননি?
রশীদ করীম: স্ট্রোকের প্রথম দু’এক বছর আমার চোখের অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না। সেই দুবছরে কিছু কিছু বই পড়েছি। গ্রিক ফেইজ আমার অত্যন্ত প্রিয়। সফোক্লিস আর একবার পড়ি। তার তিনটি নাটক। দি থিভ অ্যান্ড প্লেন-এ যে তিনটি নাটক আছে, সেগুলো আবার পড়ে ফেলি। তাছাড়া আমি পান্না কায়সারের একটি ভ্রমণকাহিনি ও তসলিমা নাসরীনের একটি উপন্যাস পড়েছি। এরপর পড়ছিলাম শওকত আলীর ‘প্রাদোষে প্রাকৃতজন’, বেশ ভালো লাগছিল। কিন্তু তখনি আমার দৃষ্টিশক্তি বিদ্রোহ করে বসলো। চোখ খুব ব্যথা করতে লাগলো। আমি শওকত আলীর বইটি আর শেষ করতে পারলাম না। কিছুদিন বিশ্রাম করে হাতে নিলাম পেলগ্রেভস গোল্ডেন ট্রেজারি। সেখানেও চোখের কারণে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারলাম না। কিন্তু বইটি আমার আগেই পড়া ছিল। এই বারে অন্তত এইটুকু উপলব্ধি করলাম যে, বাংলা কবিতা ইংরেজি কবিতার তুলনায় অনেক পেছনে পড়ে আছে।

হামিদ কায়সার: স্ট্রোকের আগে তো প্রচুর এবং নিয়মিত বই পড়তেন?
রশীদ করীম: হ্যাঁ হ্যাঁ, বই পড়ার অভ্যেস সেই ছোটবেলা থেকেই।
হামিদ কায়সার: বইয়ের সঙ্গে সখ্য আপনার কীভাবে হলো? কীভাবে বইয়ের প্রেমে পড়ে গেলেন, জানতে কৌতূহল হচ্ছে।
রশীদ করীম: আমার প্রথম বইপড়ার ঘটনাটা খুব আকস্মিকভাবেই হয়ে যায়। তখন আমি স্কুলে পড়ি। কোন্ ক্লাসে মনে নেই। মনে আছে সেটা রোজার মাস। অর্থাৎ রমজান। বোধহয় তখন শীতকালও ছিল। আমি রোজকার মতো সেদিনও আমার চাচা ও চাচির বাড়ি বেড়াতে যাই। আমার চাচা সৈয়দ আবুল ফেদাহ এবং চাচি রওশন আরা বেগম। রওশন আরা বেগম ছিলেন অধ্যাপক হুমায়ুন কবিরের আপন বোন। সাধারণ পাঠক হয়তো চিনবেন অধ্যাপক হুমায়ুন কবিরকে চতুরঙ্গ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে। যদিও অধ্যাপক হুমায়ুন কবির অত্যন্ত নামকরা ছাত্র ছিলেন এবং ভারতের শিক্ষামন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন। তদুপরি ছিলেন লেখকও। যাই হোক, চাচা-চাচির বাড়ি এসে আমি ঘুরঘুর করছি। হঠাৎ দেখি, আলমারির উপর ‘চরিত্রহীন’ বইটি রাখা আছে। দেখলাম, লেখকের নাম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বেশ মোটাসোটা বই। এই বইটি বোধকরি আমাদের ছোটদের পড়া নিষেধ ছিল। তবে আমি চুপ করে সেটা নিয়ে আঙিনায় রাখা একটি চেয়ারে এসে বসলাম। কখন যে বইটির মধ্যে একেবারে ডুবে গেছি সে হুঁশ নেই। সকাল গেল, দুপুর গেল, অপরাহ্ন গেল, মাগরেবের নামাজের সময় হয় হয়— কিন্তু আমি তখনো বইটি একেবারে উন্মাদের মতো পড়ছি। চাচি এবং চাচাতো ভাইবোনেরা ইফতারি করার জন্য ডাকলেন। শুধু তখনি আমি উঠলাম। এইভাবে বোধকরি তিনদিনে আমি চরিত্রহীন শেষ করি। এমন আশ্চর্য সুন্দর বই আগে কখনো পড়িনি! তখন থেকেই খুঁজে পেতে আমি শরৎচন্দ্রের সব কটি বই পড়ে ফেললাম। শরৎচন্দ্র সম্পর্কে পরে আমি আবু সয়ীদ আইয়ুবের কাছে শুনেছি যে, তার ছোট উপন্যাস বা বড়গল্প নিস্কৃতি ও মেজদিদি ভালো। বড় উপন্যাস সম্পর্কে তিনি চুপ থাকেন। আইয়ুবের প্রতি কোনো অসম্মান না দেখিয়েই বলতে পারি যে, শরৎচন্দ্রকে উপেক্ষা করা একটি ফ্যাশন। আমি বুঝি না, কেন এই উপেক্ষা করার ট্র্যাডিশন। আমার মতে, শরৎচন্দ্রই বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। তার গৃহদাহ উপন্যাসে যে অসম সাহসিকতা তিনি দেখিয়েছেন, তা সেকালে অত্যন্ত দুর্লভ। মনে পড়ে, অচলা গিরিধীতে খুব সকালে বিছানা ছেড়ে ওঠে মুখ নত করে বারান্দায় বসে আছে। সুরেশ তার স্বামী মহিমের খুব বন্ধু। সেই সুরেশ পালিয়ে এসেছে অচলাকে নিয়ে। এই দৃশ্যে বলা হচ্ছে, অচলা সুরেশের সঙ্গে শয্যাশায়িনী হয়েছিল। অথচ অচলা ভালোবাসে তার স্বামী মহিমকে। এর ব্যাখ্যা কি তা শরৎচন্দ্র বলেননি। পাঠককে বুঝে নিতে হবে। শরৎচন্দ্র অত্যন্ত উঁচু মাপের ঔপন্যাসিক। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের সঙ্গে বাঙালি হিন্দু সমাজের হৃৎস্পন্দন হয়। দুই-ই একতারে বাঁধা। রঁমা রোঁলা ‘শ্রীকান্ত’র ইংরেজি অনুবাদের ফরাসি অনুবাদ করে মন্তব্য করেছিলেন, যিনি এই বই লিখতে পারেন, তার নোবেল প্রাইজ পাওয়া উচিত।  

হামিদ কায়সার: শরৎচন্দ্র ছাড়া প্রথমদিকে আর কারো উপন্যাস পড়েননি?
রশীদ করীম: হ্যাঁ পড়েছি। সেই সময়ই আমি বাংলা বই সম্বন্ধে সচেতন হলাম। সঙ্গে সঙ্গে খুঁজে পেতে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলো শেষ করলাম। তারপরই প্রমথ চৌধুরীর ছোটগল্পগুলো নিজে পড়লাম এবং অপরকে পড়ালাম।
হামিদ কায়সার: শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীন পাঠ প্রসঙ্গে আপনি বলেছেন এমন আশ্চর্য সুন্দর বই আগে কখনো পড়িনি। তার মানে আগে আপনি অন্যান্য বই পড়েছেন, আপনার একেবারে ছেলেবেলার বইপড়ার অভিজ্ঞতা জানতে চাচ্ছি।
রশীদ করীম: হাসিখুশির কথাই বলতে হয়। একটি অবিস্মরণীয় বই। এখনো মনে আছে হারাধনের দশটি ছেলে, ঘুরে পাড়াময়/একটি কোথায় হারিয়ে গেল, বাকি রইল নয়— যে কোনো অনুরূপ ইংরেজি বইয়ের সঙ্গে এ-বইটি তুলনীয়। তাছাড়া আছে, সুকুমার রায়ের আবোল-তাবোল। এটিও অত্যন্ত স্মরণীয় বই। সুকুমার রায় ছোটদের জন্য অন্য বহু বই লিখে গেছেন। সত্যজিৎ রায় আরো অনেক পরে তার গল্প ও গোয়েন্দা কাহিনিগুলোতে ভাষার অদ্ভুত বাহাদুরি দেখিয়েছেন। বাপ কা বেটা একেই বলে! তাছাড়া, অনেক পরে পড়েছি অন্নদাশংকর রায়ের উড়কি ধানের মুড়কি। এই বইটিতেও অনেক সুন্দর সুন্দর ছড়া রয়েছে ছেলেমেয়েদের জন্য।

হামিদ কায়সার: আপনার লেখক মানস গঠনে কি বই পাঠের কোনো ভূমিকা আছে— কোনো প্রেরণা পেয়েছেন?
রশীদ করীম: বই পড়ে লিখবার প্রেরণা পেয়েছি কীনা, সে কথা বলা ভারি কঠিন। আমার ধারণা, আমি প্রেরণা পেয়েছি ছেলেবেলায় আমার বাল্য সখি বলে যাকে অভিহিত করেছি— তার কাছ থেকে। ক্লাস এইটে থাকতে তারই প্রেরণায় আমি হাতেলেখা পত্রিকায় গল্প লিখেছি। আমার সাহিত্যজীবন শুরু হয়, ১৯৪০ কিংবা ৪১ সালে। তখন আমি বোধকরি মেট্রিক পড়ি বা পরীক্ষা দেই— তখনই কলকাতার সওগাত পত্রিকায় আয়েষা নামে আমার একটি গল্প প্রকাশিত হয়। সেই গল্পের প্রেরণা দেয় যাকে বাল্য সখি বলেছি— সেই-ই। তবে একটা কথা বলবো, শরৎচন্দ্র আমার মতে, এখনো বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। তার লেখা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে কিনা, তা বলতে পারব না। পরবর্তীকালে আমার সবচাইতে প্রিয় লেখকের স্থান দখল করে দস্তয়ভস্কি। তার ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট, ব্রাদার্স কারামাজাভ এবং দি ইডিয়ট— এই বড় তিনটি গ্রন্থ তো আছেই, কিন্তু তিনি যে কত বড় লেখক তা বুঝতে পারি, সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের দুটি হাস্যরসাত্মক উপন্যাস পাঠ করে। সে দুটি উপন্যাস হলো, আংকেলস ড্রিমস এবং দি গ্যাম্বলার। বোধকরি, একটি তৃতীয় হাস্যরসাত্মক উপন্যাসও ছিল। কিন্তু সেটার নাম ভুলে গেছি। দস্তয়ভস্কি কয়েক বছর সাইবেরিয়ায় ছিলেন। সেখানে তিনি মানুষের পীড়ন দুঃখ-দুর্দশার কথা অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে জানতে পারেন। তার এই অভিজ্ঞতা তার সাহিত্যকে প্রভাবিত করে। আঁদ্রে জিদ বলেছিলেন যে, সাহিত্যে শেক্সপীয়রের পরে দস্তয়ভস্কির নাম। দস্তয়ভস্কি, টলস্টয় ও তুর্গেনিভ— উপন্যাসের ব্যূহ সৃষ্টি করেছেন, সেখানে কেউ প্রবেশ করতে পারবেন না। তারাই উপন্যাসে শ্রেষ্ঠ।

হামিদ কায়সার:  বাংলা ভাষায় কাদের উপন্যাস আপনি পড়েছেন? আপনার এ-বিষয়ে পাঠ-অভিজ্ঞতা জানতে চাচ্ছি।
রশীদ করীম:  প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের কথা ধরা যাক। বঙ্কিমচন্দ্রতো বাংলা উপন্যাসের জনক। তার কথা ছেড়ে দিলাম। রবীন্দ্রনাথের গোরা এবং যোগাযোগ খুবই উচ্চাঙ্গের উপন্যাস। শরৎচন্দ্রের কথা তা বলেইছি। বিভূতিভূষণের আরণ্যক, আদর্শ হিন্দু হোটেল আমার ভালো লেগেছে। তারাশংকরের কবি উপন্যাসটি আমার খুব প্রিয়। তাছাড়া তিনি কয়েকটি উৎকৃষ্ট ছোটগল্প লিখেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আমার ভালো লাগে না। তার পদ্মা নদীর মাঝি এবং পুতুল নাচের ইতিকথা বই দুটিকে বানোয়াট মনে হয়। আমার প্রিয় লেখক নরেন্দ্রনাথ মিত্র। তার দ্বীপপুঞ্জ, চেনামহল উকৃষ্ট উপন্যাস। তাছাড়া তিনি গল্প লিখেছেন অতিশয় চমৎকার। গল্পলেখক হিসেবে অবশ্য প্রেমেন্দ্র মিত্রের নামও করতে হয়। তিনিও খুব ভালো গল্প লিখেছেন। আরেকজন ঔপন্যাসিকের নাম করবো। তিনি গৌরকিশোর ঘোষ। তার জল পড়ে পাতা নড়ে, প্রেম নেই, আরেকটি যেন কী নাম এই ত্রিলজির উপন্যাসগুলো স্মরণ করিয়ে দেয় ইংরেজি উপন্যাসের মানদণ্ড। যদিও তার প্রেম নেই উপন্যাসে একটি পরিচ্ছেদ আছে, যেটি হেমিংওয়ের দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্যা সি গ্রন্থটির কথা মনে করিয়ে দেয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ভালো লেখেন। অবশ্য এখন উপন্যাসের আঙ্গিক ও বিষয় সম্পূর্ণ বদলে যাচ্ছে। আমরা, যারা আগেকার আমলের লোক, তারা ঠিকই তাদের অনুধাবন করতে পারবো না। যেমন, অরুন্ধতি রায়ের ইংরেজি উপন্যাস দি গড অফ স্মল থিংকস বইটির কথা বলা যায়। বইটি আমি পড়িনি আমার স্বাস্থ্যগত কারণে। কিন্তু বিশ্বময় অনেকেই পড়েছেন, তবে আমি নাড়াচাড়া করে দেখেছি।

হামিদ কায়সার:  এবার বাংলাদেশেরর ঔপন্যাসিকদের কথা বলুন, কার কার লেখা পড়েছেন? কেমন লেগেছে?
রশীদ করীম: বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকদেরর মধ্যে আমি আবু রুশদ, শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শামসুদ্দিন আবুল কালাম, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, মঈনুল আহসান সাবের প্রমুখের লেখা পড়েছি। আবু রুশদ-এর একটি গুণ আছে যা ঐতিহাসিক। কেউ কেড়ে নিতে পারবে না তার কাছ থেকে। তিনি সর্বপ্রথম মুসলিম নাগরিক মধ্যবিত্তদের নিয়ে গল্প ও উপন্যাস লিখেন। শওকত ওসমানের জননীর একটি পরিচ্ছেদ আছে যেটি এপিক মর্যাদা লাভ করেছে। আমি আমার প্রবন্ধ সংকলন আর এক দৃষ্টিকোণ গ্রন্থে আবু রুশদ ও শওকত ওসমান সম্পর্কে লিখেছি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এবং তার লালসালু সম্পর্কেও লিখেছি। আমার মনে হয়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে একটু বাড়াবাড়ি করা হয়। তবে তার চাঁদের অমাবস্যা একটি স্মরণীয় উপন্যাস। শামসুদ্দিন আবুল কালামের কাশবনের কন্যা একটি ভালো উপন্যাস। তাছাড়া তিনি ভালো কিছু গল্পও লিখেছেন। তার গল্প কেরায়া নায়ের মাঝি মনে পড়ে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের দ্বিতীয় উপন্যাসটি আমার পাঠ করা হয়নি চোখের কারণে। সকলেই এই উপন্যাসটির প্রশংসা করেন। কিন্তু তার প্রথম উপন্যাস চিলেকোঠার সেপাই আমি পড়েছি। আমার খুব ভালো লাগেনি। হুমায়ূন আহমেদ নন্দিত নরকে লিখে বেশ চমক সৃষ্টি করেছিলেন। তার শঙ্খনীল কারাগারও মন্দ নয়। কিন্তু তিনি এত লিখছেন কেন? ইমদাদুল হক মিলনের প্রকাশিত নুরজাহান উপন্যাসটি আমার পড়া হয়নি চোখের কারণে। মঈনুল আহসান সাবেরের কোনো লেখাই তেমন আমার হাতে পড়েনি। তবে উপরোক্ত তিনজন সম্পর্কে আমার সেই একই কথা, এত লিখেন কেন? পৃথিবীর কোনো দেশের কোনো বিশ্ববিখ্যাত লেখকই সাত-আটটির বেশি উপন্যাস লেখেননি। আমাদের মধ্যে এই যে প্রবণতা দেখা দিয়েছে, সেটি কি পশ্চিমবঙ্গের প্রভাব? উপন্যাস পণ্যবস্তু নয়। একই উপন্যাসের পুনরাবৃত্তি করে কী লাভ? আমাদের কয়েকজন মহিলা লেখিকা আছেন, যারা পুরুষের সঙ্গে টেক্কা দিতে পারেন। আসলে পুরুষ লেখক আর মহিলা লেখিকা বলে আলাদা কিছু নেই। শামস রশীদ, রাজিয়া খান, রাবেয়া খাতুন, রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন প্রমুখরা আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তাদের নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করতে পারছি না, ক্লান্তিবশত। আমি আগেই বলেছি, আমার মাথার গ্রহণ ক্ষমতা খুবই দুর্বল।

হামিদ কায়সার: আপনার কবিতা পাঠ সম্পর্কে কিন্তু কিছুই জানা হলো না।
রশীদ করীম: কবিতার আমি মুগ্ধ পাঠক। তবে আজ আর নয়। আরেকদিন বলবো। খুব ক্লান্ত লাগছে। কথাসাহিত্যিক এবং কবি উভয় দলেরই বহু নতুন নাম শোনা যাচ্ছে। কিন্তু, আমার পারঙ্গমহীনতার জন্য আমি তাদের সম্বন্ধে কিছুই জানি না। ও হ্যা, হঠাৎ মনে পড়ে গেল আমাদের কথাসাহিত্যের কয়েকটি উচ্চাঙ্গের নাম। আমার গ্রহণ ক্ষমতা যে দুর্বল এই  অমিশেন তারই প্রমাণ। হাসান আজিজুল হক খুব ভালো গল্প লিখেছেন। যদিও আমি শারীরিক কারণে তার লেখা সম্প্রতি পড়তে পারিনি, তবে আমার মনে হয়, দশ পনেরো বছর ধরে হাসান আজিজুল হক কেমন যেন স্তিমিত হয়ে গেছেন। হাসনাত আবদুল হাই আরেকটি উজ্জ্বল নাম। তিনি অনেকগুলো সুন্দর গল্প লিখেছেন। একেবারে শেষে বলছি মাহমুদুল হকের কথা। কিন্তু শেষ মানেই তিনি উপেক্ষণীয় নন। বরং তিনি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ঔপন্যাসিক। যদিও এখন তিনি বোধহয় লিখছেন না। তার নিরাপদ তন্দ্রা সম্পর্কে আমি আলোচনা করেছি। তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী লেখক... না, আজ আর নয়...।

১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭, সাহিত্য সাময়িকী, দৈনিক সংবাদ-এ প্রকাশিত।